কবি পরিচিতিঃ কবি আফরিনা নাজনীন মিলি বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সে কর্মরত আছেন। তিনি কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের একজন সক্রিয় সেবক। ব্যক্তি জীবনে দুই কন্যার গর্বিত জননী। বাসা, পেশা আর কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন ঘিরে তার জীবন আবর্তিত। লেখার জগতে বেশ কিছুদিন হলেও কবিতার জগতে আকস্মিক অনুপ্রবেশ। অগ্রগামী কবি ফারহাত আহমেদ এর অনুপ্রেরণা আর উৎসাহে কবিতায় তার হাতেখড়ি এবং কবিতার আসরে আগমণ। সেবা তার জীবনের মূল ধর্ম। লেখার মাধ্যমে তিনি মানুষের কাছে পৌছাতে চান, বেঁচে থাকতে চান প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের হৃদয়ে তাদের সংকটে, সম্ভাবনায় প্রেরণার উৎস হয়ে। তার একক কাব্যগ্রন্থ "ডূব সাঁতার" প্রকাশিত হয় ২০১৭ সালে। কবিতার আসরের সাথে যংযুক্ত আছেন ৬ বছর, এরই মধ্যে আসরের পাতায় ১০৫৫টি কবিতা প্রকাশ করেছেন।


তার একক কাব্যগ্রন্থভ “ডুব সাঁতার’ নিয়ে রিভিউ লিখছি। এই কাব্যগ্রন্থটি  অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৭ সালে প্রকাশ করেছে গৌরব প্রকাশনী সংস্থা , ঢাকা, বাংলাদেশ থেকে। প্রচ্ছদ একেছেন মিজানুর রহমান মুন্না। ছয় ফর্মার কাব্যগ্রন্থটিতে মোট ৭৭টি কবিতা স্থান পেয়েছে।


ডুব সাঁতার একক কাব্যগ্রন্থঃ গন্থটির নামকরনের পেছনে কথা বলতে গিয়ে ভূমিকাতে কবি লিখেছেন-“জীবনটাকে আমি দেখি একটি সুগভীর সাগর হিসেবে, যেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে জানা অজানা মণি-মুক্তাসহ দুর্লভ সব প্রবাল আবার বাস করে হাঙ্গরের মতো ভয়ঙ্কর প্রাণী। একজন ডুবুরী যতোটা দক্ষতার সাথে ডুব সাঁতার কাটতে পারেবেন ততোটাই তিনি পানির গভীর থেকে তুলে আনতে পারবেন মূল্যবান মন-মুক্তাকে আর পাশ কাটাতে পারবেন হাঙ্গরসহ সব বিপদ্গুলোকে। বহুবার ডুব দিতে হয়েছে জীবনের এই গভীর সাগরে, কখনো দক্ষতার সাথে ডুব সাঁতার কেটে নিয়ে এসেছি কাঙ্ক্ষিত মণি-মুক্তা প্রবাল, কখনো বা হাঙ্গরের তাড়া খেয়ে প্রাণটা নিয়ে ভেসে উঠেছি পানির উপরে। প্রস্তুতি নিচ্ছি আবারোও ডুব সাতারের জন্য... গ্রন্থের নামকরনের পেছনের কারন পাঠকের অনেক সময়ই জানা হয় না, নামকরনের পেছনের ইতিহাস জানা পাঠকের এক ধরনের অধিকার, কবি পাঠককে ঠকাতে চাননি কোনভাবেই। পাঠক খুব সহজেই তার গ্রন্থের গভীরে ডুব সাঁতার দিতে আগ্রহ বোধ করবে, আমিও তাই করেছি।


