অনেকের মুখেই শুনি, বেশ গর্ব করে বলে থাকেন, নিজের টাকায় কবিতার বই প্রকাশ করি না, করতে চাইও না। আমি নিজের টাকায় কবিতার বই প্রকাশ করি, এজন্য আমাকে তিরস্কার করতে ছাড়েন না। কবিতার বই প্রকাশ হবে প্রকাশকের টাকায়, তাহলে তার কাব্য প্রতিভার জানান দেয়া হবে, লোকে তাকে কবি বলে চিনবে, কবি বলে সম্মোধন করবে, বেশ একটা কবি কবি ভাব থাকবে, এটাই প্রচলিত ধারনা। অন্যদিকে নিজের টাকায় কবিতার বই প্রকাশ করলে, কাব্য প্রতিভার প্রমান মেলে না। তাহলে দ্বন্দ্ব তৈরি হয় কিভাবে?


•একজন কবি তার কাব্যগ্রন্থ নিজের টাকায় প্রকাশ করতে চান না,
•পাঠক নিজের টাকায় কবিতার বই কিনতে আগ্রহ পোষন করেন না (সৌজন্য কপি পেলে পড়লেও পড়তে পারেন-এরকম একটা ভাবনা মাথায় থাকে)
•প্রকাশক নিজের টাকায় কবিতার বই প্রকাশ করতে চান না (তিনি ব্যবসায়ী মানুষ, টাকা বিনিয়োগ করেন, লাভ না হউক অন্তত বিনিয়োগের টাকা উঠে আসার সম্ভাবনা না থাকলে তেমন বই প্রকাশে ইচ্ছুক থাকেন না)


তাহলে উপায়? কাব্য চর্চা কি থেমে থাকবে? প্রযুক্তির কল্যাণে একটা উপায় বের হয়েছে। এখন অনেক অন-লাইন পোর্টাল আছে, সেখানে বিনামূল্যে কবিতা প্রকাশ করা যায়, একজন কবি, তার কাব্য চর্চা চালিয়ে যেতে পারেন অনায়াশেই। ফেস বুক এর কল্যানে প্রচুক “লাইক দেয়া” নামক পাঠক পাওয়া যায় বিনা খরচেই (শুধু ডাটা কেনার টাকা খরচ করতে হয়)।


একজন কবি, কাব্য চর্চার বাইরে অন্যান্য মানুষের মতোই দৈনন্দিন জীবনাচরনে থাকেন, পারিবারিক জীবন যাপন করেন। দৈনন্দিন সকল উপকরন কেনার জন্য খরচ করেন, নিজে কিংবা অন্যদের নিয়ে হোটেলে খাবারের পর বিল দেন, জামা কাপড় কেনেন, সিনেমা দেখেন, শখের জিনিস কেনেন, সামর্থ্য থাকলে ফ্ল্যাট কেনেন, গাড়ি কেনেন, দেশে বিদেশে ঘুরতে যান...সবই করেন নিজের টাকায়। শধুমাত্র নিজের বই প্রকাশ করতে প্রকাশকের টাকা দরকার হয়। তখন তিনি নিতান্তই দরিদ্র মানুষরূপে আত্মপ্রকাশ করেন। অন্যসব কাজ নিজের টাকায় করতে পারেন শুধু বই প্রকাশ করতে পারেন না। নিজের টাকায় বই প্রকাশ করলে তার আত্মহংকারে বাধে, তার প্রতিভার ঘাটতি দেখা দেয়।


আবার পাঠক, দিনে ৩০০ টাকায় ১ প্যাকেট বেনসন সিগারেট খেতে পারেন কিন্তু বছরে ২০০ টাকায় একটা কবিতার বই কিনতে পারেন না, তখন তার সৌজন্য কপি চাই, অন্যথায় তার সম্মান থাকে না, কবি বন্ধুরা তাকে এক কপি বই সৌজন্য সংখ্যা দেয়নি, এতে তার সম্মান হানি হয়। ৩০০০ টাকায় শাড়ি কিনতে পারেন, ৩০০ টাকায় টিকেট কেটে সিনেমা দেখতে পারেন, ডিনারে ৫০০০ টাকা খাবারের বিল দিতে পারেন শুধু ২০০ টাকায় একটি কবিতার বই (কিংবা অন্যান্য বই) কিনতে পারেন না।  কবি এবং পাঠক  উভয়েই প্রকাশকের টাকার দিকে চেয়ে থাকেন।


