এখন এই বিশাল ব্রহ্মপুত্র নদের কিনারে আছে শুধু এক নারী আর এক নর। আর আছে একখানা সারিন্দা আর অতীতের কত সেই সঙ্গীতের স্বর।


খলখল করে বয়ে চলে ব্রহ্মপুত্র জল। মনসুর তাকিয়ে থাকে চাঁদের দিকে অপলক চোখে। ঝুরঝুর করে পারিজাতের ফুল ঝরে পড়ে জগতে। কিন্তু মাটিতে সে ফুল পড়ে বৃশ্চিক হয়ে যায়।


উত্তাপ অতল জলের বুকে অকস্মাৎ মনসুর বয়াতি, সারিন্দাকে ছুড়ে দেয়। বলে-


'শোনো শোনো কন্যা, আমি কহি যে তোমারে,
আইজ বিসর্জন দিলাম আমি আমার সারিন্দারে। আর না করিব গান, তোমার কানে লো ডংশিয়া। চায়া দ্যাখো ওই বুঝি যায় আমার যা ছিল ভাসিয়া।' কেঁদে উঠে চাঁদ বলে-


'বিয়া হইছে লোকে জানে, কবুল পড়ি নাই, আমারে যে চেতনহারা কইরাছিল ওষুধ খাওয়াই। পতি বলি ডাকি নাইরে লোকের চক্ষে যিনি পতি। তোমারেই সকল দিছি, তুমিই আমার গতি।'


'এমন কথা কইও না কন্যা, সমাজ মন্দ কবে। নারীর কবুল বিয়ার কবুল জানিতে কে চায় কবে? এ সংসারে নারীর অন্তর কেবান স্বীকার করে? পুরুষ নাহি জানে কন্যা, আগুন ঘরে ঘরে। নারীর সে আগুনে নারী নিজে পুইড়া ছাই। আমার কী বা সাধ্য আছে জগৎ বদলাই? আমি কবি, পারি শুধু রচিতে যে পদ আর বচন। তাহাতে যদি বা হয় বিশ্বের চেতন।


নিজের জীবন দিয়া আমি ইতি করলাম পালা। কঠিন এ জগতে আমি জুড়াইলাম জ্বালা।'


এত বলে মনসুর বয়াতি ঝাঁপ দেয় ব্রহ্মপুত্র জলে। লোকসকল, এই সেই ব্রহ্মপুত্র একদিন বরফের শিলারাশি হিমালয় হতে সরুলখা ধারা হয়ে নেমেছিল, মানুষের সবুজের দেশ তার খলখল জলোচ্ছ্বাসে ভাসিয়ে ডুবিয়ে কালো পলিতে পলিতে ধান্য বীজের গর্ভ উর্বরা করে, তারপরে লক্ষ ঢেউ হাতে করতালি দিয়ে সাগরে ঝাঁপাতো। আজ তার খাত নাই, জল নাই, বীজের থলিও বন্ধ্যা, শুধু কালো কাদায় পায়ের চিহ্ন পথিকের ধরে।


বন্ধু, লয়া যাও, লয়া যাও-বলে চাঁদ সেই ব্রহ্মপুত্রে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে।


স্রোতের টানে ভেসে চলে কন্যার মুখ। আকাশের চাঁদ আজ ধরণীতে নেমে, জলে ভেসে যায়। জোয়ারের জলে ভাসে পদ্মফুল, আর তার পাশে পাশে ভাসে দুটি জন। আগে ভাসে সারিন্দা, তারপরে মনসুর বয়াতি, আর বয়াতির পরে ভাসে পূর্ণিমার লাশ। স্রোতের টানে ভাসে গান ও গায়ক, প্রেম ও বিচ্ছেদ, মৃত্যু ও মিলন ভাসে, ভেসে যায়, খরস্রোতে সকলই তো দরিয়ার দিকে ভেসে যায়।


আ, এই পানি যায়, পানি যায়, দূরে যায়, দরিয়ায়। ও কি পানি? রে পানি? ও কি কাহারো কমল চক্ষেরও পানি রে? পানি যায়, বহে যায়, দরিয়ায়।


ব‌ই : বুকঝিম এক ভালোবাসা
কবি— সৈয়দ শামসুল হক