(নোটঃ কিছু কবিতার জন্ম হয় হঠাৎ করে, তার পেছনে কোন গল্প থাকে না। কিন্তু কিছু কবিতার জন্মের পেছনে একটা গল্প থাকে, কোন একটা বিষাদ থাকে কিংবা দহন। কবিতার পেছনের গল্প গুলো পাঠক জানে না, কবি একাই বহন সেই সব গল্প, সুখের কিংবা বিষাদের)


কবিতা-১ এর পেছনের গল্প


প্রেক্ষাপটঃ
তখন আমি ঊষা নামে একটি জাতীয় পর্যায়ের এনজিও-তে কাজ করি, কর্মস্থল দিনাজপুর। সালটা ১৯৯৬-৯৭, সেটাই ছিল জীবনের প্রথম চাকুরী এবং ঢাকার বাইরে প্রথম বসবাস শুরু করা। সবে মাত্র বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশুনা শেষ করেছি, তখন মাষ্টারস এর রেজাল্ট বের হয়নি। কিন্তু চাকরীটা পেয়ে গেলাম, চাঁদ হাতে পাওয়ার মত আনন্দে ভাসছিলাম, বেতন মাসে ৬০০০।– টাকা। ক্লাসমেট, বন্ধুরা তখন অনেকেই চাকরী পায়নি, এপ্লিকেসন করেই যাচ্ছে, রেজাল্ট হয়নি বলে চাকরীও হচ্ছে না। এরকম এক প্রেক্ষাপটে, আমি চাকুরী পেয়ে গেলাম, হউক সেটা মফঃস্বল শহর।


অফিসটা ছিল দিনাজপুর জেলগেট পার হয়ে, একটু এগিয়ে গিয়ে হাতের বায়ে একটা ছোট্র গলি, সেটা ধরে সামনে গিয়ে রাস্তার শেষ মাথায় একতলা একটি বিল্ডিং, পাশের বিল্ডিং এ গ্রামীন ব্যাংকের অফিস। বাসাটায় ৪টি রুম ছিল, একটি আমার থাকার জায়গা, ১টি অফিস কক্ষ, অন্য দুটি গেস্ট রুম, ঢাকা অফিস থেকে বড় বড় কর্মকর্তাগন দিনাজপুর গেলে রাত্রি যাপন করেন অন্যথায় সারা বছর গেস্ট রুম হিসেবে ভাড়া দেয়া হয়। অফিসে আমি আর একজন সাপোর্ট অফিসার কাম কুক ছিলেন। বিয়ের ৫ বছর পর, আমার প্রথম সংসার শুরু হলো দিনাজপুরে। ৩৫০০০/= টাকা ঋণ নিয়ে জীবন শুরু হয়েছিল বলে প্রতিমাসে ঋণ শোধ করতে হত। মাসে অফিস বাসা ভাড়া বাবদ কিছু টাকা কেটে রাখতো, ঋণ শোধ দেয়া হত কিছু টাকা, বাকী টাকায় আমরা রাজার মত চলতাম। তখন গরুর মাংস ছিল ৩০ টাকা কেজি, টমেটো ৫০ পয়সা কেজি (২/৩ কেজি কিনলে, আরো ১/২ কেজি বেশী দিতে দিত)। প্রতি মাসে হাতে ২৫০০/- টাকা থাকাতে নিজেকে রাজা মনে হত, এত টাকা ভাবতেই পারতাম না, জিনিসপত্র সব খুবই সস্তা ছিল, পাশেই ভারতীয় বর্ডার, অনেক ভারতীয় জিনিস কিনতাম খুব অল্প দামে (যেমন-প্রেসার কুকার)। এরকম এক প্রেক্ষাপটেই আমাদের দিন যাচ্ছিল। ঢাকায় খুব একটা আসা হতো না।


মূল গল্পঃ
প্রায়শই দিনাজপুর থেকে ঢাকা আসতাম ট্রেন ভ্রমনে, তাতে সময় বেশী লাগতো কিন্তু খরচ কম হতো। বাসে আসলে প্রায় দ্বিগুণ ভাড়া লাগতো। কি আর করা, মাথায় সারাক্ষন কাজ করতো, কিভাবে একটু টাকা বাঁচিয়ে ঋণের টাকা দ্রুত শোধ করতে পারি। দিনাজপুর থেকে ঢাকা আসতে হতো, ট্রেনে জামালপুর হয়ে। নদীর ওপারে ট্রেন থেকে নেমে, স্টিমার যোগে নদী পার হয়ে আবার এপারে এসে কানেক্টীং ট্রেনে উঠা। এভাবে দিনাজপুর-ঢাকা-দিনাজপুর আসা যাওয়া করতাম।


