আলোচনা  ২০৯


বাবুই পাখিরে ডাকি বলিছে চড়াই,
কুঁড়ে ঘরে থেকে কর শিল্পের বড়াই,
আমি থাকি মহা সুখে অট্টালিকা পরে,
তুমি কত কষ্ট পাও রোদ-বৃষ্টি-ঝড়ে,


বাবুই হাসিয়া কহে-সন্দেহ কি তাই,
কষ্ট পাই তবু থাকি নিজেরই বাসায়,
পাকা হোক তবু ভাই পরের বাসা,
নিজ হাতে গড়া মোর কাঁচা ঘর খাসা’


কবি রজনীকান্ত সেনের কবিতাটি এখনো মানুষের মনে পড়ে। সেই ছোটবেলায় পড়েছিলাম, ভুলে গিয়েছিলাম, আলোচ্য কবিতার আলোচনা লিখতে গিয়ে আবার খুজে বের করে পড়লাম। ছোটবেলায় অনেক কবিতাই পড়েছিলাম কিন্তু সেগুলো অনুভব করিনি তখন, সেই একই কবিতা যখন এখন পড়ি, ভিন্ন এক মাত্রা পাই, অনুভব করি কবিতার বক্তব্য, স্পর্শ করে লাইনে লাইনে লুকিয়ে থাকা নানা জীবন দর্শন। কবি মোঃ সিরাজুল হক ভূঞা  আবার সেই হারিয়ে যাওয়া ইস্যু নিয়ে লিখলেন “বাবুই পাখির গর্ব”।


একসময় যে পাখিকে নিয়ে লিখা হয়েছে কবিতা, সেই বাবুই পাখির অস্তিত্ব আজ হুমকির মুখে। দিন দিন হারিয়ে যেতে বসেছে বাবুই পাখি ও তার বাসা। এসব বাসা শুধু শৈল্পিক নিদর্শনই ছিল না, মানুষের মনে চিন্তার খোরাক জোগাত এবং আত্মনির্ভরশীল হতে উৎসাহ যোগাতো। কালের বিবর্তনে ও পরিবেশে বিপর্যয়ের কারণে আজ এ পাখিটিকে আমরা হারাতে বসেছি। যে পাখি নিয়ে এতো কবিতা, এতো আলোচনা, সে সম্পর্কে কিছু ধারনা রাখলে ক্ষতি কি?


অতি সুলভ দর্শন পাখি এরা, এদের গায়ের রং হলুদ ও খয়েরিতে মিশানো। অনেকটা চড়ুই পাখির মতো দেখতে তবে এদের আকার ও রং বিচিত্র অনেকটা বেশি।। এদের সঙ্গে জড়িত রয়েছে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যের ব্যাপার-স্যাপারও। অনেক গান, কবিতাও রচিত হয়েছে এ পাখি নিয়ে। গ্রামেগঞ্জে কিংবা মফস্বল এলাকায় ব্যাপকভাবে নজরে পড়ে এখনো। দলবদ্ধভাবে বাস করে বাবুই পাখি। সারাদিন চেঁচামেচি করে কাটায়। সামান্যতেই রেগে যায়। নিজেদের মধ্যে কোলাহল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। পাখিটা অতি সহজে কারো দৃষ্টিতে না পড়লেও ওদের বাসাটা ঠিকই সবার নজর কাড়ে। তাল, নারকেল কিংবা খেজুর গাছে সারিবদ্ধভাবে ঝুলতে দেখা যায়। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য! এ পাখির বাসা বানানোর কৌশল রীতিমতো বিস্ময়কর বটে। সুনিপুণ কারিগর বলা যায় এদের। প্রজনন সময় ঘনিয়ে এলে পুরুষ পাখি খেজুর, নলখাগড়া, নারিকেল অথবা তালপাতার পাশ থেকে চিকন লম্বা অংশ ঠোঁট দিয়ে কেটে নেয়। অতঃপর সেটি বয়ে নিয়ে পূর্বনির্ধারিত গাছের পাতার সঙ্গে সেলাই করে জুড়ে দেয়। এভাবেই বাসা তৈরির সূত্রপাত ঘটায়। তারপর ওই বিন্দুকে কেন্দ্র করে তৈরি করে বলয়। বলয়ের চারপাশটা চিকন পাতা দিয়ে সেলাই করে চোঙ্গাকৃতির বাসা বানায়। নিজস্ব শৈল্পিকগুণে তৈরি করে দৃষ্টিনন্দন বাসা। বাসার ওপর-নিচ থাকে খানিকটা সরু আর মধ্যখানটা থাকে মোটাসোটা। বাসার মুখ থাকে নিচের দিকে। বাসা তৈরি হলে স্ত্রী পাখি ডিম পেড়ে তা দিলেও পুরুষ পাখি থাকে অন্য ধান্ধায়। পরকীয়ায় আসক্ত হয়ে পড়ে। এ পাখির বাসা এতই মনোমুগ্ধকর যে, মানুষ তাদের ড্রইংরুমে ঝুলিয়ে রাখতে গর্ববোধ করেন। ঝুলিয়ে রাখে নামিদামি আবাসিক হোটেলগুলোতেও। বলা যায় অনেকটা শোপিসে পরিণত হয়েছে এদের বাসা।