কবি আফরিনা নাজনীন মিলি’র কবিতার একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য, আকারে খুব ছোট মাপের (বেশির ভাগ কবিতা ২০-২৮ লাইনের), ছন্দের দোলা সম্বলিত এবং বক্তব্য বেশ তীর্যক। তিনি, কবিতা লিখতে পছন্দ করেন, চারপাশের নানা অন্যায়, অসঙ্গতি, অনাচার কিংবা বৈষম্যের নীতি নিয়ে। উপমা বা রূপকের আশ্রয় খুব একটা দেখা যায় না তার কবিতায় কিন্তু বক্তব্য বা কবিতার ম্যাসেজ খুব পরিষ্কার। প্রতিটি কবিতায় কোন না কোন ম্যাসেজ থাকে পাঠকের জন্য। কবিতায় ভাবকাব্যের চেয়েও ম্যাসেজ প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়, মুলত রিয়ালিজম (Realism) ধারার কবিতায় এমনটা দেখা যায়।


সমাজের নানা অসঙ্গতি নিয়ে বেশ কিছু কবিতা দেখা যায় যেমন- এমন কেন, অমন কেন নয়, সতীদাহ, নন্দিত নাকি নিন্দিত, কমন জেন্ডার ইত্যাদি কবিতায়। আবার অন্যদিকে মানব প্রেম বিরহ উঠে এসেছে তার কবিতায় কিন্তু প্রেম-বিরহকে উপস্থাপন করেছেন একটু ভিন্ন ধারায় সচরাচর প্রেম কাব্য যে ধরনের শব্দ ব্যবহার করা হয়, সেই জাতীয় শব্দ বা ভাব সচেতনভাবেই এড়িয়ে গেছেন যেমন- ভুল তত্ত্ব, সোনা ঝরা প্রেী, বেলা বোস, কোন এক ক্ষণে ইত্যাদি।


চলমান সমাজে নানা ধরনের অবক্ষয় কবি’কে নানাভাবেই ভাবিয়েছে, অরবক্ষয় রোধে পাঠকের মনে চেতনা তৈরী করার একটা সচেতন প্রয়াস তার কবিতায় লক্ষ্য করা যায় বরাবরই, প্রতিবাদমূখর বেশ কিছু কবিতাও স্থান পেয়েছে গ্রন্থে যেমন- কাল রাত তিনটায়, অনাদায়ী যৌতুক, সততার রঙ ফিকে ইত্যাদি।


কবি পরিচিতিতে আমরা দেখেছি, কোয়ান্টাম মেথড তার জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, কোয়ান্টাম দর্শন তিনি লালন করেন মন ও মগজে, তারই কিছু প্রভাবে তার কবিতায় প্রতিফলন দেখা যায়। কোয়ান্টামে মানবতার দর্শন এবং মানবমুক্তির জন্য যে পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া থাকে তারই কিছু কাব্যিকরূপ তার কবিতাও দেখা যায় প্রচ্ছন্নভাবে।


আরেকটি বৈশিষ্ট্য দেখা যায়, পাঠকের সাথে কবি যেন খুব বেশি যোগাযোগ রাখতে চান, সব সময়ের জন্যই রাখতে চান, পাঠক যেন কোনভাবেই কবিতাকে দুর্বোধ্য, জটিল, ব্যকরন নির্ভর ইত্যাদি ভাবনা দ্বারা নিজেকে দূরে সরিয়ে না রাখেন, বরং, পাঠক কবিতার সাথে নিজেকে কিভাবে জড়িয়ে রাখবেন, প্রতিদিনের দেখা বিষয়গুলোই মনে দোলা দেবে সে চেষ্টাই করেছেন।


সবশেষে, তথাকথিত আধুনিক সভ্যতার বাতাসের ছোঁয়ায় অনেকেই নিজের দেশ, নিজের ভাষা, নিজের সংস্কৃতিকে নিয়ে নানাভাবে অসম্মান করতে শিখেছে, তারই প্রতি ইঙ্গিত করে কবি তীর্যক সমালোচনা করেছেন নিঃসঙ্কোচে যেমন- ব্যাকডেটেড বাংলা।


জীবনের নানা দিকে, নানা প্রান্তে, নানা শ্রেনীতে “ডুব সাঁতার” দিয়েছেন কবি, চেষ্টা করেছেন মণি-মুক্তা কুড়িয়ে আনতে, সে অর্থে গ্রন্থের নামকরনও সার্থক হয়েছে বলেই মনে হয়েছে।


কবি’র জন্য রইলো অফুরান শুভেচ্ছা।