আলোচনা  ২২২


বিবেক, আদর্শ, মানবতা, নৈতিকতা …ইত্যাদি শব্দগুলোর কোন তল খুঁজে পাই না। শব্দগুলো কোয়ালিফাই করা হয় কিভাবে? ব্যক্তির নিজস্ব অবস্থান নাকি সামষ্টীক কোন অবস্থান আছে? “পৃথিবীতে সত্য বলে কিছু নেই, সকল সত্যই অর্ধ সত্য”, একমাত্র মৃত্যু ছাড়া (এখন পর্যন্ত)। মৃত্যু ছাড়া অন্য কিছুতেই পৃথিবীর ৬০০ কোটি মানুষ একমত পোষন করে না। থাকে মতভেদ, মতবিরোধ।


কিছু ঘটনা খুব বেশি নাড়া দেয়, কিছুগুলো সহনশীল পর্যায়ে থাকে আবার কিছুগুলো নিত্যদিনে অভ্যাসে সংস্কৃতির অংশ হয়ে যায়, কিন্তু সবগুলোই “বিবেকের লেন্সে” একইভাবে নাড়া দেবার কথা কিন্তু দেয় না।  এর সাথে আরো কিছু শব্দ যোগ হলে, নৃশতা, বিভৎসতা… আমাদের আরো বেশি নাড়া দেয়। “বিবেকের মৃত্যু হয়েছে”, মানে  বিবেক ছিলো কোন এক সময়, মানব সভ্যতার কোন সময়টাকে আমারা  “বিবেক ছিলো” বলে ধরে নিতে পারি? আছে এমন কোন সময় ? যুদ্ধবাজ রাষ্ট্রগুলো প্রতিনিয়ত লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা করছে, নৃশংসভাবে খুন করছে-একপক্ষ সমর্থন করছে, অন্যপক্ষের বিবেককে আঘাত করছে। তাহলে, বিবেক আসলে একটা পক্ষ-বিপক্ষের ব্যাপার। বাংলাদেশ কিংবা অন্য কোন স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় লক্ষ লক্ষ মানুষ হত্যা হয়েছে (এখনো হচ্ছে কোথাও কোথাও), লক্ষ নারী ধর্ষন হচ্ছে কিন্তু বিশ্বের সবাইকে একইভাবে নাড়া দিচ্ছে না, সব কবি সাহিত্যকদেরও নাড়া দিচ্ছে না।


সাযুজ্যতাবোধ (ethnocentrism) বলে একটা শব্দ আছে, অর্থাৎ নিজের ভাবনা চিন্তাকে বড় মনে করা, নিজেকেই সঠিক মনে করা, অন্যেরটা নাকচ করে দেয়া। প্রায় সকল মানুষই “সাযুজ্যতাবোধ” বোধ দ্বারা আক্রান্ত থাকে অন্তত সব সময় না হলেও কিছু সময় তো বটেই। আমরা সবাই মূলত সাযুজ্যতাবোধ সম্পন্ন মানুষ (ethnocentric)। এর থেকে বেরোতে পারলেই মানবতাবোধকে সংরক্ষন করা যাবে এই ধারনা থেকেই, মানুষকে “সাযুজ্যতাবোধ” থেকে নিজেকে মুক্ত করার পরামর্শ দেয়া হয়ছে। সাযুজ্যতাবোধ (ethnocentrism) এর বিপরীতে নুতন ধারনার উদ্ভয় হয়েছে, যাকে বলে সংস্কৃতির ভিন্নতা (Cultural Relativism)  অর্থাৎ ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতিকে সম্মান জানানো, ভিন্ন ভিন্ন জনপদের চর্চা, রীতিকে সম্মান জানোনোর মধ্যে দিয়েই “সাযুজ্যতাবোধ” দূর হবে এবং তখন বিশ্বমানবতা প্রতিষ্ঠিত হবে।


