কবিতা-৪ এর পেছনের গল্প


সেদিন একটি কবরস্থানে ছিলাম, বেশ অনেকটা সময় ধরেই পুরো কবরস্থান ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন এপিটাফগুলো পড়ছিলাম। কত বিখ্যাত, কত ক্ষমতাবান, কত জ্ঞানী মানুষেরা এখনে ঘুমিয়ে আছে ! বেঁচে থাকাকালীন সময়ে কতোই না গর্ব, ক্ষমতার দম্ভ ছিল কিন্তু আজ এখানে সবাই একই কাতারে, একইভাবে ঘুমিয়ে আছেন, একই দিনের প্রতিক্ষায় আছেন, এসব নানারকম ভাবনায় খুব বিষন্ন ছিল মনটা।


প্রসঙ্গত, ২০২০ সালে মে মাসে মাত্র ২১ দিনে ব্যবধানে বাবা মা দুজনকেই হারিয়েছিলাম। বড় ভাই দেশের বাইরে থাকাতে, মেঝ ছেলে হিসেবে আমাকেই দাফন কার্যের মূল দায়িত্ব পালন করতে হয়েছিল এমনকি করবের নীচে নেমে বাবা মা কে শুইয়ে দিতে হয়েছিলো আমাকে এবং আমার ছোট ভাইকে। করোনা-১৯ এর ভয়াল থাবা সেই সময় (যদিও তারা করোনা আক্রান্ত ছিলেন না) কিন্তু চারদিকের পরিবেশ, পরিস্থিতি যে কোন স্বাভাবিক মৃত্যুকেও ভয়ঙ্কর রূপদান করেছিল। তারপর থেকে নিয়মিত বাবা মা’র সাথে দেখা করার জন্য কবরস্থানে গিয়ে থাকি, সেদিনও ছিল সেরকম একটি দিন। কিছুক্ষন আগেই বাবা মার সাথে কথা বলে, এক জায়গায় বসেছিলাম।


সবাই, একটি লাশ নিয়ে কবরস্থানে (কাশিপুর কবরস্থান, নারায়নগঞ্জ) প্রবেশ করলো দাফনের জন্য। চারদিকে শোকাচ্ছন্ন মানুষ, আত্মীয় স্বজন, কেউ কেউ আয়োজন করছে দাফন পূর্ব প্রস্তুতি, কেউ দোয়া পড়ছে, কেউ শোকে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে কোনায় আবার কেউ বা খুব স্বাভাবিক যেন কিছুই হয়নি, অন্যান্য দিনের মতোই একটি দিন। স্বামী বিলাপ করছে, আমি কেন ওর (স্ত্রীর) আগে গেলাম না, ও কেন আমাকে রেখে আগে চলে গেল, ঈশ্বরের/আল্লাহর প্রতি অভিযোগ জানাচ্ছেন কোন কিছু বিবেচনা না করেই, কেই কেউ তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন ধর্মের নানা রকম আয়াত আর হাদীদের উদ্ধৃতি দিয়ে।  


আমি তখন আজকের আমিতে ছিলাম না, ফিরে গিয়েছিলাম দুবছর আগে, আমি এই ভুমিকাতেই ছিলাম এখন যারা এখানে যা যা করছেন। মানুষের নিজ নিজ ভূমিকা এবং তার ফলাফল চক্রাকারে ফিরে ফিরে আসে, আমিও একদিন আজকের লাশের ভুমিকায় থাকবো, আমাকেও মাটির নীচে ফেলে রেখে সবাই চলে যাবে ব্যস্ত পৃথিবীতে, আমিও বাবা মা কে ফেলে রেখে গিয়েছিলাম এখানেই। এটাই বাস্তবতা, এটাই সৃষ্টির নিয়ম। আমাদের কেবল হা হা কার করা ছাড়া আর কিছুই করার নেই। ঈশ্বর/আল্লাহ  ভালো জানেন আমাদের পরিনতি সম্পর্কে। মূলত সেদিনের সেই অনুভূতির একটা স্থির চিত্র দীর্ঘদিন মনে ঘুরপাক খাচ্ছিল, কিছুতেই ভুলতে পারছিলাম না।


এ ঘটনা থেকেই জন্ম  হলো এই কবিতার


আতঙ্কঘন শ্বাস, একটি দৃশ্যপট
-সরদার আরিফ উদ্দিন


নিঃসঙ্গতার সমারোহ
পিনপতন নীরবতা;
নিঃশব্দে ঘুমে অচেতন
পৃথিবীকে তোয়াক্কাহীন যাত্রা;
কেউ কেউ তখনো সঙ্গী হবার অপেক্ষা।
কেউ বা দাম্ভিকতায় ভুলে থাকার অবিরাম চেস্টায় নিমগ্ন;
এসবই একটি স্থির চিত্র।


কেউ একজন আসলেন
অন্যরা এগিয়ে যেতে সাহায্য করলেন;
তিনি এখানে আসতে চান নি
আসতে বাধ্য হয়েছে্ন;
অন্য কেউ, আসার প্রতীক্ষায় কিন্তু
আসতে পারছেন না, অপেক্ষার প্রহর যেন শেষই হচ্ছে না।


ওইখানে লাল রঙ
রক্তক্ষরণের দৃশ্য আঁকা;
হৃদপিণ্ডের অনুভবকে বিদ্ধ করে সাদা কাপড়ের ক্যানভাসে।
আতঙ্কঘন শ্বাস গভীর থেকে আরো গভীরে
ধীরে ধীরে তলিয়ে যাওয়া
প্রতিক্ষনে বিষাদের আলিঙ্গন;
মনঃকষ্টে গাছের শাখারা নূয়ে পড়েছে
যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন, বিদায়ক্ষন উপস্থিত!!


একজন দূরে বসে দেখছেন, যাবতীয় দ্রৃশ্যপট
অন্যজন খুব কাছে থেকে


আমি তখন করবস্থানেই ছিলাম !!!


মিরপুর, ঢাকা
সেপ্টেম্বর ১৯, ২০২২, ভোর ৬টা