একদিন ঢাকা আসতেছিলাম, ১৯৯৭ সালের এপ্রিল মাস, নদীর ওপারের ট্রেন থেকে নেমে, স্টিমারে বসে আছি। কিছুক্ষনপর একজন বুড়ীমা ভিক্ষা চাচ্ছিলেন। মাফ করেন বলে দিলাম, আবার পত্রিকা পড়ায় মন দিলাম। আমার তখনকার দর্শন ছিল, ভিক্ষাবৃত্তিকে প্রমোট করা ঠিক না, ফলে আমি সেই সময়টাতে কাউকেই ভিক্ষা দিতাম না। আরো কিছুক্ষন পর সেই বুড়ীমা ঘুরতে ঘুরতে আবার আমার সামনে এসে ভিক্ষা চাইলো, এবার যোগ করলেন, বাবা সকাল থেকে কিছু খাইনি, আর কয়টা টাকা হলে ভাত আর ডাল কিনে খাব।


মাথায় কেমন যেন বিদ্যুৎ চমক লাগলো, পুরো শরীর কেমন ধাক্কা খেল, ঝিম ঝিম করে উঠলো, মুহুর্তেই ফিরে গেলাম,  এক বছর আগেই (আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে ছিলাম) আমিও না খেয়ে ছিলাম দিনের পর দিন, এমনকি একটানা ৩দিন (৭২ ঘন্টা) কিছুই খাইনি, পকেটে একটা আধুলিও ছিল না, ক্ষুধার কষ্টে গাঁয়ে জ্বর এসেছিল, ক্ষুধার কষ্টে জ্বর হয় এটা আমার আগে জানা ছিল না। ধনী বাবা মায়ের পরিবারে জন্মের কারনে, অভাব দেখিনি কখনো, বিলাসবহুল জীবন কেটেছে যুব বয়সে কিনুত ছন্দপতন হয়েছিল বাবা মায়ের অমতে বিয়ে করার কারনে।


এখন, আমার পকেটে টাকা আছে অথচ একজন বুড়িমা না খেয়ে আছে বলার পরও তাকে খাওয়াবো না, এটা হতে পারে না। বুড়িমাকে নিয়ে গেলাম স্টিমার এর হোটেল কক্ষে, আপনি যা যা খেতে চান, আমি আজ তাই খাওয়াবো। বলেন কি খাবেন?


রুই মাছের মাথা খাব
আর
গরুর কলিজা ভুনা খাব
আর
মুরগী, সবজী, ডাল, চিংড়ি মাছ ইত্যাদি ইত্যাদি


সব অর্ডার করে আনলাম, আজ আমি খুব কাছে থেকে দেখবো, ক্ষুধার্ত মানুষ কিভাবে খায়? নিজেরটা নিজে দেখতে পারিনি। এবার বুড়ীমা খেতে গিয়েও খেতে পারছে না, তার দুচোখ বেয়ে অঝোর ধারায় পানি গড়িয়ে পড়ছে। ইমোশনে, কাঁদছে আর কাঁদছে, খেতে পারছে না, বিশ্বাসই করতে পারছে না, তার সামনেই আছে বড় সাইজের এক রুই মাছের মাথা। ভাবছিলাম, বুড়িমা প্রথমেই রুই মাছের মাথার কথা কেন বললেন?


কিছুক্ষন পর উনি শান্ত হলেন, খেতে খেতে তার নিজের জীবনের গল্পটা বললেন-


এক সময় উনি বড় কৃষক পরিবারের বড় মেয়ে ছিলেন, তাদের অনেক চাষের জমি ছিল, গোলা ভরা ধান ছিল, তার বাবা বড় রুই আছ কিনে বাড়ি আসতে আসতে তার নাম ধরে ডাকতেন, বড় মেয়ে বলে খুব আদর করতেন। দুপুরে বাবা তাকে কাছে বসিয়ে রুই মাছের মাথা খাওয়াতেন। যমুনার নদী ভাঙন আর নানা উত্থান পতনের মধ্য দিয়ে তাদের অবস্থা প্রায় নিঃস্ব হয়ে যায়। তার বিয়ে হয়েছিল বড় এক কৃষক পরিবারেই, সেখানেও সচ্ছলতা ছিল। তার ২ ছেলে ১ মেয়ে, ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে, তার স্বামী এক কঠিন অসুখে মারা যায়। মারা যাবার আগে, তার চিকিৎসা করতে গিয়ে এক এক করে অনেক জমি বিক্রি করে দিতে হয়েছিল। ছেলেরা বিয়ে করে নিজেদের সংসার নিয়েই ব্যস্ত, মোটামুটি দিনমজুর/মুদি দোকান করে চলছে কিন্তু মা’কে দেখে না, খোঁজ খবর নেয় না। মেয়ে বিয়ে হয়ে স্বামীর বাড়ী চলে গেছে। বুড়ী মা এখন এভাবেই ভিক্ষে করে তার ক্ষুধা নিবারন করে।


