(নোটঃ আন্তর্জাতিক কবি সম্মেলন-২২ সম্পন্ন হয়ে গেল গত ১৪ আগষ্ট ২০২২ সালে, মেদেনীপুর, কাথি’তে। আয়োজনে, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা কবিতার আসর। সেখানে এই আলোচনাটি শুরু করেছিলাম)


উপন্যাস কি ? প্রবন্ধ কি ? ছোট গল্প কি ? এমন প্রশ্ন সচরাচর শোনা যায় না কিন্তু কবিতা কি? এ প্রশ্ন যেন শেষই হতে চায় না, কতজন কতভাবে এর উত্তর দিয়ে থাকে কিন্তু একজনের উত্তর অন্যজনের পছন্দ হয় না, তিনি আবার নুতন করে উত্তর দিয়ে থাকেন, তার নিজের ভাবনা থেকে। কবিতাকে ঘিরে রয়েছে নানা রহস্য, সন্দেহ, ধোয়াটে ভাব, রুক্ষতা, অস্থিরতা, ভালোবাসার প্রকাশ, প্রতিবাদ প্রতিরোধ কিংবা বিদ্রোহের নানা প্রকাশ ইত্যাদি। কবিতাকে ঘিরে রয়েছে নানামত, নানা বিভাগ, রয়েছে ব্যকরণের কঠিন দিক নির্দেশনা, কেউ মেনে চলেন কেউ বা মানতেই চাচ্ছেন না। আবার কেউ কবিতার ব্যাকরণ ছাড়া কবিতাকে গ্রহন করতেই চাচ্ছেন না। এতো সব পরেও কবিতা চলছে তার আপন গতিতে, চলছে নানা তর্ক বিতর্ক।


কবিতা কি এ নিয়ে বিতর্ক চলতে থাকুক। আমি ভাবছি, কবি তার কবিতার মাধ্যমে কিভাবে পাঠকের সাথে যোগাযোগ করে থাকেন? এটা কি সঠিক বা কার্যকরী যোগযোগ হয়? কেমন করে হয়? একজন কবি এবং অন্যান্য বিষয়ে অভিজ্ঞ ব্যক্তির কথা বলার ধরন বা লেখার মধ্যে পার্থক্য কোথায়? ধরা যাক-


কবি লিখলেন- “হাত থেকে ফসকে পড়ে গেল চাঁদ”


অর্থনীতিবিদ- অপরচুনিটি কষ্ট (opportuity cost)- একই কথা ভিন্নভাবে, ভিন্ন শব্দে বলছেন


উন্নয়ন কর্মী- সুযোগ হাতছাড়া (missed opportunity)- একই কথা ভিন্নভাবে, ভিন্ন শব্দে বলছেন


প্রবাদ- সময়ে এক ফোঁড়, অসময়ে দশ ফোঁড় (প্রায় একই বক্তব্য)


গার্জিয়ান (বয়োজ্যাষ্ট)- সময়ের কাজ সময়ে করতে হয় (প্রায় একই বক্তব্য)


একই বক্তব্য (প্রায় একই বা কাছাকাছি) ভিন্ন জন ভিন্নভাবে বলছেন। শেষের চার জন বলছেন, অনেকটাই পরামর্শ, উপদেশ, নির্দেশ মুলক কিন্ত কবি বলছেন, মোলায়েম, শ্রুতিমধুর, কাব্যিক ঢঙয়ে। একই কথা কবি বলেন-দৃশ্যমান, শ্রব্যমান, ঘ্রাণানুভূতিক, স্পর্শানুভুতিক এবং স্বাদানুভূতিলিপ্ততার সাথে। কবিতায় থাকে বাকপ্রতিমা, রূপক, উপমা, সাদৃশ্য ইত্যাদি, এর মাধ্যমে একই কথাকে কাব্যময়তার রূপ দেয়া দেয়। পাঠককে ভিন্ন এক অনুভুতির জগতে নিয়ে যাওয়া হয়।  আরো একটি উদাহরন দেয়া যাক-


পথে হল দেরি, ঝ’রে গেল চেরি,
দিন গেল বৃথা প্রিয়া;
তবুও তোমায় ক্ষমাহাসি বহি
দেখা দিল আজেলিয়া
-------(কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)