প্রকাশক, তিনি একজন পুরো দমের ব্যবসায়ী, অন্যান্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মতোই এটা একটা ব্যবসা। একজন প্রকাশকের কাছে একটি বইয়ের যতোটা সাহিত্য মূল্য থাকে তারচেয়ে বেশি থাকে তার ব্যবসায় মুনাফার চিন্তা (খুব অল্প কিছু প্রকাশক বাদ দিয়ে, এই উপসংহার টানাই যায়)। ফলে, প্রকাশক মুনাফার সম্ভাবনা না দেখলে সেখানে টাকা বিনিয়োগ করতে চাইবেন না সেটাই স্বাভাবিক। উপন্যাস, ছোটগল্প বিনিয়োগ করা যেতে আরে সেখানে পাঠক তুলনামূলকভাবে বেশি এবং পাঠক নিজের টাকাতেই বই কেনেন। কিন্ত কবিতা !! অহ মাই গড, ২০০ টাকায় ১০০টি কবিতার একটি বই কিনবো?? টাকাটাই অপচয় হলো!!!! কবিতা কেন টাকা দিয়ে কিনে পড়তে হবে? কবিতা পড়বো বিনা মূল্যে (অবশ্য যদি পড়ার সময় হয়), এরকম একটি পাঠক মানষিকতায়, প্রকাশক কেন কবিতায় বই প্রকাশে বিনিয়োগ করবেন? অবশ্য হেলাল হাফিজ এর মতো বিখ্যাত কবি হলে ভিন্ন কথা। একবার বিখ্যাত হয়ে গেলে আর পেছনে তাকাতে হয় না কাউকে, কবি এবং প্রকাশক উভয়েই থাকেন নিশ্চিন্তে। আবার কেউ কেউ অন্য কোন ক্ষেত্রে (অভিনয়, কন্ঠ শিল্পি ইত্যাদি) বিখ্যাত হবার পর কবিতা লিখতে শুরু করেন, তার বই প্রকাশ করতেও প্রকাশকের কোন সমস্যা হয় না, হবার কথাও না। বিখ্যাত ব্যক্তি যে কবিতাই লিখুক, সেটা পাঠক প্রিয় হয়, তার কবিতার গুনে হয় না, সে অন্য ক্ষেত্রে জনপ্রিয় বা বিখ্যাত , সেই জনপ্রিয়তারা জোরে তার কবিতার বইও পাঠক প্রিয় হয়, এটাই বাস্তবতা।


তাহলে, এই পুরো বাস্তবতায়, একজন কবি কি নিজের টাকায় কবিতার বই প্রকাশ করবে? যদি তার সক্ষমতা থাকে, কেন নয়?


পাঠক কেন, কবিতার বই ফ্রি পেতে চায়?
পাঠকের ভাবনায় একজন কবি’র জীবনাচরন কেমন? পাঠক ভাবে-


একজন কবি মানেই, ছন্নছাড়া জীবনে অভ্যস্ত, তার খুব বেশি খাবার দরকার হয় না, একটা ঝোলা ব্যাগ, স্ত্রি বিহীন কাপড় হলেই জীবন চলে, সময় জ্ঞান থাকে না, এখানে সেখানে ঘুরে বেড়ানো তার কাজ, তার কোন উচ্চাকাংক্ষা নেই, উচ্চাশা নেই, তার জীবনে কোন প্রতিযোগীতা নেই, তার চাওয়া পাওয়া এবং হারানোরও কিছু নেই, তিনি অতি-সাধারন/অসাধারন একজন মানুষ, তিনি যা লেখেন তার জন্য কোন কষ্ট করতে হয় না, চর্চা করতে হয় না, কোন পরিশ্রম তো নেইই, তিনি চায়ের স্টলে বিল দেন না (সাথে থাকা অন্যরা বিল দেয়), তিনি থ্রী স্টার কিংবা ফাইভ স্টার হোটেলে যাবার প্রয়োজন অনুভব করেন না, তার গাড়ি দরকার হয় না, তিনি হেটে হেটে সব জায়গায় যেতে পারেন...... এরকম একটি মনঃছবিতে কবি’র বই, কবিতার বই কেন টাকা দিয়ে কিনতে হবে???


