(১)
তোমার চোখ দুটি প্রভাতের আলোকিত দুটি নারিকেল বন
অথবা চাঁদের আলো পিছনে ফেলা দুটি বারান্দা
যখন হাসো, চোখ দুটিতে লতা-গুল্মেরা পাতা মেলে দেয়
আলোর নাচন ওঠে … চাঁদ যেমন নদীতে সাঁতার কাটে
সবুজের মাঠে মাঠে ভরা যৌবনের হিল্লোল, হেমন্তের দুটি সোনালী ধানের ক্ষেত
পথের দু-ধারে রোদেলা দুপুরে মেলে দেয়া সোনালী আঁশের চিকচিকে সারণী
দিনের স্তব্ধতায় নদীতে দাঁড় টানার কলতান
ভরা আকাশে যেমন মিট মিট তারকার কাঁপন …
অস্বচ্ছ দুঃখের কুয়াশায় ডুবে যায় তারা
সন্ধ্যাগমের হাত ধরে মৃদু-সমুদ্র-সন্তরণের মতন
শীতের ঘনিষ্টতায়, হেমন্তের ঠকঠকানি
আরো মৃত্যু ও জন্ম, আরো অন্ধকার ও আলো
আমার আত্মা শিউরে উঠা অবধি ফুঁপানো আর্তনাদ
আকাশকে আলিঙ্গনরত এক আদিম অনুপ্রাণন
চাঁদ দেখে ভীত শিশুর উত্তেজনা
মনে হয় কুয়াশার খিলানে ঢাকা পথগুলিতে মেঘেদের চিৎকার
ফোঁটায় ফোঁটায় বৃষ্টিতে গলে যায় …
যেন আঙুরলতা ঘেরা বাগানে বাচ্চাদের চাপা হাসি
বৃষ্টির গান
গাছে গাছে নীরবতায় পাখিদের কলতান …
টাপুর টুপুর বৃষ্টি
ঝরে বৃষ্টির ফোঁটা


(২)
মৃদু মেঘেদের মাঝে হাই তোলে সন্ধ্যাতারা
এখনও ভারী অশ্রুর নদী বয়ে যায়
ঘুমের আগে শিশুর অসংলগ্ন বকবকানির মতো
যেন মা’কে একবছর আগের ঘুম থেকে জাগাতে চেয়েও পারেনি
তাকে যেন বলা হয়েছিল, কথা বলতেই থাকো
'কালকের পরে, সে ফিরে আসবে আবার …
অবশ্যই তাকে ফিরে আসতে হবে আবার
তবুও তার খেলার সাথিরা ফিসফিসিয়ে বলে, মা সেখানে আছেন
ঐ পাহাড়ের ওপারে চিরতরে মৃত্যুসম ঘুমিয়ে আছেন
তাঁর চারপাশে পৃথিবীর আহার, বৃষ্টির পান করা
এক হতভাগ্য জেলের জালগুলো জড়ো করার মতো
অভিশপ্ত পানি ও অভিশপ্ত নিয়তি
আর ডুবন্ত চাঁদে এক বিক্ষিপ্ত গান
টাপুর টুপুর বৃষ্টি
টাপুর টুপুর বৃষ্টি


(৩)
কোন দুঃখকে বৃষ্টি উজ্জীবিত করতে পারে, তুমি কি জান ?
পতিত ধারা কেমনে নর্দমায় বয়ে যায়, তুমি কি জান ?
বৃষ্টিতে এক নিঃসঙ্গ লোক কিভাবে হারায়, তুমি কি জান ?
অন্তহীন, ইতস্তত রক্তের মতো, ক্ষুধার্ত মানবতার মতো, ভালোবাসার মতো
বাচ্চাদের মতো, মৃতের মতো, অন্তহীন-অবিরাম বৃষ্টি


দুটি চোখ তোমার সমুদ্রভ্রমণে নিয়ে যায় আমাকে
বঙ্গোপসাগর পেরিয়ে অন্তর-অলিন্দ-ছোঁয়া মাতৃভূমির তট জুড়ে বিজলিচমক
তারাদের সাথে এবং বারুদের সাথে
একটি ভোর যেমন সরে যেতে চায় এবং রাত এসে রক্তের চাদরে ঢেকে দেয়
আমি বঙ্গোপসাগরকে কেঁদে কেঁদে বলি
“হে বঙ্গোপসাগর, মুক্তোদানা, বারুদ এবং মৃত্যুর দাতা”
প্রতিধ্বনিত উত্তর যেন বিলাপ করে
'হে বঙ্গোপসাগর, বারুদ এবং মৃত্যুর দাতা’


আমি প্রায়ই অন্তর-অলিন্দ-ছোঁয়া মাতৃভূমিতে বজ্রপাতের শব্দ শুনতে পাই
পাহাড় এবং সমতলে সঞ্চিত বজ্রপাত
পুরুষেরা যদি সিলমোহর ভেঙে দেয়
বাতাসেরা বদ্বীপ ছেড়ে সামুদের সন্ধানে যেতো না
আমি প্রায়ই নারিকেল বৃক্ষের বৃষ্টি পানের শব্দ শুনতে পাই
গ্রামীণ বিলাপ শুনি এবং প্রবাসীদের আর্তনাদ শুনি
দাঁড় বেয়ে, পাল তুলে বঙ্গোপসাগরে সংগ্রামরত
দমকা হাওয়া, বজ্রপাত, গান চলে
বৃষ্টি … বৃষ্টি …
টাপুর টুপুর
ঝরে বৃষ্টি …