“পথে হল দেরি”, “ঝ’রে গেল চেরি”, “দিন গেল বৃথা প্রিয়া” কতকগুলি বাকসমষ্টি। পথে হল দেরি হওয়ার মধ্যে,  চেরি ফুল ঝরার মধ্যে আছে বেদনা, কিংবা ব্যর্থতাও। এই প্রত্যেকটি  বাকসমষ্টি যে খন্ড খন্ড রূপ নির্মান করেছে, তারা আবার ভিন্ন ভিন্ন ধর্মী চিত্ররূপও নির্মানকারী। পথে দেরি হওয়ায় এবং বৃথা দিনপাতে একটি তীব্র ভাবানুভূতিক বেদনা কাজ করছে। আবার চেরি ফুলের পতনে আছে দৃশ্যনুভূতি (একই সঙ্গে বেদনার মিশ্রন)। এবার, “তোমার ক্ষমার হাসি বহি”, “দেখা দিল আজেলিয়া”, দুটো চিত্রই দৃশ্যানুভূতিক, অন্যদিকে ফুলের সঙ্গে একটু গন্ধানুভূতি্রও সম্পর্ক রয়েছে, ঝরে পরা চেরি ফুলের মধ্যে এবং হাসির মধ্যে আছে শব্দানুভূতির সুখ (মৌন হাসির সুখ) অর্থাৎ কবিতা/কাব্য সৃষ্টিতে দেখা যায় ইন্দ্রিয় নির্ভর কলা কৌশল । আবার ইন্দ্রিয় অনুভূতি থেকে অতীন্দ্রিয় বা ইন্দ্রিয়াতীত  রাজ্যে প্রবেশ করানোর কৌশল দেখা যায় কোন কোন কবিতায় যেমন-


আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার
পরাণ সখা বন্ধু হে আমার
    ------(কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)


গদ্য এবং কাব্যের মধ্যকার পার্থক্য করতে গিয়ে সুধীন্দ্রনাথ দত্ত বলেন-


“গদ্যের অবলম্বন বিজ্ঞান, কাব্যের অন্বিষ্ট প্রজ্ঞান। তাই গদ্য চলে যুক্তির সঙ্গে পা মিলিয়ে আর কাব্য নাচে ভাবে তালে তালে; গদ্য চায় আমাদের স্বীকৃতি আর কাব্য খোঁজে আমাদের নিষ্ঠা, রেখার পর রেখা টেনে পরিশ্রান্ত গদ্য যে ছবি আঁকে, গোটা দুয়েক বিন্দুর বিন্যাস কাব্যের যাদু সেই ছবিকেই ফুটিয়ে তোলে আমাদের অনুকম্পার পটে। কাব্য এই মরমী ব্রতে সিদ্ধি আসে প্রতীকের সাহায্যে। শব্দ মাত্রেরই দুটো দিক থাকে, একটা তার অর্থের দিক অন্যটি তার রসপ্রতিপত্তির দিক। গদ্যের সঙ্গে শব্দের সম্পর্ক, চিন্তার আধার কিন্তু কাব্য আবেগবাহী”।
---------সুধীন্দ্রনাথ দত্ত


কাব্য রচনার ক্ষেত্রে অনুভূতির খেলা ছাড়াও থাকে রূপক(Metaphor), উপমা(Simile) এবং সাদৃশ্য/অনুকরণ(Analogy)-এর ব্যবহার, যা অজানাকে জানতে সেতুবন্ধন হিসাবে কাজ করে এবং সংশোধন ও সংযোগ শক্তিশালীকরণের মাধ্যমে বিদ্যমান জ্ঞান, জটিল বা বিমূর্ত ধারণা বা পদ্ধতিগুলির ব্যাখ্যা সহজ করে তোলে। কবিতায় রূপকের আশ্রয় ভাব প্রকাশের শক্তিশালী হাতিয়ার। কবিতায় রূপক, উপমা এবং সাদৃশ্য শব্দ তিনটি খুবই কাছাকাছি ও পরস্পরের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক নিয়ে অবস্থান করে এবং রূপকালংকারের মধ্যে উপমা(Simile) ও সাদৃশ্য(Analogy) অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কারণে একটির সাথে আরেকটি মিলিয়ে ফেলার সাধারণ বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। অথচ, রূপক, উপমা এবং সাদৃশ্য তিনটি শব্দের মধ্যে নির্দিষ্ট পার্থক্য রয়েছে।


