মানুষ এক বহমান প্রতিচ্ছবি, যার অন্তঃস্থলে সঞ্চিত থাকে আত্মঘাতী স্থাপত্যের বিষাক্ত নকশা।
সে নিজের চারপাশে নির্মাণ করে এক অদৃশ্য গহ্বর,
যেখানে প্রতিটি শ্বাস বিষাক্ত হয়ে ওঠে আত্মসংশয়ের ছোবলে, আর প্রত্যেকটি দৃষ্টি ঘোলাটে হয় সংকোচনের ঘন কুয়াশায়।
এই জেলখানা ইট-পাথরের দৃশ্যমান নির্মাণ নয়;
এটি মনের অতল গহ্বরে গড়ে ওঠা এক দুর্ভেদ্য প্রাচীর, যার প্রত্যেকটি ইট গাঁথা হয় হীনমন্যতার জীর্ণ স্তব্ধতায়, আর মরচে ধরা শিকল বোনা হয় কল্পনার সংকীর্ণ সীমানায়।
এই অদৃশ্য কারাগারের প্রতিটি কোণে জেগে থাকে সীমাবদ্ধতার জ্বালামুখ,
যেখান থেকে নিরবধি উদগীরণ হয় ভয়, আশঙ্কা ও দ্বিধার বিষাক্ত ধোঁয়া।
মানুষ জানে, তার ডানা আছে, আছে অন্তর্নিহিত মহাকাশ ছোঁয়ার ক্ষমতা—তবুও সে নিজেই মেনে নেয় এক অপরিকল্পিত পরাজয়।
সে প্রতিনিয়ত ছটফট করে, আকাঙ্ক্ষা করে বিস্তার, মুক্তি, উন্মোচন!
কিন্তু বাস্তবতার নির্মম নিঃসঙ্গতা তাকে প্রতিবার টেনে আনে এক অন্ধ গহ্বরে।
হৃদয়ের গভীরতম স্তরে জমে থাকা আকুতি যখন কান্নায় রূপ নেয়, সেই কান্না আর কারও কানে পৌঁছায় না।
হারিয়ে যায় নিজের গড়া শূন্যতার ধ্বনি-নিরোধ প্রাচীরে।
সে আর বোঝে না—তার শত্রু বাহিরের কোনো দানব নয়; বরং তার অন্তর্নিহিত ভীরুতা,
তার ক্ষুদ্রতাবোধ, তার আত্মদংশনের ছায়া হয়ে ওঠে আসল প্রতিপক্ষ।
সম্ভাবনার গলা টিপে ধরা হয় নিজের হাতেই,
অথচ মানুষ তাকিয়ে থাকে অন্যদিকে—যেন মুক্তির চাবিটি কোনো গোপন অলিন্দে হারিয়ে গেছে।
সে ভুলে যায়, সেই চাবি তার মুঠোর মধ্যেই রয়ে গেছে, কেবল প্রয়োজন এক মুহূর্তের আত্মজাগরণ,
প্রয়োজন এক বজ্রনিনাদে বিদীর্ণ সাহস।
এই অন্তর্জালিক আবদ্ধতা ভাঙার ক্ষমতা হয়তো সবার নেই,
তবে যাদের আছে তারা জানে,
সত্যিকারের মুক্তি আসে তখনই, যখন মানুষ নিজের অন্তরতম সীমারেখাগুলোকে অতিক্রম করে।
কারণ মানুষের আসল কারাগার বাইরে নয়, ভেতরে।
আর সেই কারাগার ভাঙার প্রথম পদক্ষেপ—
ভয়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, নিজস্ব গড়ে তোলা বিভ্রমের মূর্তি চূর্ণ করা।
=========