(৪)
অন্তর-অলিন্দ-ছোঁয়া মাতৃভূমিতে ক্ষুধা আছে
নবান্ন উৎসবে এখানে শস্য ছিটানো হয়
কাক, পঙ্গপাল এবং পেটুক রাক্ষসেরা গোগ্রাসে গিলতে পারে
ফসলের গোলা ও প্রস্তর শিলাগুলো পিষে যায় এবং চূর্ণ হতে থাকে
ক্রান্তিকালের পুরুষদের সাথে শস্যের কলগুলো মাঠে মাঠে ঘোরে …
টাপুর টুপুর বৃষ্টি
টাপুর টুপুর
ঝরে
যখন বিদায় নিতে রাত এসেছিল, কত অশ্রু ঝরেছিল
বৃষ্টিকে দোষ এড়ানোর অজুহাত বানানো হয়
টাপুর টুপুর বৃষ্টি
টাপুর টুপুর বৃষ্টি
শিশু ছিলাম তাই
দিন-রাতের আকাশ মেঘলা হতো
বৃষ্টির অঝোর ধারা নেমে আসতো
পৃথিবী যখন সবুজ হয়, ক্ষুধা তখন বদ্বীপে আঘাত হানে
অন্তর-অলিন্দ-ছোঁয়া মাতৃভূমি, ক্ষুধা ছাড়া কাটেনি সময়
বৃষ্টি …
টাপুর টুপুর বৃষ্টি …
টাপুর টুপুর, ঝরে …


(৫)
প্রত্যেক বৃষ্টির ফোঁটায়
পুষ্পদানা হতে অঙ্কুরিত লাল কিংবা হলুদ রঙের কুঁড়িরা
ক্ষুধার্ত ও উলঙ্গ মানুষের প্রতিটি অশ্রুবিন্দু ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরানো হয়
আর ক্রীতদাস চাষাদের রক্তের ছলকে পড়া প্রতিটি ফোঁটায়
একটি নতুন প্রভাত হাসবে বলে
এক শিশুর ঠোঁটদ্বয়ে গোলাপ-রাঙা স্তনবৃন্ত
আগামী দিনের তরুণ বিশ্বে জীবন আনবে যে
টাপুর টুপুর
ঝরে … বৃষ্টি, বৃষ্টিতে …
অন্তর-অলিন্দ-ছোঁয়া মাতৃভূমি একদিন পুষ্পিত হবে, ফুলে-ফলে ভরে যাবে
আমি বঙ্গোপসাগরকে কেঁদে কেঁদে বলি
“হে বঙ্গোপসাগর, মুক্তোদানা, বারুদ এবং মৃত্যুর দাতা”
প্রতিধ্বনিত উত্তর যেন বিলাপ করে
'হে বঙ্গোপসাগর, বারুদ এবং মৃত্যুর দাতা’


(৬)
বঙ্গোপসাগরের ফেনিল ঢেউয়ে ঢেউয়ে অনেক উপহার, ভারী উজ্জ্বল
ছড়িয়ে দেয়া উগ্রতার ফেনা ও বারুদের স্তুপ
দুর্গত-নিমজ্জিত শরনার্থীর অগণিত কঙ্কাল
যারা অন্তহীন মৃত্যুর সুধা করেছিল পান
বঙ্গোপসাগরের তলদেশ হতে, নীরবতার জমিন হতে
আর অন্তর-অলিন্দ-ছোঁয়া মাতৃভূমিতে একহাজার গোখরা অমৃত পান করে
একটা ফুল হতে শিশির নিয়ে গঙ্গা, তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র পরিপুষ্ট হয়
আমি প্রতিধ্বনি শুনি
বেজে উঠছে বঙ্গোপসাগরে
'বৃষ্টি …
টাপুর টুপুর, ঝরে বৃষ্টি …
টাপুর টুপুর ঝরে'


প্রত্যেক বৃষ্টির ফোঁটায়
পুষ্পদানা হতে অঙ্কুরিত লাল কিংবা হলুদ রঙের কুঁড়িরা
ক্ষুধার্ত ও উলঙ্গ মানুষের প্রতিটি অশ্রুবিন্দু ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরানো হয়
আর ক্রীতদাস চাষাদের রক্তের ছলকে পড়া প্রতিটি ফোঁটায়
একটি নতুন প্রভাত হাসবে বলে
এক শিশুর ঠোঁটদ্বয়ে গোলাপ-রাঙা স্তনবৃন্ত
আগামী দিনের তরুণ বিশ্বে জীবন আনবে যে
এবং বৃষ্টির অঝোর ধারা এখনও নেমে আসে


(ইরাকের স্বনামধন্য কবি বদর সাকির আল-সায়্যাব, ১৬২৬-১৯৬৪, কর্তৃক লিখিত কবিতার ইংরেজি অনুবাদ “Rain Song” অবলম্বনে রচিত।)


ফিরোজ, মগবাজার, ২৮/০৯/২০১৯