(নোটঃ সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হয়ে গেল বাংলা কবিতা আসরের “আন্তর্জাতিক কবি সম্মেলন-২০২২” এর আসর, কাথি, মেদেনীপুরে গত আগষ্ট ১৪, ২০২২ তারিখে। উক্ত অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ থেকে আমার অংশগ্রহনের সুযোগ হয়েছিলো। সেখানেই কবি’র সাথে পরিচয় এবং এই কাব্যগ্রন্থটি কবি’র নিজ হাত থেকেই গ্রহন করি। উল্লেখ্য, তখনই মনে মনে ঠিক করে রেখেছিলাম, কবিতাগুলো পড়ার পর, পুরো গ্রন্থের উপর একটি আলোচনা/রিভিউ লিখবো।)


কবি শ্যামল কুন্ড জন্মগ্রহন করেছেন নৈহাটি, ভারত। কবিতার সাথে তার আত্মিক যোগযোগ দীর্ঘদিন থেকেই, জেলার গন্ডি ছাড়িয়ে ইতোমধ্যে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তের ছোট পত্রিকাতে তার বেশ কিছু কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। তিনি সাহিত্য পত্রিকার যুগ্ম সম্পাদনার পাশাপাশি আবৃত্তিতে তালিম নিচ্ছেন যা তার কবিতার পরিসরকে এক অনন্য মাত্রা দান করেছে। দীর্ঘ সাতাশ বছরের সাহিত্য চর্চায় জীব্নে প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে কবি বার বার ফিরে এসেছেন কবিতার কাছে। আর সেই কবিতাগুলোকেই একত্রিত করে প্রকাশিত হলো কবির দ্বিতীয় একক কাব্যগ্রন্থ “প্রতিটি উচ্চারণ থেকে জন্ম”। কবি শ্যামল কুন্ডু বাংলা কবি ও কবিতার আসরের সাথে সংযুক্ত আছেন  ৬ বছর ২ মাস এবং আসরের পাতায় ইতোমধ্যে ১০৭টি কবিতা প্রকাশ করেছেন।


তার একক কাব্যগ্রন্থ “প্রতিটি উচ্চারণ থেকে জন্ম” নিয়েই বুক রিভিউ। কাব্যগ্রন্থটি ২০১৮ সালে প্রকাশ করেছে পূর্ণ প্রতি্মা প্রকাশনী, কোলকাতা।  কাব্যগ্রন্থটিতে ৩১টি কবিতা স্থান পেয়েছে।


প্রতিটি উচ্চারণ থেকে জন্মঃ কবি শ্যামল কুন্ড দীর্ঘ কবিতা লিখতে অভ্যস্ত এবং পছন্দ করেন। তার ৬৪ পৃষ্ঠার কাব্যগ্রন্থে ৩১টি কবিতা সংকুলান হয়েছে, গড়ে প্রতিটি কবিতা ২-৩ পৃষ্ঠা। কাব্যগ্রন্থটি শুরু হয়েছে একটি দীর্ঘ কবিতা দিয়ে, শিরোনাম “ তোমাকে দেখেছি” দিয়ে, কবিতাটি নেতাজী সুভাস স্মরণে লেখা। নেতাজীর অমর কীর্তি, তাকে ঘিরে রাজনৈতিক কুটকৌশল, দ্বিজাতি তত্ত্বের ভারতবর্ষ, নেতাজীর স্বপ্নের ভারতবর্ষ ইত্যাদি বিষয়াদি ইতিহাসের আলোকে অকপট স্বীকারোক্তি। বাংলা ভাষার প্রতি তার মমতা এবং প্রেম চিত্রায়িত হয়েছে “ প্রণামি একুশে ফেব্রুয়ারী” কাব্যে, যেখানে রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে, কাজী নজ্রুল, লালন ফকিরের বাংলা ভাষায় সাহিত্য চর্চা এবং ভাষা শহীদদের প্রতি প্রনাম দিয়ে শেষ হয়েছে।