“রূপক বা Metaphor”, হলো একটি বক্তব্য যেখানে একটি জিনিস ব্যবহার করে অন্য অর্থ বোঝানো হয় এবং একাধিক বিষয়ের মধ্যে তুলনা করা হয়। এক কথায় ‘রুপক’ হলো একটি জিনিস বা কিছুর অন্য মানে। যেমন-  "সে একজন মানুষের সেল হয়ে গেছে", এটাকে আক্ষরিকভাবে গ্রহণ করা হয় না, যদিও সরাসরি বলা হয়েছে। বক্তব্যটি মূলত তার অভ্যন্তরীণ পদার্থ হারিয়ে ফেলার ভাষ্য ।


“উপমা(Simile)”  হলো নতুন কোন অর্থ সৃষ্টির লক্ষ্যে দু’টি ভিন্ন জিনিসের তুলনা করা। এক্ষেত্রে এটা পরিষ্কার যে ‘মত’ বা ‘যেমন’ এরূপ শব্দ ব্যবহার করে তুলনা করা হয়। যেমন- “তিনি একজন মানুষের সেলের মত”। এক্ষেত্রে কেউ যদি সংশোধন করে বলতে চায় “এটা একটি উপমা, রূপক নয়”, তাহলে উত্তরে বলতে হয় “উপমা এক ধরণের রূপক, ঠিক যেমন বিড়ম্বনা এক ধরনের বিদ্রুপ”। ‘সাদৃশ্য’ ‘রূপক’ ও ’উপমা’-এর সাথে তুলনাযোগ্য, এর মাধ্যমে কিভাবে দুটি ভিন্ন জিনিসকে একই রকম দেখানো যায়, কিন্তু তা আরও বেশি জটিল। একটি যৌক্তিক বিবেচনা বা তর্কের দিক থেকে বক্তব্যের চেয়ে ‘সাদৃশ্য’ বেশি কিছুকে নির্দেশ করে। এক্ষেত্রে কবি বা উপস্থাপক বৈশিষ্ট্য উল্লেখপূর্বক দেখাতে চায় যে কিভাবে দু’টি জিনিস বা বিষয় একই রকম। রূপক(Metaphor)-এর বক্তব্য সরাসরি, তাই উপমা বা সাদৃশ্য থেকে তা অধিক শক্তিশালী   হয় ।


এতোক্ষন  যা যা লিখলাম, মুলত একটি প্রশ্নকে সামনে রেখে-


একজন পাঠক কিভাবে কবিতার ভেতরের কলা কৌশলগুলো জানবে? পাঠক যদি নুতন কেউ হয়, একটু আগ্রহ নিয়ে পড়ার চেষ্টা করে, স্বাদ নেয়ার চেষ্টা করে, তার পক্ষে কি নীচের বিষয়গুলো বোঝা সম্ভব?


• রূপক(Metaphor), উপমা(Simile) এবং সাদৃশ্য/অনুকরণ(Analogy)-এর ব্যবহার?
• ইন্দ্রিয় অনুভূতি থেকে অতীন্দ্রিয় বা ইন্দ্রিয়াতীত  রাজ্যে প্রবেশ করানোর কৌশল ?
• শব্দানুভূতি, ঘ্রাণানুভূতি, স্পর্শানুভুতি, দৃশ্যানুভূতি, ভাবানুভূতি এবং স্বাদানুভূতি  ইত্যাদির সাথে। বাকপ্রতিমা (imagery), রূপক, উপমা, সাদৃশ্য  ইত্যাদির সংযোগ কখন, কিভাবে হচ্ছে?