তখন কিছু প্রশ্ন সামনে আসলো-


সকল সংস্কৃতির ভিন্নতাকে যদি মেনে নেয়া হয়, তাহলে পৃথিবীতে ভালো-মন্দ বলে কোন বিষয় থাকবে না। এক সংস্কৃতিতে যেটা “ভালো” বলে বিবেচিত হবে, অন্য সংস্কৃতিতে সেটা “ভালো” বলে বিবেচিত নাও হতে পারে, সেটা “মন্দ” ভাবা হতে পারে, চরম ঘৃনার বিষয়ও হতে পারে। যেমন- আফ্রিকায় জেনিটাল মিউটিলেসন (নারীদের খতনা) তাদের সংস্কৃতির অংশ, ভারতে মেয়ে শিশুর ভ্রূণ হত্যা দীর্ঘদিনের চর্চা, স্বামীর মৃত্যুর সাথে স্ত্রীর সহমরন… ইত্যাদি, সংস্কৃতি এবং নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠির দীর্ঘদিনের চর্চা এবং রীতি। ফলে সংস্কৃতির ভিন্নতা (Cultural Relativism) দিয়ে সমস্যার সমাধান করা যাচ্ছে না। তখন নুতন আরেকটি তাত্ত্বিক কাঠামো আসলো সংস্কৃতিক ভিন্নতার যৌক্তিকতা (Rational Cultural Relativism)।


তাত্ত্বিক প্রেক্ষাপট আলোচনা করার একটা কারন হলো, বিবেক, আদর্শ, মানবতা, নৈতিকতা …ইত্যাদি শব্দগুলো কবিতায় ঘুরেফিরে নানাভাবে আসে, একজন কবি নানাভাবে প্রভাবিত হয়। তাত্ত্বিক প্রেক্ষাপটের লেন্স মাথায় থাকলে, কবিতায় বক্তব্য ফুটে তোলা সহজ হয়।


আলোচ্য কবিতা একটা ঘটনার বিস্তারিত বর্ননা এবং প্রতি পদক্ষেপে নৃশতার মাত্রা বর্ননা করা হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন থাকে, একটি মাত্র ঘটনা যখন আমাদের বিবেককে নাড়া দেয় প্রবলভভাবে তখন একই রকম ঘটনার সংখ্যাধিক্য হলে আর সেভাবে নাড়া দেয় না কেন? বিবেকের বোধ কি বিশালতার মধ্যে হারিয়ে যায়? তবে কি বিবেকের মধ্যে ক্ষুদ্রতা বসবাস করে এবং বিশালতা হারিয়ে যায়? বিবেকের মৃত্যু কি ক্ষুদ্রতার মাধ্যমে বলা যায় নাকি বিশালতার মধ্যেও বিবেকের মৃত্যু হয়?


কবিতায় একটি মৃত্যর ঘটনা নিয়ে ধাপে ধাপে “বিবেকের  মৃত্যু” প্রবাহিত হয়েছে, নিঃসন্দেহে এটি বিবেককে নাড়িয়ে দেয়ার ক্ষমতা রাখে কিন্তু ঘটনায়, বিবেকের সচলতা লক্ষ্য করা যায়নি বলেই “বিবেকের মৃত্যু” বলা হয়েছে। এখানে “বিবেকের মৃত্যু” বলাটা যৌক্তিক নাকি “বিবেকের অবক্ষয়” বলাটা যৌক্তিক সে প্রশ্ন থেকেই যায়। মৃত্যু হলে তো আর ফিরে আসার সম্ভাবনা থাকে না কিন্ত অবক্ষয় হলে সেটা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা যেতে পারে।


কবিতাপাঠে, পাঠকের মনে আরো কিছু প্রশ্নে আসে সমান্তরাল ভাবেই। বিবেকের প্রশ্ন কি কেবল “কোন মৃত্যু” ঘটনাকে কেন্দ্র করেই হবে নাকি সমাজের আরো কিছু অন্যায়, অত্যাচারের ক্ষেত্রে ও “বিবেকের মৃত্যু” শব্দ ব্যবহার করা যাবে যেমন-ঘুষ সংস্কৃতি, ঘুষকে কেন্দ্র করে কি “বিবেক” এর চাকা চলমান থাকবে? অন্যকে ঠকানো, অত্যাচার, নিপীড়ন, শোষন… এসব অন্যায় যখন মেনে নেয়া হয়, তখন কি “বিবেকের মৃত্যু” বলতে পারি?


ফলে, বিবেক একটু বৃহৎ প্রেক্ষিতকে ধারন করে, যদিও আলোচ্য কবিতায়, একটি মাত্র প্রেক্ষাপটে লিখা হয়েছে, তাতে কোন সমস্যা নেই কিন্তু একজন পাঠক হিসেবে কবিতাটি পড়তে গিয়ে “বিবেক” এর বৃহত্তর ক্যানভাসটি চোখের সামনে ভাসছিল।।


খুবই স্পর্শকাতর একটি প্রেক্ষিত নিয়ে কবিতাটি রচনা করার জন্য রইলো শুভেচ্ছা।