[গতবছর, ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর ৭ তারিখে বাংলা কবিতা-কবি ও কবিতার ওয়েবসাইট এর সদস্য হয়েছিলাম এবং প্রথম কবিতা প্রকাশ করেছিলাম, এক বছর পূর্ণ হোল আজ। এক বছর পূর্তিতে আজ প্রকাশিত হোল ৩০০তম কবিতা এবং ১০০তম কবিতার উপর আলোচনা]


আলোচনা ১০০


আমরা ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে যাবার পরে, প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবার পরে, নিজের বাবা মায়ের প্রতি কে কতটুকু দায়িত্ব পালন করি তা প্রশ্ন সাপেক্ষ। কেউ বাবা মায়ের প্রতি দায়িত্ব, কর্তব্য ভুলে যায় অভাবে আবার কেউ স্বভাবে। কোন অর্থেই বাবা মায়ের প্রতি কর্তব্য পালন ভুলে যাওয়া গ্রহণযোগ্য নয়। প্রতিটি ধর্মেই বাবা মায়ের প্রতি কর্তব্য পালনকে অনেক বেশী গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। কেউ কেউ আবার কোন ধর্মেই বিশ্বাসী নয় কিন্তু মানবতার পতাকা উড়ায়, মানবতাবোধ সম্পন্ন কোন মানুষের কাছ থেকেও বাবা মায়ের প্রতি অমানবিক আচরণকে স্বীকৃতি দেয় না। কেই যদি অন্তত একবার নিজের ছোটবেলায় বাবা মায়ের ভুমিকা মনে রাখতে পারে, তাহলে আর কোনভাবেই অমানবিক হওয়া সম্ভব নয় কিন্তু আমরা অনেকেই প্রতিষ্ঠিত হই কিন্তু মানুষ হয়ে উঠি না। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে উলটো চিত্রও আছে। বাবা-কে কেন্দ্র করে সন্তানের অপূর্ণ থাকা ইচ্ছেগুলো কিভাবে দহন তৈরি করছে তারই এক চিত্ররায়ন এই কবিতা।


কবি জি,এম, হারুন-অর-রশিদ তার কাব্য “বাবা’কে ধার দিবেন প্রভু’তে এক হৃদয় বিদারক চিত্র এঁকেছেন খুব যত্ন সহকারে। বাবা’র প্রতি সন্তানের যা যা করা দরকার কিংবা মনে মনে যা যা করতে চেয়েছিল তা করা হয়নি নানা কারনে, অনেকটাই অভাবের কারনে। সারাজীবন বাবা নিজে যা যা সেক্রিফাইস করে সন্তানের জীবনকে পরিপূর্ণ করে দিয়েছিল, সন্তান সেগুলোই পূরণ করার ইচ্ছে পোষণ করেছিল কিন্তু তার আগেই বাবা চিরদিনের জন্য সবাইকে ছেড়ে চলে যান, লুকিয়ে থাকা মনের ইচ্ছেগুলো ইচ্ছেই থেকে যায়, মনের গহীনে আটকে থাকা কষ্ট নিয়ে সন্তান ঈশ্বরের কাছে আবেদন করে বাবা’কে ফিরিয়ে দেয়ার অন্য অন্তত অল্প কিছুদিনের জন্য হলেও, ঈশ্বরের কাছে আবদার করে বাবা’কে নিয়ে তার অপূর্ণ ইচ্ছেগুলো পূর্ণ করবে বলে।  মৃত্যুর পর মানুষ আর ফিরে আসে না, ফিরে আসার কোন সম্ভবনাই নেই তারপরও সন্তান ঈশ্বরের কাছে আবেদন করে। কাল্পনিকতার রঙ দিয়ে কবিতায় সন্তানের ভেতরের তোলপাড় করা কষ্টগুলোকে কবি বাইরে বের করার চেষ্টা করেছেন, পাঠকের মাধ্যমে সকল সন্তানের কাছে একটি বার্তা পৌছাতে চেয়েছেন, সন্তান যেন বাবা মা বেঁচে থাকাকালীন সময়েই সম্ভাব্য সব কিছু করার চেষ্টা করেন, বাবা মা’কে একবার হারা্লে সারাজীবন আফসোসের আর সীমা থাকে না ।


