আজ কাকভোর সকালে হঠাৎ ঘুম থেকে জেগে গেলাম। বাইরে তখনো কুয়াশা ভেজা অন্ধকার! এক গ্লাস পানি খাবো ভেবে গ্লাসটার দিকে তাকাতেই দেখলাম সেলফোনটাতে এক লাইন ম্যসেজ, “Khokon is no more”, এমন একটা কিছু, চোখ ঝাপসা হয়ে গিয়েছিলো। ওই সেল ফোনটা আমি আর ছুঁইনি সারা দুপুর। ল্যান্ডফোনে চেষ্টা করলাম, ওরা সবাই ব্যস্ত, তোকে নিয়ে ওরা কবরস্থানে গেছে!


তোকে আমি মনে রাখবো !


তুই যে আমার চেয়ে দেখতে অনেক সুন্দর ছিলি, তুই যে আমার চেয়ে অনেক সপ্রতিভ ছিলি ... সেই যে গ্রামীণ মেয়েরা তোকে ওদের গোল্লাছুট খেলায় নিতে আসতো আর আমাকে অগ্রাহ্য করতো, আমাকে ভোদাই বিশেষণে ভুষিত করতো। শুধু মাত্র এগুলোই নয়, আরো হাজার লক্ষ কারণে আমি তোকে মনে রাখবো।


তোকে আমি মনে রাখবো !


আমি অল্পভাষী বলে সেই যে ক্রিসেন্ট রোডের টেডি বয়গুলো আমাকে যন্ত্রণা করতো, একদিন সেটা দেখে তুই  হকি স্টিক নিয়ে ওদের’কে অশ্রাব্য গালি দিতে দিতে গ্রীনরোড তক ধাওয়া করেছিলি! তারপর ওরা আর কোনোদিন আমার দিকে সিগারেটের বাট ছুঁড়ে মারেনি, ইতর কথা বলেনি।


তোকে আমি মনে রাখবো !


সেই যে আমি একটি মেয়ের পিঠের ফিতে নিয়ে একটা অসমাপ্ত  কবিতা লিখেছিলাম,  সেটার মার্জিনে ভাঙা ভাঙা পেনসিল স্কেচ, সেই পাতাটা  ড্রয়ার থেকে বের করে বাবা মাকে তুই দেখিয়ে দিয়েছিলি, বাবা আমাকে তিন শত বার কান ধরে ওঠা বসা করিয়ে ছিলেন, আর মা রাতের বেলা আমার মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে রাধাকে অমন করে পাওয়া যায়না, অথবা একবার ভেবে দ্যাখ্, অপু কি কখনো লীলা’কে নিয়ে অমন কিছু লিখতে পারতো, ইত্যাদি বাণী শুনিয়েছিলেন, সেগুলো আমি ভুলবো কী করে?


আমি-তুই দুজনা ভিন্ন মানুষ ছিলাম। তুই যখন আগরতলা মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং নিচ্ছিস, আমি তখন আমেরিকায় নাইট শিফটে লেদ মেশিন চালাচ্ছি, আমার পেনফ্রেন্ড প্রফেসার 'তুঙ্গে'র কাছে চিঠি লিখছি, উনি যেন আগরতলায় তোকে সাহায্য করেন। উনি ট্রেনে করে তোকে দেখতে গিয়েছিলেন, তোকে আর্থিক সাহায্য করেছিলেন।


তোকে আমি মনে রাখবো !


তুই যখন বুয়েটের নজরুল ইসলাম হলের বার্ষিক ম্যাগাজিনের সম্পাদক হবার জন্য ইলেকশানে দাঁড়িয়ে ছিলি, তুই যে সাহিত্যের “স” জানিস না, সেটা জানা সত্যেও আমি তোকে ভোট দিয়েছিলাম, আমার রুমমেট আর আমার সিনিয়ার ক্লাসের বন্ধুদের দিয়ে তোকে ভোটে জিতিয়ে দিয়েছিলাম।


তুই যে তোর ম্যাগাজিনে আমার একটা কবিতা প্রকাশ করেছিলি, যেটার প্রথম ছত্রটা ছিলো অনেকটা এরম, “জীবনকে কি যে ভাবি মনে মনে জানিনাতো জানিনাতো”!


সেটা পড়ে একজন জুনিয়ার ক্লাসের অজানা অপরিচিত ছেলে এসে আমাকে বলেছিল, “আপনিতো ভাই খুব সুন্দর কবিতা লেখেন, আমাদের নয়া পল্টনে আমরা একটা ম্যাগাজিন প্রকাশ করি, আপনি ওটাতে লিখবেন?” সেই সুন্দর মতো ছেলেটা আমাদের মা’য়ের পরে আমার প্রথম মুগ্ধ পাঠক! তার চার পাঁচ বছর পরে আমেরিকায় ফের আরেকজন সেটা পড়ে বলেছিল, “তুমি কবিতা লেখোনা কেন বলেছিলে? আমারতো বেশ লাগলো” সেই কথাটা আমি তোকে বলিনি। এই সব ঘটেছে, তোর জন্য, সব তোর জন্য! আমি তোকে ভুলে যেতে পারি কখনো?


তুই যেখানেই থাকিস, তুই যেন ভালো থাকিস, মনেপ্রাণে তোর শান্তি কামনা করছি। ভয় পাসনা, আমি তোর সংসারের পাশে থাকবো, এবার সত্যিকারের বড় ভাই হয়ে। অবশ্য আমিও হয়তো আবার তোর কাছে চলে আসছি, আমরা আবার দুজন দুজনকে হিংসা করবো, ফের প্রাণ দিয়ে ভালোও বাসবো। আমিও আজকাল শেষ বেলার পদধ্বনি শুনি! তোর চলে যাওয়ার শব্দটা যেন সেই পদধ্বনির ফ্রিকোয়োন্সিটা আরো দ্রুত করে দিলো আজ থেকে! ভালো থাকিস ভাই আমার!