কবি বা কবি সমাজ নিজেদের কিভাবে উপস্থাপন করেন?


ঢাকা শহরে অনেক সংগঠন আছে, অনেক ধরনের আছে, সামাজিক সংগঠন, সাহিত্য বিষয়ক সংগঠন, অঞ্চলভিত্তিক সংগঠন, রাজনৈতিক কিংবা ছায়া রাজনৈতিক সংগঠিন, পেশাভিত্তিক সংগঠন ইত্যাদি। এতো এতো সংগঠন, কিভাবে চলছে? তাদের সাংগঠনিক কাঠামো এবং অর্থনৈতিক সক্ষমতা কেমন?


আমরা কেউ কেউ একাধিক সংগঠনের সাথে জড়িত, নানা ধরনের অভিজ্ঞতা আমাদের আছে। আমি নিজেও কয়েক ধরনের সংগঠনের সাথে জড়িত। এই সমস্ত সংগঠনগুলোর বিভিন্ন কর্মকান্ড, অনুষ্ঠানে যাওয়ার সুযোগ হয়। সাহিত্য বিষয়ক সংগঠনগুলোর সাথে অন্যান্য সংগঠন গুলোর আনুষ্ঠানিকতা কিংবা আয়োজনের পরিপক্কতার ক্ষেত্রে স্পষ্ট পার্থক্য দেখা যায়। যে কোন সংগঠন চালাতে নূন্যতম হলেও অর্থের প্রয়োজন হয় এবং হবেই, সে হিসেব করেই সংগঠনের যারা নেতৃত্ব দিয়ে থাকেন তারা প্রস্তুতি নেন।


সাহিত্য বা কবিতা চর্চা বিষয়ক সংগঠনগুলো (কোন কোনটি) অর্থের সংকটে থাকে বেশ জোড়ালো ভাবেই ফলে তাদের আয়োজনে একটা দারিদ্র্যতার ছাপ দেখা যায়। এই ভাবনার পেছনে কি থাকে-


•যারা কবিতা লিখেন, তাদের অর্থনৈতিক সক্ষমতা কম
•কবিতা বা সাহিত্য সংগঠনে চাঁদা ধার্য থাকা মানেই ধবংসের বীজ বপন করা (এখানে স্পষ্ট প্রশ্ন এসে যায়, যারা কবিতা লিখেন তাদের মধ্যে কি প্রফেশনালিজম থাকে না? তারা কি অর্থনৈতিক হিসেব পরিচালনার সক্ষমতা রাখেন না? তারা কি নিজ নিজ জীবিকায়নের/কর্মক্ষেত্রে প্রফেশনালিজম এর স্বাক্ষর রাখেন না?)
•এ জাতীয় সংগঠনে অনেক ছাত্র/ছাত্রী/চাকুরী খোজা মানুষ… ফলে চাঁদার ব্যাপারটা তাদের জন্য বাড়তি চাপ
•সাহিত্য অনুষ্ঠানের জন্য জাকজমকতার প্রয়োজন হয় না, খুব সাদা মাটা হলেই হয়।
•সাহিত্য সংগঠন করতে অর্থের প্রয়োজন হয়  না / ফান্ড গঠনের দরকার পরে না ( বাতাস ভর্তি চিপস কেনার মতো, কথার চাতুর্থ দিয়েই সংগঠন চলে)
•তাৎক্ষনিকভাবে ফান্ড সংগ্রহ করেই অনুষ্ঠান চালানো যায় ফলে স্থায়ীভাবে অর্থনৈতিক ভিত্তি তৈরী করার দরকার পরে না।


