বিবিধ লেখকের দেওয়া লেখার নিয়ম কানুন


(নোটঃ ঘটনাটি ঘটেছিল ২০১৬ সালে। ব্রিটেনের চেলথেমহাম বইমেলাতে। সেখানে এসেছিলেন অনেক লেখক। একজন ওদের কাছ থেকে লেখার “টিপস”  সংগ্রহ করে সেগুলো ছাপিয়ে দিলেন। আমার ভালো লেগেছে তাই আসরের পাঠকদের জন্য এখানে তুলে দিলাম। লেখকেদের নাম দেয়া হয়নি এখানে)


১। সবকিছু শুরু হয় একটি বিন্দু থেকে। এই শুরুটা চিন্তায় ফেলতে পারে। কোথা থেকে শুরু করবো? শুরুটা মহান কিছু, বড় কোন চরিত্র বা ঘটনা দিয়ে শুরু করতে হবে তার কোন মানে নেই। খুব সাধারণ মানুষ, তুচ্ছ কোন ঘটনা দিয়ে শুরু হতে পারে (যেমন- মোজাফরর হোসেনের ভ্যাদা কবি, চক্কর খাওয়া জকি বা শরৎচন্দ্রের মহেশ কিংবা সেলিনা হোসেনের বেড়াল।


২। লিখতে বসে ভুলে যেতে হবে বর্তমানে কোন স্টাইলে লেখা চলছে বা আমি এর বাইরে নুতন কিছু করবো। এসব বড় বড় চিন্তা ভুলে গিয়ে ভাবা ভালো কোন ভাবে লিখলে লেখাটি আমার মনের মতো হবে। সকলকে চমকে দেব? এমন কোন বিরাট উদ্দেশ্য সব সময় কার্যকরী নয়। নিজের কাছে কোন নিয়ম ভালো? এটা যদি অন্য কারো নিয়ম না হয় তবুও তা আমার নিয়ম।


৩। গল্পে যেন বাস্তবতা থেকে কারণ আমরা এখন আর কেউ পরীর গল্প লিখছি না।যত বড় লেখকই কেউ একজন হন না কেন, সবসময় মনে রাখা ভালো লেখার একটি নীতিগত দিক থাকে, সোচ্চারে নয় অলক্ষে। জানার ভেতর অজানার কথায় পৃথিবী হয়ে যায় আরেক পৃথিবী। লেখাই তো পারে পৃথিবীকে বদলাতে। চার্লস ডিকেন্সের আগের আর পরের ব্রিটেন কি এক?


৪। শব্দগুলো যেন ঠান্ডা হীম ঘরে আগুনের মত গনগন হয়। শব্দের অহেতুক অপচয় নয়। হিসেব করে সেই গনগনে শব্দগুলো ব্যবহার করতে হবে। কেউ কেউ বলেন টাকশাল থেকে বেরিয়ে আসা চকচকে টাকার মত শব্দ।


৫। যখন লিখতে গিয়ে মনে হবে চরিত্রগুলো কেমন চুপ হয়ে গেছে ওদের বেড়াতে নিয়ে যেতে হবে। দেখাতে হবে প্রকৃতি বা পছন্দের চায়ের দোকান। না হলে ব্রিজের তলা দিয়ে বয়ে যাওয়া নদী। ফিরে এসে মনে হতে পারে ওরা তো আবার প্রাণ ফিরে পেয়েছে।


৬। মনে মনে হিসেব করা একদিনে কতটুকু লেখা যাবে।  কৌশলে লেখার একট সময় ও সংখ্যা ঠিক করা। অনুবাদ হলে কতটা, মৌলিক হলে কতটা। আমি নিজে চারপাতার বেশি অনুবাদ করি না একদিনে, ১০০০ শব্দের বেশি মৌলিক লেখা লিখি না। হেমিংওয়ে বলেছেন-  টাইপরাইটারের সামনে বস আর রক্তাক্ত হও (সিট এন্ড ব্লিড)।


৭।  নভেলের বা গল্পের প্রথম খসড়া মনের মত নয়?  এরপরের খসড়া ভালো হবে, তারপরেরটা আরো ভালো। হেমিংয়য়ে একটা খসড়া ৯১ বার বদলে ছিলেন।  একটু বাড়াবাড়ি মনে হলেও হতে পারে।


৮।  লেখার জগতে যাবার আগে পড়, পড় এবং পড়।  পড়তে পড়তে মনে ভেতর  লেখার  একটা জগত তৈরি হয়ে যায় অটোমেটিক। তারপর আরো পড়, পড়া চালাতেই থাকো।


৯। লেখার আরেক নাম “রোল প্লে”। ওই মা আমি, ওই নায়িক আমি, আমিই ওই জন। কি যায় আসে কার কত বয়স?