সন্তান প্রভুর কাছে মৃত বাবাকে সাতদিনের জন্য ফিরে পাবার জন্য আবেদন করে, নিদেন পক্ষে ধার চায় বাবাকে সাত দিনের জন্য। এই সাত দিন বাবার জন্য কি করবে, বাবার সাথে কিভাবে সময় কাটাবে, বাবার মাধ্যমে কিভাবে মা’কে খুশি করবে তারই বিবরণ এই কবিতায়। সাতদিন পর বাবাকে ফিরেয়ে দেবার অঙ্গিকার করে ঈশ্বরের কাছে। বাবাকে নুতন পোষাকে দেখতে চায়, ফিরে আসার দিন যদি বাবা ভাল পোষাকে আসে তাহলে মা খুব খুশী হবে এই ভেবে। বাবা সারাজীবন সংসারের খরচের চাপে কোনদিন ভাল কোন কাপড় পরতে পারেনি, মা ও বঞ্চিত হয়েছে বাবাকে ফিটফাট দেখা থেকে। সব স্ত্রী-ই তার স্বামীকে খুব সুন্দর পোষাকে ফিটফাট স্মার্ট দেখতে চায় কিন্তু মায়ের সে সৌভাগ্য হয়নি কোনদিন, তাই মায়ের জন্য ঈশ্বরের কাছে আবেদন করে।


সন্তান ঈশ্বরের কাছে আবেদন করে বলে, একদিন বাবাকে নিয়ে শিশু পার্কে বেড়াতে যাব যেখানে তাদের অনেক স্মৃতি  জমা আছে কেননা বাবা’র সামর্থ্য ছিল না অন্য কোথাও নিয়ে যাবার, এখন সন্তানের সামর্থ্য হয়েছে কিন্তু বাবাকে নিয়ে সেই স্মৃতিময় জায়গাতেই যেতে চায়। এই সাত দিনে অনেক কিছু করার মধ্যে বাবাকে নুতন স্যুট কিনে দিতে চায়, বাবার অনেক দিনের ইচ্ছে ছিল নুতন এক সেট স্যুট কিনবে, নানা অনুষ্ঠানে তাকে যেতে হত কিন্তু অর্থের অভাবে, সন্তানের চাহিদা মিটিয়ে আর নুতন স্যুট কেনা হয়নি কোনদিন। মা মাঝেই মাঝেই তাকে কথা শোনাত পুরনো স্যুট পড়ে সব জায়গায় যেতে হত বলে, কিন্তু বাবা বারবার সান্ত্বনার বাণী শোনাত কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাবার জীবদ্দশায় আর নুতন স্যুট কেনা হয়নি। সন্তান নুতন স্যুট কেনার মধ্য দিয়ে একই সাথে বাবা মা দুজনকেই খুশী করার জন্য বাবা’কে ফেরত চান ঈশ্বরের কাছে। বাবা প্রায় বলতো সবাইকে নিয়ে একদিন ভাল কোন হোটেলে যাবে খেতে, খুব সাধারন একটি চাওয়া কিন্তু তাও পুরন হয়নি, এরকম অনেক ছোট ছোট ইচ্ছেগুলো বাবা পুরন করতে পারেনি অর্থের অভাবে। আজ সন্তান বাবা’র সেই ইচ্ছেগুলোই পুরন করতে চায়, এখন সন্তানের সামর্থ্য আছে কিন্তু বাবা কাছে নেই অথচ একসময় বাবা ছিল কিন্তু সামর্থ্য ছিল না। বাবা অনেক দিন পরিকল্পনা করেছিল সবাইকে প্লেনে করে নিয়ে যাবে সমুদ্রের কাছে কিন্তু অর্থাভাবে সেও ইচ্ছেও পুরন হয়নি। তাই বাবা ফিরে আসলে একদিন বাবা মা সহ সবাইকে প্লেনে করে সমুদ্র দেখার ইচ্ছেও পোষণ করে ঈশ্বরের কাছে।


এভাবেই এগিয়ে চলে কবিতা, বাবার সব অপূর্ণ ইচ্ছেগুলো পুরন করার অঙ্গীকার করেই ঈশ্বরের কাছে বাবাকে ফিরে পাবার আবদার করে সন্তান।  বাবার হাত ধরে হাটতে যাবে যেমনটা বাবা ছোটবেলায় হাত ধরে রাখতো, বাবাকে ফাঁকি দিয়ে কত অন্যায় কাজ করেছে, সব স্বীকার করে ভারমুক্ত হবে...... কবি শেষটা করেছেন, আর বাবাকে ফিরে যেতে দেবে না এই ইচ্ছে ব্যক্ত করে। কেবল, বাবা মা হারিয়ে গেলেই তার মুল্য বোঝা যায়, তাই সন্তান আর বাবাকে হারাতে চান না। একটি কাল্পনিক চিত্রের মাধ্যমে কবি পাঠককে আবেগ আপ্লুত করেছেন, মনোজগতে বাবা মায়ের মুল্যকে চিরস্থায়ী করে দিতে চেয়েছেন। অসাধারন এক কবিতা উপহার দেয়ার জন্য কবির প্রতি রইলো অভিনন্দন এবং শুভেচ্ছা।