এ জাতীয় ভাবনার মাধ্যমে, সমাজে একজন কবি বা কবিদের সংগঠন সম্পর্কে আমরা কি ম্যাসেজ দিয়ে থাকি? কবি মানেই দুর্বল প্রকৃতির মানুষ, কবি মানেই অর্থনৈতিক বিষয়াদি পরিচালনা করতে অক্ষম,  কবি মানেই জাকজমকতা পরিহার করতে হবে? জাকজমকতা কবিদের মানায় না, কবি মানেই নিরীহ গোবেচারা টাইপের মানুষ হবে? কবি মানেই অন্যদের থেকে পিছিয়ে থাকবে? কবি মানেই, পৃথিবীর বা সমাজের পেছনের মানুষ, বাইরের মানুষ, কবি মানেই সাংগঠনিকভাবে সামনে থাকার অযোগ্য? কবি মানেই ভাবালুতায় ভরপুর থাকবে? কবি মানেই উস্কোখুস্কো চুল নিয়ে ঘুরে বেড়াবে?


আমরা যারা কবিতা লিখি, কবিতা চর্চা করি, আমরা নিজেরাই যখন নিজেদের সম্পর্কে এরকম একটা ধারনা পোষন করি তখন অন্যরা কবি সম্পর্কে উপরে বর্নিত ধারনা পোষন করবে তাতে আর আশ্চর্য হবার কি আছে?


বিশ্বব্যাপী  এলোপ্যাথি চিকিৎসা ব্যবস্থার সাথে, হোমিও চিকিৎসা ব্যবস্থা পিছিয়ে থাকার এটাই একমাত্র কারন। দুটোই বিজ্ঞান সম্মত চিকিৎসা পদ্ধতি কিন্তু এলোপ্যাথি ব্যবস্থা নিজেদের অবস্থান জানান দিয়ে থাকে জোড়ালোভাবে কিন্তু হোমিওব্যবস্থায় অন্ধকার ঘরে, টিমটিম করে আলো জ্বলে, ভাঙা চেয়ার, নোংরা পরিবেশ... এভাবেই চলছে হাজার বছর ধরে, মানুষের মনোজগতে হোমিও চিকিৎসা সম্পর্কে এরকম একটা ছবি ভাসে, ফলে মানুষ সেভাবেই বিচার করে।


শুধুই কবিতা লিখেন, কবিতাই তার পেশা এরকম মানুষ তো নেই (দুয়েকজন জন থাকতে পারে), যিনি কবিতা লিখেন তিনিই আবার নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে, নিজ নিজ পেশায় একজন কর্মঠ, একজন যোগ্য, একজন দারুন উদ্দ্যমী ব্যক্তিত্ব। কিন্তু সেই একই মানুষ যখন কবিতার আসরে আসেন, তখন তিনি, দরিদ্র্য, হীনমন্য,  সক্ষমতার অভাব... এরকম একটা ক্যানভাসে থাকেন। তিনি তখন সময় জ্ঞান রাখেন না, যখন ইচ্ছে আসেন, তিনি তখন নৈতিকতা মানেন না কেননা তাহলে তার লেখক স্বাধীনতা নষ্ট হয়। যে মানুষ অফিসে, আদালতে, শিক্ষকতায়, ব্যবসায় দারুন এক উদ্যমী মানুষ তিনিই আবার একজন কবি হিসেবে সবচেয়ে অপরিনামদর্শী, ইনডিসিপ্লিন মানুষ হিসেবে প্রকাশিত হন।


একজন সক্ষমতায় ভরপুর, চির তরুন মানুষকে তথাকথিত “কবি ইমেজ” এর মাধ্যেমে তাকে ভাঙাচুরা, কুজো হয়ে থাকা, পেছনে সারিতে থাকা, হেলে দুলে চলা একজন মানুষ হিসেবে সমাজে পরিচিত করে তুলি আমরা নিজেরাই, আমরা যারা কবিতা চর্চা করি, তারাই। ফলে সমাজের অন্যান্যরা আমাদের সেভাবেই বিচার করে।


তাহলে, মৌলিক প্রশ্ন হলো, আমরা আমাদের কিভাবে দেখতে চাই? আমরা নিজেরা আমাদের ইমেজ সমাজে কিভাবে প্রতিফলিত করতে চাই?