শিরোনাম দেখে অনেকেই শুরুতে ভাবতে পারেন, ডোপামিন এক ধরনের হরমোন, যেটা শরীর বিজ্ঞান সম্পর্কিত ইস্যু, সেটা নিয়ে বাংলা কবিতার আসরে আলোচনা কেন? এখানেই, সাধারনভাবে অনেকেই ভুলটা করে ফেলেন, শরীর বিজ্ঞানকে, সমাজ বিজ্ঞান থেকে আলাদা করা যায় না, করা উচিত না, জোড় করে আলাদা করা যেতে পারে কিন্তু আখেরে ফল ভালো হয় না।


সাধারনভাবে চিকিৎসা বিজ্ঞানকে 4D Model (Disease, Diagonosis, Doctor and Drug) দিয়ে দেখা হয় কিন্তু একজন নৃবিজ্ঞানী হিসেবে সারাজীবন আমি এর ঘোর বিরোধীতা করে এসছি। চিকিৎসা বিজ্ঞানের সাথে Social Determinants’ গুলো সংযুক্ত করতে না পারলে চিকিৎসা বিজ্ঞানের সর্বোচ্চ রেজাল্ট পাওয়া যাওয়ার সম্ভাবনা কম। কিন্তু আমরা ভুলটা করি, 4D Model ই আমাদের কাছে মূখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায়, আদতে মডেলটি হওয়া দরকার ৪D&SD। আবার ডায়াবেটিক যেটা প্রায় সার্ব্জনীন রোগ, সেক্ষেত্রে 3D Model (Daily life, Diet, Drug) খুবই কার্যকরী, শুরুতে দৈনন্দিন জীবনযাপন প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রন করা এবং সবার শেষে ড্রাগ কিন্তু আমরা করি উলটোটা। যে কারনে শরীরবৃত্তীয় বিষয়গুলো সমাজ জীবনের সাথে সংযুক্তি দরকার খুব বেশি।


একজন কবি’র ভাবনা বৃত্ত সমাজের বাইরের কিছু নয়, সমাজ, সংস্কৃতি, চর্চা, স্বাস্থ্য, শরীরবৃত্তিয় কার্যক্রম...নানাভাবে তাড়িত করে।


মানবদেহে যে চারটি হরমোন আনন্দ বা খুশিভাব উৎপন্ন করার জন্য দায়ী তার একটি হল ডোপামিন (dopamine)। বাকিরা হলো,
১। এন্ডোরফিন (endorphin)
২। সেরোটোনিন (serotonin)
৩। অক্সিটোসিন (oxitocin)


এই চারটি জৈব রাসায়নিক যারা হরমোনের মত কাজ করে, তাদের প্রত্যেকের কর্মপদ্ধতি আলাদা। এটি সাধারণত আমাদের আনন্দদায়ক অনুভূতিগুলির পেছনে প্রধান কারণ হিসাবে কাজ করে। আমাদের সার্বিক মুড(mood) বা মনের ভাবকে কিংবা মুড সুয়িংকে নিয়ন্ত্রণ করে ডোপামিন। আবেগ বা উত্তেজনায় আমরা কিভাবে সাড়া দেব, তাও ডোপামিন নিয়ন্ত্রণ করে। ডোপামিনকে কখনো 'feel-good'  হরমোন বলা হয়। যে কাজে পুরস্কার লাভের সম্ভাবনা আছে সেই কাজ করার প্রেরণা যোগায় ডোপামিন। যেমন একজন ছাত্র জানে যে ভালো করে পড়াশোনা করলে পরীক্ষায় ভালো ফল হবে। সেখান থেকে ভালো চাকরি হবে। ভালো চাকরি হলে সে ভালো বাড়ি, মনের মত গাড়ি, শখের জিনিস এসব কিনতে পারবে। তাই তাকে পড়াশোনা করতে প্রেরণা যোগায় ডোপামিন। ডোপামিন এর প্রভাবকে তাৎপর্যপূর্ণ করে আমরা তৃপ্তির আস্বাদ পাই। আরো ভালো করে কাজ করার প্রেরণা পাই। বলতে গেলে, ডোপামিনেরই অনুপ্রেরণায় আমরা ঝুঁকিপূর্ণ কাজেও নিজেকে নিযুক্ত করি।  