এ পাখির বাংলা নাম: ‘বাবুই’, ইংরেজি নাম: ‘বায়া উইভার’ (Baya weaver), বৈজ্ঞানিক নাম: ‘প্লসিয়াস ফিলিপপিনাস’ (Ploceus philippinus), গোত্রের নাম: ‘পাসেরিদি’। অঞ্চলভেদে ‘বাউই’ নামেও পরিচিত।আফ্রিকাতে হলুদ রঙের বাবুই পাখির দেখা মেলে। সারাবিশ্বে বাবুই পাখি ১১৭ প্রজাটির। দক্ষিন এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ, ভাতর,নেপাল ও পাকিস্থান ছাড়া অন্য কোথাও দেখা যায় না।


কবি মোঃ সিরাজুল হক ভূঞা তার কবিতায় বাবু পাখি কেন আমাদের গর্ব, কেন আমরা গর্ব অনুভব করি বা করা উচিৎ তার ব্যখা এবং প্রমান দিয়েছেন পাখিটির বাসা বানানোর কৌশল থেকে আরম্ভ করে বিস্তারিত ধারাবাহিকভাবে। কবিতায় অল্প কিছু লাইনের মাধ্যমে আস্ত এক প্রবন্ধ লিখে ফেলেছেন। কোন  সাংবাদিক এই কথাগুলো নিয়েই ৪-৫ পৃষ্ঠার একটা আর্টিকেল লিখে ফেলতেন। কবি’র কাব্যগুন এবং মেধা এখানে প্রকাশিত হয়েছে তার নিজ গুনেই, পুরো একটা ৪-৫ পৃষ্ঠার আর্টিকেলকে কাব্যরূপে প্রকাশ করেছে অল্প কথায় এবং সহজ বোধ্য ভাষায়।


কবি, শুরুতেই বর্ননা দিয়েছেন, বাবুই পাখি কোথায় বাসা বাঁধে, কেমন করে তৈরি করে, তার আর্কিটেকচারাল ডিজাইন কেমন, কিভাবে তৈরি করে, কর্মী বাহিনীতে কারা থাকে ইত্যাদি ইত্যাদি। এর সাথে যোগ করেছেন, কিছু বিশেষন, “শিল্পগুণে থাকে ঠাসা”, “শিল্পে ঠাসা বাসাগুলো”,। এখানে বাবুই পাখির শিল্পগুন এবং শিল্প নৈপুণ্যের প্রতি ফোকাস করেছেন। নিজেদের জন্য বাসা তো অনেক পাখিই তৈরী করে কিন্তু বাবুই পাখির বাসা নিয়ে কেন এতো উচ্ছাস, এতো মনোমুগ্ধকর চাহিনি... একটাই কারন বাবুই পাখির শিল্পগুন, শিল্প মেধা এবং শৈল্পিক রূপকল্প। কবি সেটা পূর্নাংগভাবে প্রকাশ করতে কৃপনতা করেনি একটুও।


নিরাপত্তা নিয়ে মানুষ যেমন সারাক্ষন অস্থির থাকে, পাখি সমাজেও নিরাপত্তা ভাবনা তাদের আক্রান্ত করে। বাবু পাখি তাদের এতো নৈপুণ্যে তৈরী করার বাসা নিয়ে নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তা করে, কোথায় বাসা বাঁধনে নিরাপত্তার ঘাটতি হবে না, বাসার কাছাকাছি খাদ্যের সংস্থান হবে কি না, অর্থাৎ বাসার নিরাপত্তা এবং খাদ্য নিরাপত্তা একই সাথে ভাবতে হয় তাদের, কবি’র বর্নানায় সে বিষয়টিও ফুটে উঠেছে।


মোটামুটি পুরো কবিতা পড়ার পর, বাবু পাখিদের জীবন বৃত্তান্ত জানা যায়। বিশেষ করে বাবু পাখিদের বাসা তৈরির শিল্প নৈপুণ্যের বিষয়টি চোখের সামনে ভাসে ওঠে। অনেকদিন পর, কবি আবার আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন বাবুই পাখিদের কথা।


কবি’র জন্য রইলো শুভেচ্ছা।