আলোচনা ৮২


বিশ্বব্যাপী নারীর জীবন ও শরীরকে কেন্দ্র করে যুগে যুগে চলছে নানা কুসংস্কার। আফ্রিকা, এশিয়া, ল্যাটিন আমেরিকা, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া এমনকি বিশ্ব মোড়ল এবং তথাকথিত মানবতার পতাকার আলোয় আলোকিত খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও নারীর জীবন কেন্দ্রিক কুসংস্কার থেকে মুক্ত হতে পারেনি। যুগে যুগে এবং দেশ ভেদে কুসংস্কারের ধরন পাল্টেছে, আদল বদলে গেছে কিন্ত কুসংস্কারের আড়ালে নারী নির্যাতন একই আছে। তাই কবি তার কাব্যের শিরোনাম করেছেন “কুসংস্কারের বিশ্বযুদ্ধ”, যথার্থই শিরোনাম। শুধুমাত্র শিরনামই একটি কবিতা হতে পারে, দুটি শব্দের আড়ালে লুকিয়ে আছে হাজার বছরের কান্না, লক্ষ কোটি নারীর বেদনা, আছে হাজার হাজার সমাজপতির “কুসংস্কার”কে ঘিরে নিজেদের ফায়দা লোটার নির্মম কাহিনী।


মুলত ‘সংস্কার’ এবং ‘কুসংস্কার” দু’টি ভিন্ন শব্দ দ্বারা একটি সমাজ বা গোষ্ঠীর আচার আচরণ, সংস্কৃতি এবং সামগ্রিক জীবন ব্যবস্থার পরিচয় পাওয়া যায়।  সংস্কার শব্দ দিয়ে প্রচলিত আচার পদ্ধতি যা বংশ পরম্পরায় এবং স্বতঃস্ফূর্ত আবেদনের মাধ্যমে পরিচালিত হয় এবং অকল্যাণকর দিক খুব একটা থাকে না। সংস্কার এর সাথে কু যোগ করে হয়ে যায় ‘কুসংস্কার’ অর্থাৎ সংস্কার রুপান্তরিত হয় ‘কুসংস্কারে” যা মানব জীবনে কল্যান বয়ে আনে না। মুলত কুসংস্কার পরিচালিত হয় ধর্মীয় গোঁড়ামি এবং অশিক্ষার আড়ালে, কিছু চতুর লোক, সমাজপতি কিংবা প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ তাদের নিজের স্বার্থ হাসিলের জন্য সমাজে নানা ধরণের ‘কুসুংস্কার’ ছড়িয়ে দেয় এবং ধর্মান্ধ মানুষ তার বিশ্বাসে গেঁথে নিয়ে চর্চা করতে থাকে বিনিময়ে স্বার্থ হাসিল করে নেয় কথিত ব্যক্তিবর্গ, অনেকাংশে এ ধরণের কুসংস্কার দেখা যায় নারীর শরীরকে ভোগ করার নিমিত্তে কিংবা নারীকে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করার জন্য কিংবা নারীর উপর আধিপত্য বিস্তার করার জন্য।


কবি সৈকত পাল (নীরব দুপুর) তার কাব্য “কুসংস্কারের বিশ্বযুদ্ধ” মুলত এই প্রেক্ষাপটকে ঘিরেই তার বক্তব্য সাজিয়েছেন।দেখিয়েছেন, অদৃশ্য এক শক্তি (সমাজপতি/ মোড়ল) কিভাবে নারীকে ভোগ করার নিমিত্তে, নারীকে অবদমিত করে রাখার নিমিত্তে ‘কুসংস্কার’ এর আশ্রয় নেয়, কিভাবে নারীর দেহে ‘ডাইনি’ সীলমোহর  একে দেয়, “কখনো কালো মেয়েটির বুকের উপর  পড়ছে ডাইনির সীলমোহর”।  আবার নারীর শরীর ভোগের ক্ষেত্রেও ঋতুস্রাবের সময় ‘গঙ্গাজল’ ছিটিয়ে পবিত্র করে নেয়ার ‘কুসংস্কার’ বজায় রাখে,“কখনো ঋতুস্রাবের রক্তে তিলক কাটছে একদল ঝাঁকড়া নগ্নতা। দোষ নেই! দোষ নেই!গঙ্গা জল ছিটানো বস্তুর মতো এসবে একটুও দোষ নেই”


শুরুতে বর্ণিত প্রেক্ষাপট অনুযায়ী, নারী যখন বেঁচে থাকার আর্তনাদ করে, নিজের দাবী উত্থাপন করে কিংবা ঈশ্বরের কাছে মুক্তির জন্য প্রার্থনা করে, তখন সমাজপতিদের গদি কেঁপে উঠে, নারী তার ছলা কৌশলের বাইরে চলে যাচ্ছে, নারীকে অবদমিত করে রাখার সুযোগ হারাচ্ছে ফলে কৌশলে ‘কুসংস্কার’ ছড়িয়ে দেয় সমাজে, হুঙ্কার তোলে বিধবা নারী না্না বিধিনিষেধে তাই কবি লিখেছেন- “ন্যাপকিন আটকানো শরীর মন্দিরের সোপানে পা রাখে। কিংবা বিধবার হাত যদি কোনো শুভ জিনিস ছুঁয়ে ফেলে”।


সবশেষে বিবেকবান পাঠকের কাছে সামাজিকতা, সংস্কার, কুসংস্কার, আধুনিকতা, মানবিকতা ইত্যাদিকে ঘিরে সমাজ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের জন্য ‘কুসংস্কারের বিরুদ্ধে বিশ্বযুদ্ধ”র আবেদন রেখে শেষ করেছেন, “অন্ধকারের জিভের তলায় বেঁচে থাকা হায় রে সামাজিকতা!আধুনিকতার সাথে কুসংস্কারের বিশ্বযুদ্ধ এখনো শেষ হলো না ......”


কবির জন্য রইলো অভিনন্দন, খুব সুন্দর একটি বিষয় নির্বাচন করার জন্য।