এ শহরের গাঢ় নিশুতি যখন দিগন্তে বিস্তার লাভ করে, তখন ইস্পাতনির্মিত অট্টালিকার ছায়ায় দাঁড়িয়ে থাকে এক নিঃশব্দ মৃত্যুর আলেখ্য।
সভ্যতার অভিজাত মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে থাকে অব্যক্ত বেদনাবাহী এক করুণ অধ্যায়—
যেখানে অপার ঐশ্বর্যের উজ্জ্বলতা গ্রাস করে ফেলে মানবিকতার কণ্ঠস্বর।
আর্তনাদ সেখানে বিলীন হয় নীরবতার অন্তঃস্থলে,
আর আলোকমালায় সাজানো রাস্তাগুলো হয়ে ওঠে একাকিত্বের প্রতিচ্ছবি।
এই বহুমাত্রিক নগরে, যেখানে কংক্রিটের শাসন প্রতিনিয়ত সংহারের অনুবাদ লিখে যায়,
সেখানেই কোনো এক নিঃসঙ্গ প্রহরে জ্বলে ওঠে এক অনিবার্য শিখা।
সেই শিখা কেবল অগ্নি নয়, তা অন্তরের গভীরে সঞ্চিত ক্রোধের রূপান্তর—
বিদ্রোহের অতল স্রোতধারায় জেগে থাকা এক অনিবার্য বিস্ফোরণ।
বঞ্চিত জনতার চোখে দীপ্ত এক অমোঘ প্রত্যয়,
যা মরীচিকার প্রতারণা নয়, বরং ধ্বংসস্তুপের মধ্যেও গড়ার দুঃসাহসিক অঙ্গীকার।
ধূসর এই প্রান্তর—মরুভূমির মতো নিঃস্পন্দ ও তপ্ত,
যেখানে প্রতিটি নিঃশ্বাসই যেন জীবন ও মৃত্যুর মধ্যবর্তী এক অনিশ্চিত সেতুবন্ধ।
সেখানে যাদের নাম উচ্চারিত হয় না,
যাদের রক্তে লেখা হয় সমাজের নীতিমালা,
তারা বাঁধা পড়ে থাকে আইনরূপী যন্ত্রের শিকলে। তাদের স্বপ্ন প্রতিনিয়ত গলা টিপে হত্যা করে এক নির্দয় ব্যবস্থা, যা শাসনের নামে অন্যায়ের পোষক।
কিন্তু তবু থেমে থাকে না তারা।
কারণ তাদের ভেতরে জেগে থাকা অবিনাশী সংকল্প—যা তপ্ত মরুভূমিতেও জলস্রোতের মতো ধেয়ে আসে।
তাদের বিশ্বাস কেবল ধর্মীয় বা রাজনৈতিক নয়,
বরং এক অস্তিত্বময় যুক্তি—
স্বাধীনতা, সম্মান ও সমতার জন্য লড়াইই হচ্ছে বেঁচে থাকার শ্রেষ্ঠতম সংজ্ঞা।
নগরের বুকে মাথা তুলে দাঁড়ানো অট্টালিকাগুলো যতই ঔদ্ধত্যে আকাশ স্পর্শ করুক না কেন,
তাদের ছায়ায় ঢেকে যায় না জনতার গর্জন।
কারণ একদিন সেই নীরবতা ছিন্ন করে,
দুর্বার প্রতিরোধের স্ফুলিঙ্গ ফেটে পড়ে প্রাচীরে প্রাচীরে। জনতার চেতনাসঞ্চারিত কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠে যুগের ভাষ্যকার!
ধ্বংস করে দেয় অন্যায়ের মৌন জড়তা।
তারা চায় এক স্বদেশ,
যেখানে নিঃশ্বাসে থাকবে মুক্তির সুবাস,
শ্রমে থাকবে সম্মানের আশ্রয়,
আর প্রতিটি স্বপ্নের আকাশ থাকবে উন্মুক্ত।
এই যাত্রা সহজ নয়, রক্তাক্ত ইতিহাসের ছায়া ছুঁয়ে যায় প্রতিটি পদক্ষেপ,
তবু তারা নতি স্বীকার করে না।
কারণ তাদের লড়াই ক্ষুধার গ্লানির চেয়ে ঊর্ধ্বে,
তাদের সংগ্রাম এক ন্যায্য, মর্যাদাপূর্ণ মুক্ত রাষ্ট্রের জন্য।
যেখানে নাগরিকত্ব কেবল আইনি সংজ্ঞা নয়,
এটি একটি আত্মমর্যাদাশীল সত্তার প্রতীক।
এই শহর যতই বিমুগ্ধ বিভার মুখোশ পরে থাকুক না কেন—একদিন কাঁপবে সেই জনতার পদধ্বনিতে,
যারা অবশেষে লিখে দেবে এক স্বচ্ছ নতুন ইতিহাস।
==========