১০। যা লিখতে মন চায়, লিখে যেতে হবে। গ্রহণ বর্জন পরের ব্যাপার। তারপর কতটুকু থাকবে, মাথার ভেতরে যে এডিটর আছেন তিনি ঠিক করবেন।


১১। চরিত্রগুলো কেবল পছন্দের একজন হবেন তার কোন মানে নেই। কে যে কখন
প্রিয়জন হয়ে যায়, সব নির্ভর করে লেখার কৌশলের উপর।


১২। আর যিনি লেখেন গান শোনা, কবিতা পড়া, ছবি দেখা, প্রকৃতির সঙ্গে ভাব করে ফেলা জরুরী। এগুলো লিখতে সাহায্য করে। আর মানুষ সম্বন্ধে যাদের অপার কৌতূহল।


১৩। ভন্ডামী বাদ দিয়ে ভাবতে হবে সত্যিকারের আনন্দ বেদনার কথা। আমার লেখা, আমার আনন্দ বেদনায় ভরে থাক।আরোপিত আনন্দ বেদনা নয়। আমার যা ভালো লাগে।


১৪। লেখা আসলে খোঁজা।খুজে বের করা। তারপর দেখতে হবে ওখানে আমার কতটুকু সায় আছে বা ব্যবধান আছে।


১৫। কেবল যা জানা তা দিয়ে লেখা নয়। সব সময় কিছু না কিছু “এক্সপ্লোর” করা। বছরে ওরা চারজন পুরুষ দেখতে-বাবা, দুধ ওয়ালা, কাগজ ওয়ালা, চিঠির ডাক পিয়ন। কিন্তু ওরাই সৃষ্টি করেছে এমন সব চরিত্র যারা কল্পনার নৌকা সাতরে  ওদের চিন্তা ও ভাবনায় জালের মাছের মত ধরা দিয়েছে। ওদের  জগতে কোথা থেকে এইসব নেমে এসেছে, কে বলবে। “প্রেম ও প্যাশনে”, পরিপূর্ণ লেখা।


১৬। লেখার কতগুলো পরত বা লেয়ার থাকে। প্রথম  পরত হালকা। পরতের পর পরত সরালে বেরিয়ে আসে গভীরতা।


১৭। হাল ছাড়া নয়। লেগে থাকা। প্রকাশক হয়তো ফিরেয়ে দেবেন বার বার, অনেকবার। এখন? এমনি করে কোন অভাবনীয় ব্যাপার সকলের জীবনে ঘটে যেতে পারে। খ্যাতিমান না হতে চাইলেও।


১৮। ডিগ্রিধারীই যে কেবল লিখবেন তা নয়। সকলেই লিখতে পারেন। সমালোচক ডিগ্রিধারী হলেই ভালো সমালোচক হতে পারেন এমন ধারণা ভুল।


১৯। ছোটদের জন্য লিখতে গেলে আমাদের ফিরে যেতে হবে দশ কিংবা বিশ বছর বয়সে। যার ছোট বেলা মনে নেই, তার জন্য ছোটদের বই লেখায় সমস্যা।


২০। লিখতে লিখতে বিনয়ী হয়ে এর ওর মতামত না নেওয়াই ভালো।সকলের মতের সঙ্গে যিনি লিখছেন তার মতের মিল হবে এমন গ্যারান্টি কোথায়? যার ভুল তিনি নিজেই শোধরাবেন। আর সেটা না পারলে ভাবনার বিষয়। অন্যের মতামত লেখার নিজস্ব গতিকে থামিয়ে দিতে পারে। লিটারিলি এডিটর সব সময় ভালো হবেন সেটা সত্য নয়।


২১। লেখ !! কারণ তুমি লিখতে ভালোবাসো, আর কোন কারণ নেই। তুমিই সেইজন লেখার ভেতর ডুবে এমন কিছু দেখতে পাও যা অন্যরা পায় না। অন্তর্দ্রৃষ্টি সকলের থাকে না। আর সকলেই কি পারে নানা সব চরিত্র সৃষ্টি করতে?


২২। কেউ যদি সমালোচনায় রাগিয়ে দেয়, মনের ভেতর আগুন জ্বালিয়ে দেয়, কাজে লাগাতে হবে সেই আগুনকে।


২৩। তোমার চরিত্রগুলোর সঙ্গে প্রেমে পড়ে যাও, বার বার। ক্ষতি নেই কোন। এরপর কি হবে তুমি তা জানো। তবে টলষ্টয় বলেন-আনা কারেনিনা রেলগাড়ির তলায় চাপা পড়তোই। ওখানে আমার আর কোন হাত ছিল না। ওকে বাঁধা দিলে ও শুনতো না। কখনো চরিত্র চলে নিজের গতিতে। ভাবতে হবে।


২৪। যে সমস্ত ভাবনা মনে আসে টুকে রাখা ভালো। একটা নোটবুক সব সময় সঙ্গে রাখা ভালো। চলতে চলতে একটা কিছু মনে পড়ে গেলে টুকে রাখা যাবে।  পরে তা কাজে লাগানোর সুযোগ তৈরি হয়।


