বাংলা বানান নিয়ে অনেক আলোচনা-পর্যালোচনা হচ্ছে বিভিন্ন মহলে। অনেক মত-পথ কমে এখন আমাদের সামনে তিনটি মতে এসে ঠেকেছে-


১. সংস্কৃত ব্যাকরণ অনুসরণ করে সকল শব্দের ক্ষেত্রে একই নিয়ম। এ মতের পক্ষে রয়েছেন অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।


২. বাংলা শব্দগুলোকে দু'ভাগে ভাগ করে একভাগে তৎসম শব্দ এবং অন্যভাগে অতৎসম সকল শব্দ। তৎসম শব্দের জন্য এক নিয়ম (সেখানে অনেক নিয়মনীতির বেড়াজাল) আর অতৎসম শব্দের জন্য অন্যনিয়ম অর্থাৎ অন্য শব্দের বানানকে সহজ করা হয়েছে। সব ক্ষেত্রে হ্রস্ব-ইকার ও হ্রস্ব-উকার এবং ষ ও ণ উঠিয়ে দেয়া। এটাই বাংলা একাডেমীর প্রমিত বানানরীতি।


৩. সকল ক্ষেত্রে বানান সহজীকরণ। অর্থাৎ তৎসম ও অতৎসম সকল শব্দের বানানে দীর্ঘ স্বর থাকবে না।


আমি দেখছি, মাঝের পথটা কঠিন। ১ম ও ৩য় মতটা সহজ, হয় সংস্কৃত ব্যাকরণ অনুসরণ করে সব ধরনের শব্দের জন্য একই নিয়ম অর্থাৎ নিয়ামানুসারে হ্রস্ব ও দীর্ঘ স্বরের ব্যবহার। না হয় কোথাও দীর্ঘস্বর থাকবে না।


শুধু তৎসম শব্দের জন্য কুলীনতা- এটাও একধরনের বর্ণবাদ। আধুনিক যুগে এমন নিয়ম মানতে আদতেই ঘৃণা লাগে। আমরা সামাজিকভাবে জাতিভেদ প্রথা প্রবর্তন করে রেখেছি। কী অদ্ভুত! সেই প্রথা আমরা আমাদের ভাষাতেও রেখে দিয়েছি। এটা আসলেই অন্যায় এবং সংস্কৃত পণ্ডিতদের কারসাজি। খোদ রবীন্দ্রনাথও তৎসম শব্দ ও সংস্কৃত ব্যাকরণ বাংলা ভাষায় প্রবর্তন নিয়ে ভীষণ ক্ষুব্ধ ছিলেন।


বাংলা বর্ণমালা সমৃদ্ধ। যদি দীর্ঘ স্বরকে লোপ করে সব ক্ষেত্রে হ্রস্ব স্বর চিহ্ন বা বর্ণ ব্যবহার করা হয় তাহলে বাংলা বর্ণমালা থেকে অনেকগুলো মৌলিক ধ্বনি হারিয়ে যাবে এবং বিভিন্ন বিদেশি শব্দের প্রকৃত উচ্চারণ বাংলা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। এ ক্ষেত্রে আমার মত হলো, তৎসম ও বিদেশি শব্দের জন্য হ্রস্ব ও দীর্ঘ স্বরচিহ্ন/বর্ণ ব্যবহার। বাকি অন্যান্য শব্দ (তদ্ভিদ ও দেশি)-এর জন্য হ্রস্ব স্বরচিহ্ন/বর্ণের ব্যবহার। অধ্যাপক সিরাজুল ইসলামও এ মতের কাছাকাছি মত ব্যক্ত করেন।


তবে বিশৃঙ্খলা থেকে বাঁচতে আপাতত বাংলা একাডেমীকে অনুসরণ করার পক্ষে আমি।


আমরা যে বানানরীতিটি গ্রহণ করবো সেটাই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। প্রাচীন সাহিত্য নতুন কোন বানানরীতি প্রবর্তনের প্রতিবন্ধক হতে পারে না। সেগুলোর বানানও নতুন বানানরীতি অনুযায়ী হয়ে যাবে।


কিন্তু আমরা যে মতই পোষণ করি না কেন, তা তখনই প্রয়োগ করা ঠিক হবে, যখন এটা সার্বজনীন হবে এবং যথাযথ কর্তৃপক্ষ এটা গ্রহণ করবে। নইলে সবাই সবার মত বানান লিখতে শুরু করবে এবং ভীষণ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে, যেমনটা এখন কোলকাতায় হচ্ছে।


আমি বাংলা একাডেমীর বানানরীতির অনেক বিষয়ের সাথে একমত নই। তারপরও মেনে নিচ্ছি একতার স্বার্থে। আমরা যদি বাংলা বানানকে সহজ, স্বাভাবিক ও গতিশীল করতে চাই; তাহলে আসুন সবাইকে নিয়ে একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করি এবং চেষ্টা করি বাংলা একাডেমীর মত কোন কর্তৃপক্ষকে সাথে রাখতে অথবা নতুন আরেকটি কেন্দ্র তৈরি করে সকলের মাঝে আমাদের চেতনা জাগিয়ে দিতে।