কবিতায় ভাষা এবং শব্দের ব্যবহার নিয়ে অমীমাংসিত বিতর্ক আছে বহুদিন থেকেই। কবিতার ধরন, ব্যাকরন, ব্যঞ্জনায় যখন বাক পরিবর্তন হতে থাকলো তখন থেকেই পক্ষ বিপক্ষ মতামত জোড়ালো হতে শুরু করলো। মুলত বিতর্কের মূল ইস্যু গুলো-


১। কবিতায় কতটুকু স্বাধীনতা থাকবে, কি কি  বর্জন হবে কিংবা আদৌ কিছু বর্জন করা প্রয়োজন আছে কি না? স্বাধীনতা প্রশ্নে বর্জন গ্রহনযোগ্য কি না?
২। কবিতায় ভাষা প্রয়োগের ক্ষেত্রে অশ্লীলতা, কবিতা সীমানা ছাড়িয়ে যাবে কি না?
৩। কবিতায় সংস্কৃতি ভিন্নতা কিভাবে গ্রহন করবে কিংবা করবে না
৪। কবিতা কতটুকু রাষ্ট্রিয় কিংবা সাংগঠনিক নীতিমালায় আবদ্ধ থাকবে কিংবা শেকল ছেড়ে বেরিয়ে আসবে?
৫। কবিতা অনুবাদে ভাষা এবং শব্দ প্রয়োগে সংস্কৃতি ভিন্নতা
৬। কবিতায় সংবেদনশীলতা বিশেষ করে ধর্মীয় প্রেক্ষাপট- গ্রহন কিংবা বর্জন
৭। কবিতায় শালীনতা বনাম অন্যের বিরাগভাজন; ইত্যাদি


১। কবিতা লিখায় স্বাধীনতা :


একজন কবি’র কবিতা লেখার উপর কতটুকু স্বাধীনতা আছে বা থাকবে তাই নিয়ে বিতর্ক, আলোচনা, সমালোচনা-এখানে সেখানে নানাভাবে। একপক্ষ চূড়ান্ত পর্যায়ে অবস্থান নিয়ে থাকে (extreme position), কবি সম্পুর্ন স্বাধীনভাবেই লিখবে, তার চিন্তায়, তার ভাবনায়, তার লেখায় কোন প্রকার হস্তক্ষেপ চলবে না। বাইরে থেকে কোন কিছু আরোপিত হবে না, কোন প্রকার বিধি নিষেধও চলবে না। কবি, তার নিজের ধ্যান জ্ঞান অনুসারেই কবিতা চর্চা করবে, কবিতা লিখবে। এরা পূর্ন মাত্রায় স্বাধীনতার পক্ষে।


অন্যপক্ষ, কিছুটা লিবারেল হলেও, সমাজ বাস্তবতায় কিছু রাস টেনে ধরতে চান। একজন কবি নিজেও সেই সমাজের অংশ, সমাজের (দেশ) ভালো মন্দ তাকেও প্রভাবিত করবে, আক্রান্ত করবে, শংকিত করবে। ফলে, সমাজ, সংস্কৃতিকে মেনে নিয়েই তিনি কবিতা চর্চা করবেন। কবিতায় ভাষার ব্যবহার, শব্দের ব্যবহার ও প্রয়োগ…সর্বক্ষেত্রেই তাকে সমাজের রীতিনীতি, চর্চা, বিদ্যমান সংস্কৃতিকে মেনে নিতেই হবে অন্যথায় একজন কবিও সমাজে বিশৃঙ্খলাসৃষ্টিকারী হিসেবে সনাক্ত হবেন। কিছু উদাহরন দেয়া যাক-


• রাষ্ট্র বিরোধী কিংবা রাষ্ট্রের চুড়ান্ত সমালোচনা কিংবা রাষ্ট্রের কোন নীতি বিরুদ্ধ কোন কথা কি কবিতায় লিখা যাবে?
• রাষ্ট্র কিংবা সমাজ অনুমোদিত নয় এমন কোন শব্দ বা ভাষা কি ব্যবাহার করতে পারবেন?
• কবি যখন কোন সংগঠনের কাঠামোতে থাকেন, তখন কি সংগঠনের নীতি বহির্ভূত কিছু লিখতে পারবেন? একজন কবিকেও কোন না কোন কাঠামোর মধ্যেই থাকতে হবে।
• কিন্তু কবি যদি, কোন সংগঠনে (ফরমাল সংগঠন) না থাকেন তখন কি নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী, যা ইচ্ছে তাই লিখতে পারবেন? রাষ্ট্র, সমাজ, পরিবার…এগুলোও কিন্তু প্রতিষ্ঠান, আদতে প্রতিষ্ঠান ভিন্ন মানুষের একক কোন অস্তিত্ব কি আছে?