২৫। পারফেকশন? কিছুতেই মন ভরছে না। না হোক, পারফেক্ট। পৃথিবীর কোন কিছুই পারফেক্ট নয়।


২৬। যখন প্রকৃতির সঙ্গে বসবাস সেই সব অনুভূতি লেখা থাক কোথাও। তখন যে গাছ আর ঘাস কথা বলতে শুরু করে তা কে জানে? মনের ভাব বদলায়। তাই যেসব নুতন ভাবনা চলে  আসছে, আসতে দাও। পরে তা কাজে লাগবে।


২৭। যে সব জিনিস মন বিক্ষিপ্ত করে সেসব থেকে দূরে থাকা। চারপাশের জগত থেকে খুঁজে নেয়া কি আমাকে নাড়া দেয়। কোন বেদনা বা কোন আনন্দ। সে সবই ঘুরে ঘুরে আসে লেখায়। তাই বলে চারপাশের জগত থেকে সরে গিয়ে হিমালয়ের চূড়োয় গিয়ে লিখবো? তাহলে সেটা হবে “পলায়নপর সাহিত্য”।


২৮। লিখতে বসলে মনে করতে হবে আমার চারপাশে আর কিছু নেই। কেবল আমি আর কি-বোর্ড কিংবা খাতা কলম। হেমিংওয়ে যেমন বলেন- সিট এন্ড দ্যা টাইপরাইটার এন্ড ব্লিড।


২৯। অন্য লেখক বা লেখা আমাকে অনুপ্রেরণা দিতে পারে।একে কপি করা বলে না। গুগুলের ওভারকোট থেকে বেরিয়ে এসেছে অসংখ্যা ছোট গল্প। তারপরেও নিজের একটা নিজস্বতা রাখতে হবে।


৩০। নিয়মিত লিখতে হবে। যত লেখা যাবে ততো তা শানিত হবে। মরচে ধরবে না ভাবনায়।


৩১। খারাপ হতে পারে প্রথম খসড়া। এক খসড়ায় কোন কিছু শেষ করা মোটেই কোন কাজের কথা নয়। তবে হেমিংওয়ের মত ৯১ বার বদলানো সকলে পারবে না।তারপরেও বার বার লেখায় খানিকটা ভালো হবার সম্ভাবনা থাকে। লিখে ফেলে রাখা। তারপর আবার তাকে দেখা।


৩২। কেউ কোন বিষয়ে লিখতে বললো আর আমি লিখতে শুরু করলাম এ কোন কাজের কথা নয়। মনের ভেতর একজন এডিটর থাকেন। তিনি বলবেন কোন বিষয়ে আমি ভালো পারি। অনুরোধে ঢেঁকি গেলা সব সময় ঠিক না।


৩৩। যখন লিখছি তখনো কি আমরা লিখছি। এই প্রক্রিয়া আমাদের মাথার ভেতরে চলতেই থাকে। তার মানে এই না যে আমরা আর সব ভুলে যাই। ব্যাপারটি ঠিক তা নয়। সবকিছুর ভেতর একজন লেখক কিছু উপাদান পেয়ে থাকেন যা অন্যদের চোখ এড়িয়ে যায়। আর যা লিখছেন বা লিখতে লিখতে ফেলে এসেছেন তা মনের ভেতর গুন গুন করতে পারে। একেই বলে যখন লিখছি না, তখনও কিছু না কিছু লিখছি।


৩৪। ছোট বাক্য, সহজ শব্দ, জটিল দীর্ঘ লেখা নয়, এক কথা বার বার বলা নয়, কোন আজে বাজে শব্দ নয়, পারলে এক্টিভ ভয়েসে বর্ননা করা। প্যাসিভ ভয়েসের চাইতে যা জোরালো। আকাশে চাঁদ উঠেছে না বলে, বলা যেতে পারে-ভাঙ্গা কাচের জানালায় চাঁদের আলো কেমন দেখতে লাগছে।একটা লক্ষ্য বা কিছু একটা বলবো বলে লেখা। কোন লক্ষ্য নেই, কোন কিছু বলার নেই, তাহলে ব্যাপারটি হবে অসংলগ্ন। পথের বা যাত্রার তো একটা শেষ থাকে। তারপরেও শেষ হয়ে শেষ হয় না সেসব তো আছেই। অনুচ্ছেদ্গুলো যেন খুব বড় না হয়। যেন লেখার ভেতর স্পেস থাকে কারণ, চাপাচাপি লেখা দেখতে ক্লান্তিকর হতে পারে। পরিচ্ছদবিহীন বই ঘরবিহীন বাড়ির মত। আর কেউ নয় কেবল নিজের ভেতরের সেই এডিটরকে দিয়ে বার বার শোধরানো।


৩৫। উপরের সব টিপস ভুলে যাও। তোমার যেমন ভালো লাগে তেমন লেখ। যেন সেটা হয় স্বতঃস্ফুর্ত। একজন তার মত করে লিখবে সেখানে লেখার কোন টিপস মনে থাকতেও পারে, নাও পারে।