মানবদেহে ডোপামিন এর একটি নির্দিষ্ট মাত্রা থাকে আবার এর মাত্রা কোনো কারণে স্বাভাবিকের থেকে কম বা বেশি হতে পারে। কম হলে সেই ব্যক্তি নিদ্রাহীনতা, অবসাদ বা পার্কিনসন্স ডিজিজে ভুগতে পারেন আবার ডোপামিন দরকারি মাত্রার চেয়ে বেশি হলে তা স্কিজোফ্রেনিয়ার মত কঠিন মানসিক ব্যাধির কারণ হতে পারে।


কয়েকটি উদাহরন দেয়া যাক-
ডোপামিন এর কারনে মানুষ সব সময় উৎফুল্ল থাকতে চায়, যে কাজে মন আনন্দ পায় সেই কাজগুলোই বার বার করতে চায় এবং উত্তোরত্তোর বাড়াতে চায় অন্যদিকে প্রয়োজনীয় কাজগুলো থেকে ডোপামিন নানাভাবে ভুলিয়ে ভালিয়ে করা থেকে বিরত রাখে।


ফেসবুকে, “লাইক বাটন” পেলে খুশি হয়, প্রথমে ২০/৩০টি লাইক পেলে খুশি হয়ে ডোপামিন বেড়ে যায় ফলে পরের দিন “লাইক” সংখ্যা আরো বাড়াতে চায়, পরের দিন আরো, আরো... ফলে প্রয়োজনীয় এবং গুরুত্তপূর্ণ কাজ থেকেও পিছিয়ে যায়। কিন্তু যদি  উল্টোভাবে “ডিসলাইক বাটন” থাকতো এবং এর সংখ্যা বেশি হতো ফলে তার ডোপামিন কমে যেতো তখন সে আর ফেসবুকমুখী হতো না। এই বিজ্ঞানটাই ফেসবুকে ব্যবহার করা হয়েছে, সেখানে কোন “ডিসলাইক বাটন” নেই। কিন্তু ইউটিউবে “ডিসলাইক বাটন” আছে কারন সেটা ভিজিউয়াল মোড হওয়ার কারনে ডোপামিন এর হ্রাস হতে সময় লাগে।


আবার একজন স্মোকার এর ক্ষেত্রে, সিগারেট খেলে তার আত্মতৃপ্তি জন্মে, ডোপামিন বেড়ে যায় তখন আরো বেশি তৃপ্তির জন্য কিছুক্ষন পর আরেকটি সিগারেট ধরায়। একটি সিগারেট খাওয়ার পর যে তৃপ্তি পায় এবং ডোপামিন বেড়ে যায় সেটা দীর্ঘক্ষন পর কমতে থাকে, ডোপামিন কমে যাওয়ার ফলে তাকে তৃপ্তি বাড়ানোর জন্য, ডোপামিন বাড়ানোর জন্য আবার সিগারেট খেতে হয়। এটাই বিজ্ঞান।


এ রকম আরো উদাহরন দেয়া যায় আমাদের দৈনন্দিন জীবন থেকে (শপিং করা, প্রেমিকের সাথে বেহুদাই ঘন্টার পর ঘন্টা সময় ব্যয় করা ইত্যাদি ইত্যাদি)


বাংলা কবিতার আসরে, এই ডোপামিন কিভাবে কাজ করে??