কাব্যগ্রন্থের দীর্ঘ কবিতাগুলো পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল-মূলত দীর্ঘকবিতা একটি পাওয়ারফুল ফিনিংসের ভেতর রিয়ালিটি দাবি করে। সেই সাথে দাবি করে বিস্তীর্ণ জীবনবাদী ক্যানভাস, যা থাকে উপন্যাসে্র ভেতর কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, দীর্ঘ কবিতায় উপন্যাসের প্লট ও আখ্যান থাকবে। উপন্যাস দীর্ঘ আখ্যানের আলোকে যে জীবন জিজ্ঞাসার জন্ম দেয়, দীর্ঘ কবিতা আখ্যানহীনতার আলোকে সেই জীবন জিজ্ঞাসাকে উন্মোচন করতে সক্ষম। দীর্ঘকবিতা সব সময়ই গীতিকবিতার বিষয়গত ও পরিমানগত সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করতে ইচ্ছুক। দীর্ঘকবিতা অনুসন্ধান করে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমাজ, পরিবেশ, সমকালীন পারিপার্শিকতা, নিসর্গ প্রকৃতি তথা উদার ক্যানভাসে ব্যক্তি চৈতন্যের মুক্তি।


পুরো গ্রন্থ জুড়েই কবি’র প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধমুখী কন্ঠ উচ্চারিত হয়েছে নানা ভাবে নানা শিরোনামে যেমন- হেরে যাওয়ার লড়াই, যুন্ধ এখনো থামেনি, স্বাধীনতা, দেশটা অন্য হয়ে গেল, জয় আসবে মানুষের, এসো একসাথে জয়ী হই ইত্যাদি কাব্যে।


সমাজ ভাবনা কবি’কে নানাভাবে বিষন্ন করেছে, তীব্র প্রতিবাদী করে তুলেছে, আবার কখনো সমাজ সচেতন মানুষের কাছে নানামুখী প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন, অবলীলায়। এ কোন সমাজ ?  ওরা কারা ? অবক্ষয়, আমরা দেখাই দিশা ইত্যাদি কাব্য তার জলন্ত স্বাক্ষর।


দীর্ঘ কবিতায় অনভ্যস্ত পাঠকের মাঝে মাঝেই খেই হারিয়ে ফেলার  উপক্রম সবার কিছুটা সম্ভাবনা তো থেকেই যায়। কবি শ্যামল কুন্ডের কাব্য মূলত সিরিয়াস টাইপের পাঠকের মনোযোগ দাবী করে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে বর্তমান বিশ্ব, প্রিন্ট বুক পাঠকের সংখ্যা কমিয়ে দিয়েছে এবং মনোযোগের ক্ষেত্র খন্ড বিখন্ড করে দেয়ার আক্রমন চালিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। এমনিতেই আধুনিকায়নের পতাকের নীচে বসবাস করে পাঠকের সংখ্যা দিন দিন হ্রাস পাচ্ছিল এবং কবিতা পাঠকের ক্ষেত্রে এই চিত্রটা আরো ভয়াবহ, ফলে দীর্ঘ কবিতার পাঠকের সংখ্যা নিতান্ত কম হবে, এটাই রূঢ় বাস্তবতা ।


গ্রন্থটির প্রচ্ছদ এঁকেছেন রাজচীপ পুরি, যিনি কবিতার বক্তব্যকে নিজের মানষপটে ধারন করেই প্রচ্ছদ অংকনে মনোযোগ দিয়েছিলেন বলেই মনে হয়েছে। প্রচ্ছদ যেন, নিজেই একটি কবিতা, নিজেই অনেক কিছু বলার যোগ্যতা রাখে।


কবি’র জন্য রইলো শুভেচ্ছা এবং পরবর্তী কাব্যগ্রন্থ প্রকাশনার জন্য আগাম অভিনন্দন।