শুরুতে যে উদাহরন দিয়েছিলাম “ হাত ফসকে পড়ে গেল চাঁদ”, নিজেকে কবি হিসেবে না ভেবে, একজন খুব সাধারন মানুষের কাতারে রেখে্, চিন্তা করলে এর অর্থ উদ্ধার করা যাবে? এখন থেকে পাঁচ-ছয় বছর আগে কবিতার অর্থ আমি কিছুই উদ্ধার করতে পারতাম না, কবিতা একটি কঠিন বিষয় মনে হতো, কবিতার কথা শুনলেই ভয় লাগতো, নুতন কোন ভাষা শেখার ক্ষেত্রে যে ধরনের অনুভুতি হয়, মাথা ঘুরতে থাকে, বমি বমি ভাব হয়, পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করে…কবিতা শুনলে আমার এরকম অনুভুতিই হতো। এখনো অনেক কবিতা (বেশীর ভাগ) বুঝি না, মাথা ঝিমঝিম করে, তাহলে নুতন পাঠকের কি অবস্থা হবে??


তাহলে একজন কবি’র কি রূপক, উপমা ইত্যাদি  বাদ দিয়ে “সুযোগ  হাত ছাড়া হয়ে গেল” টাইপের কবিতা লিখতে হবে? কবি কি কবিতার সাথে কম্প্রোমাইজ করবে পাঠকের সুবিধার্থে । তাহলে, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত যে গদ্য আর কাব্যের মধ্যকার পার্থক্য করেছেন, তার কি হবে?


অন্যদিকে একটা চিত্র শিল্পও কিংবা ভাষ্করও সাধারন মানুষ কিছুই বোঝে না। আমি বহুবার আর্ট গ্যালারীতে গিয়েছি, কিন্তু কিছুই বুঝিনি, রঙের টানা টানা দাগ কিংবা গোলাকার টাইপের কিছু একটা ছাড়া আর কিছুই বুঝিনা, তারপরও মাঝে মাঝে যাই। জয়নুল আবেদিন গ্যালারীতে গিয়ে ৩০% বুঝেছি বাকিটা অধরাই থেকে গেছে। কিন্তু সেখানে তো সাধারন মানুষ বোঝে না বলে, কম্প্রোমাউজ এর কথা আসে না, তাহলে কবিতার ক্ষেত্রে কেন আসে? কবিতাকে কেন “দুর্বোধ্য” তকমা দেয়া হয়? কবিতাকে কেন গালাগাল সহ্য করতে হবে? কেন একজন কবিকে কম্প্রোমাইজ করতে বলা হবে? পাঠক বুঝতে পারে না, সে দায় কি একজন কবি নেবেন?


পাঠক বুঝে না বলে কবিতা পড়ে না আর কবি, কবিতার ব্যাকরণ থাকে না বলে, কোন প্রকার ছাড় দিতে রাজী নয়, তাহলে কবি, কবিতা এবং পাঠক বিচ্ছিন্ন থাকবে অনন্ত কাল? নাকি, দুয়েকজন কবিতা পড়ছে, কবি তাতেই আহ্লাদে গদগদ হয়ে আরো বেশি কবিতা লিখতে শুরু করবে?


পাঠক এবং কবি উভয়কেই এক পা, এক পা করে এগিয়ে আসতে হবে। সেজন্য-


* বেশি বেশি কবিতার আসর করতে হবে
* কবিতাকে চার দেয়ালে বন্দি না করে আলোর মুখ দেখাতে হবে।
* কবিতা পাঠ অপেক্ষা কবিতা নিয়ে আলোচনা বেশি করতে হবে।
* কাব্যগ্রন্থ প্রকাশে সম্মিলিত প্রচেষ্টা থাকতে হবে।
* সুযোগ পেলেই কবিতা কিভাবে প্রয়োগিকতা্র রূপ নিতে পারে তার আলোচনা রাখতে হবে।
* কিছুটা কৃপনতা হ্রাস করে, নিয়মিত কবিতা উৎসবের আয়োজন করতে হবে
* কবি মানেই উসখুসকো চুল, আগোছালো জীবন, অতি দরিদ্র, চাল চুলোহীন ব্যক্তিত্ব… এরকম ইমেজ বদলাতে হবে প্রথমে নিজেদের মধ্যেই।