একজন কবি তার কবিতার উপর মন্তব্য পেলে খুব খুশি হয় (মন্তব্য যেমনই হউক), মন্তব্যের সংখ্যা বেশি হলে সে আরো বেশি খুশি হয়, পরের দিন সে আরো বেশি মন্তব্য আশা করে কারন তার ডোপামিন বেড়ে গেছে। ডোপামিন, মন্তব্যের গুনগত মান নিয়ে চিন্তিত হয় না, আগের দিনের চেয়ে সংখ্যা বেড়ে গেছে এতেই ডোপামিন তার মনে আনন্দ সৃষ্টি করে, সে অনেক বেশি উৎফুল্ল থাকে।


মন্তব্যের ঘরে, দারুন, খুব ভালো লেগেছে, অসাধারন... জাতীয় মন্তব্যে, ডোপামিন মোটেই চিন্তিত হয় না কারন, কে্ন দারুন হয়েছে? কেন ভালো লেগেছে? কেন অসাধারন বলে মনে হলো?? ইত্যাদি প্রশ্নের উত্তর মন্তব্যকারী হয়তো নিজেও জানেন না। মন্তব্যকারি কি কবিতাটি পড়েছেন নাকি না পড়েই মন্তব্য করেছেন সেটা বোঝারও কোন উপায় নেই। ফলে ডোপামিন এই জটিল প্রক্রিয়ায় যেতেই আগ্রহী হয় না। সংখ্যা বাড়ানোই যেহেতু ডোপামিন এর মূল গন্তব্য ফলে সে নানা উপায়, নানা ফন্দি বের করবে ডোপামিন এর মাত্রা ঠিক রাখার জন্য। যেনতেন ভাবে একদিনে অনেক সংখ্যাক অন্যের কবিতায় মন্তব্য দিলে কিংবা কপি পেষ্ট করে মন্তব্য দিলে অল্প সময়ে অনেক বেশি মন্তব্য দেয়া যাবে, বিপরীতে মন্তব্যপ্রাপ্ত কবিও মন্তব্যকারীর কবিতায় মন্তব্য করবেন, এটা একটা অতি সাধারন ভদ্রতাও বটে। এক ধরনের “ রিসিপ্রোক্যাল বা বিনিময় প্রথা” বলা যেতে পারে।


ডোপামিন সম্পর্কিত এই ব্যাখা বিশ্বাস না হলে, ‘ডিসলাইক বাটন” প্রচলন করে দেখা যেতে পারে কিংবা কতগুলো মন্তব্য আসলো তার পরিসংখ্যান দৃশ্যমান না করেও দেখা যেতে পারে, রেজাল্ট কি দাঁড়ায়?


একইভাবে, উলটোভাবে ডোপামিন এর হতাশা দেখা যায়। আলোচনার পাতায়, মন্তব্যের সংখ্যা খুব কম থাকায় (নাই বললে অতুক্তি হয় না), ডোপামিন এর মাত্রা কমে যেতে থাকে, ফলে আলোচক কিছুদিন পর উধাও হয়ে যান, কিছুতেই তার ডোপামিন এর মাত্রা বাড়ানো যায় না, সে আর এতে আনন্দ খুজে পায় না। অন্যদিকে, আলোচনার পাতায় মন্তব্য করতে একটু কষ্ট করতে হয়, দীর্ঘ লেখা পড়তে হয়, ফলে যে পরিমান কষ্ট করে, সময় ব্যয় করতে হয়, আনুপাতিক হারে সে পরিমান আনন্দ পাওয়া যায় না। তারচেয়ে অনেক কম কষ্ট করে , কবিতার পাতায় মন্তব্য করে তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি আনন্দ পাওয়া যায় এবং সম্ভাবনাও বেশি থাকে, ডোপামিন তাই পাঠককে সেদিকেই তাড়িত করে।


অনলাইন ভিত্তিক প্রায় সব প্ল্যাটফর্মগুলোই মূলত ডোপামিন এর খেলা। ডোপামিনকে যতো বেশি নিয়ন্ত্রন করা যাবে, তার পাঠক সংখ্যা, লাইক সংখ্যা, ভিউয়ার সংখ্যা...ততোই বাড়তে থাকবে।


তাহলে আমাদের এখন করনীয় কি??? কিছু আছে ?