বুড়ী মা’র খাওয়া শেষ না হতেই স্টিমার ঘাটে ভিড়লো, আমাকে যেতে হবে। বুড়িমা আস্তে আস্তে খেয়ে আবার ফিরতি স্টিমারেই ফিরবে হয়তো। খাবার বিল দিয়েছিলাম ২৩৫ টাকা (এখন থেকে ২৫ বছর আগে ২৩৫।– টাকা অনেক টাকা), কিন্তু আমার কাছে সেটা অনেক টাকা মনে হয়নি, বাজে খরচ মনে হয়নি, কি যে সুখ পেয়েছিলান সেদিন, বোঝানো যাবে না। অন্যের জন্য, অপরিচিত একজনের জন্য টাকা খরচ করার মধ্যেও এত সুখ!!!! আজও আমার কাছে সেই দিনের কথা, সেই বুড়ি মা’র ভাজ পরা মুখের ছবি চোখে ভাসে। এর পর প্রতিবার ঢাকা আসার পথে স্টিমারে সেই বুড়িমাকে খুজতাম, আর খুজে পাইনি। ইচ্ছে ছিল তার জন্য, কিছু একটা ব্যবস্থা করা যেন তার খাবারের আর কোন কষ্ট না হয়। সে সুযোগ আর পাইনি আমি।


এ ঘটনা থেকেই জন্ম  হলো এই কবিতার


একমুঠো ভাত, একজন বুড়ি মা
-সরদার আরিফ উদ্দিন
(কবিতাটি আসরের পাতায় প্রকাশিত হয়েছে, অনেক আগে ২০১৮ সালে)
        
একটু সাহায্য দে না
কয়টা টাকা দে না বাবা;
সচরাচর স্বভাবে, কখনো টাকা দিই
কখনো বলি, মাফ করেন;
ফেরী পারাপারে ব্যস্ত সময়, এবারো বললাম মাফ করেন।
অনেকক্ষণ পর,
ঘুরতে ঘুরতে, আবার সেই বুড়ী মা
আর কয়টা টাকা হলে
দুপুরে ভাত খেতে পারি;
দে না বাবা, কয়টা টাকা, ক্ষুধার কষ্টে আর বাঁচি না ।


২৫ বছর আগের
সেই আর্তি “ক্ষুধার কষ্টে আর বাঁচি না”, আজও কানে বাজে;
বুড়ী মা’র জায়গায় নিজেকে দেখি
কতদিন, কত রাত না খেয়েছিলাম, হিসেব নেই
ক্ষুধার কষ্টে গায়ে জ্বর আসে, জানা ছিল না কোনদিন।


পেটে ক্ষুধা নেই
ক্ষুধার কষ্ট অনুভব হয়
রক্তের শিরায় শিরায় কথা হয়
স্বাধীন দেশে “ক্ষুধার কষ্টে আর বাঁচি না”, বুড়ি মা’র মুখে শুনতে হয়
লজ্জায় মাথা নত রয়
ধিক্কার দিয়ে নিজেকে জানান দিতে হয়
নিজের ক্ষুধার কষ্টের কথা বারবার মনে হয় ।


বুড়ি মা, আজ যা খেতে চান
তাই খাওয়াবো;
ফেরীর ক্যান্টিনে বসে, কি খাবেন?
রুই মাছের মাথা, আর কি?
গুরুর কলিজা ভূনা, আর কি?
ট্যাংরা মাছের ঝোল, আর কিছু খেতে চান?
বাতাসী মাছের চড়চড়ি, আর...আর কি...


প্রান ভরে দেখবো আজ
নিজের ক্ষুধার্ত চেহারা দেখিনি কোনদিন;
ক্ষুধার্ত মানুষ কেমন করে খায়
একটু একটু করে, নাকি সব একসাথে
তারা কি চিবিয়ে চিবিয়ে খায়
নাকি, গোগ্রাসে খায়?


দর দর করে
চোখে অশ্রু ঝড়ে; আবেগে বুড়ী মা
৬০ বছর আগের জীবনে ফেরে;
বাবার আদরের
বড় মেয়ে,
রুই মাছের মাথা তারই জুটতো, বাবার আদর পেয়ে।


গৃহস্থ বড় ঘরে, স্বামীর সোহাগে
দিন কাটেনি একটুও অভাবে;
যমুনার ভাঙ্গনে সব শেষ
বাবা, স্বামী, জমি, হালের বলদ সব হারিয়ে
নিঃশেষ;
ছেলে মেয়ের ব্যস্ত জীবন
বুড়ি মা এখন আর নেই কারো আপন;


এত বছর পর
সেই স্মৃতি, সেই রুই মাছের মাথা
চোখের সামনে, কিভাবে সম্ভব? কল্পনায় গাথা!
সত্যিই রুই মাছের মাথা, নাকি চোখের ধা ধা।


অপরিচিত এক যুবকের
মুখের দিকে তাকায়, বার বার নিজেকে ভাবায়
আবেগে কণ্ঠ জুড়ায়;
রুই মাছের মাথা আর খাওয়া হয় না
ফেল ফেল করে তাকায়;
চোখের অশ্রুতে ভাতের প্লেট ভাসায়।


ভাতের কষ্ট
কেউ জানে না;
কেবল বুড়ি মা আর আমি জানি
ক্ষুধার কষ্ট;
সেদিনের সেই খরচ
আমার জীবনের ব্যয় শ্রেষ্ঠ।


জুলাই ২৭, ২০১৮
মিরপুর, ঢাকা