আমরা অনেকেই বলে থাকি, আমি কারো জন্য কবিতা লিখি না, কবিতা লিখি নিজের মনের আনন্দে, শৌখিনতা বলা যায়। কেউ কবিতা পড়ুক বা না-পড়ুক, আমি নিজের জন্যই কবিতা লিখি। কথাটা কি সত্যি? কবি যদি তার নিজের কবিতার কোন পাঠক প্রত্যাশা নাই করেন, তবে প্রকাশ করেন কেন ? সেটা প্রিন্ট আকারে, প্রকাশনা আকারে, অন-লাইন ভার্সনে, সোস্যাল মিডিয়াতে বা কোন কবিতার আসরে? নিজের জন্য কবিতা, নিজের ডায়রীতে লিখে রাখলেই হয় কিংবা কম্পিউটারে টাইপ করে রাখলেই হয়। মূলত প্রত্যেকের একটা সুপ্ত বাসনা থাকে তার কবিতা কেউ পড়ুক, পড়ুকটা একজন কিংবা একশত জন,  যাই হউক না কেন। তাহলে কবিতা লিখার মূল উদ্দেশ্য হলো পাঠকের কাছে পৌঁছানো। পাঠক যে সমাজে (বা রাষ্ট্রে) বসবাস করেন, সেই সমাজের (বা রাষ্ট্রের) নীতিনির্ধারকগন তো চাইবেই তাকে শাসনে রাখতে নীতি কিংবা রীতির মাধ্যমে। একজন কবিকে পূর্নমাত্রায় স্বাধীনতা দিলে সেটা সম্ভব??


ফলে, একজন মানুষের যেমন কোন স্বাধীনতা নেই, মানুষ যেমন জন্মের পরই তার স্বাধীনতা হারায়, তেমনি একজন কবি’র ও পূর্ন স্বাধীনতা নেই, আদতে মানুষের কোন স্বাধীনতাই নেই। মানুষ সব সময়ই কোন না কোন কাঠামোর মধ্যেই থাকবে, কাঠামোতে ভিন্নতা থাকতেই পারে। পাখির খাচা ছোট বড়, চৌকোনা, তিনকোনা নানা রকম হতেই পারে সেটা ভিন্ন বিতর্ক।


আমাদের মনের মধ্যে কবি সম্পর্কে যে একটা ইমেজ ধারন করে রাখি (একজন কবি স্বাধীন মানুষ), আদতে সেটা সত্য নয়, সেটা একটা কল্পিত রূপ মাত্র, যার কোন বাস্তবতা নেই। কবিতায় যেমন নানা কল্পনা থাকে তেমনি কবি সম্পর্কেও নানা কল্পনা, যল্পনা সমাজে বিদ্যমান যার কোনটারই কোন বাস্তবভিত্তি নেই। একজন মানুষকে যেমন সামাজীকিকরন প্রক্রিয়ার (socialization process) মধ্য দিতেই যেতে হয়, বেঁচে থাকতে হয়, একজন  কবি’র ও সামাজিকীকরণ হয়। সামাজিকীকরণ বনাম স্বাধীনতা  (socialization vs freedom) সেটা এক ভিন্ন বিতর্ক।


২। কবিতায় ভাষা প্রয়োগ : অশ্লীলতা বনাম বিরাগভাজন
৩। কবিতায় সংস্কৃতি ভিন্নতা
৪।কবি, কবিতা এবং নীতিমালার বাধ্যবাধকতা
৫। কবিতা অনুবাদে ভাষার সীমাবদ্ধতা বনাম স্থানীক সংস্কৃতি
৬। কবিতায় সংবেদনশীলতা
৭। কবিতায় শালীনতা এবং পুজিবাদী প্রসক্রিপসন


চলবে...