হে শহর, হে প্রিয় শহর, হে অন্তরঙ্গ আমার,
তুমি কি আমাকে পাঠাতে চাও বনবাসে?
নইলে কেন এই উত্তেজনা তোমার সমগ্র সত্তা জুড়ে?
কেন এই আয়োজন, দাঁতে-দাঁত-ঘষা আয়োজন
প্রহরে প্রহরে? হে শহর, তুমি কি বাস্তবিকই
নির্বাসন বরাদ্দ করেছ আমার জন্যে?


হে শহর, হে প্রিয় শহর, হে মোহিনী আমার,
দেখি এখন তুমি আমার চোখে চোখ রেখে
তাকাতে পারো কি না।
এই তো আমি তোমাকে দেখছি পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে,
তোমার চোখ কেন মাটিতে নিবদ্ধ?
কেন এই অস্বস্তির দ্বিধা তোমার চোখে?
তাহলে কি আমি বুঝে নেব যে তোমার চোখ
আমাকে আর চাইছে না?
তাহলে কি আমাকে একথা মেনে নিতে হবে যে,
যে-তুমি আমার শৈশবকে চেটে চেটে বয়স্ক করেছ,
যে-তুমি আমার যৌবনকে ঢেকে দিয়েছ রাশি
রাশি কৃষ্ণচূড়ায়,
যে-তুমি আমার চল্লিশোত্তর আমাকে শাণিত করেছ,
সেই তুমি আমার বিষয়ে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছ মনে-মনে?


হে শহর, হে আমার আপন শহর,
তোমাকে ঘিরে আমার কিছু স্মৃতি কাননবালার মতো গান গায়।
তোমার কি মনে পড়ে না একদা কী দিন রাত্রি ছিল আমার?
আমি তোমার বুকে মাথা রেখে
গলা ছেড়ে গান গাইতাম নির্দ্বিধায় প্রহরে প্রহরে।
আমিই তো ছিলাম প্রথম আবিষ্কারক তোমার সৌন্দর্যের।
তোমার সৌন্দর্যের শপথ, আমার আগে অন্য কেউই
এমন মজেনি তোমার সৌন্দর্যে।
তুমি কি ভুলে গেছ সেসব উথাল-পাথাল মুহূর্ত,
যখন দু’পায়ে তুমি আমাকে আঁকড়ে ধরতে আর আমি
তোমার স্পন্দিত স্তনে মুখ রেখে একটা মদির স্বপ্ন হয়ে যেতাম?
আমার আঙুলের বাঁশি তোমার মাংসের স্তরে স্তরে
সুর জাগিয়ে তুলত, তুমি কি ভুলে গেছ?
তোমার কি মনে পড়ে না
তোমার জন্যে কী অক্লান্ত ছুটে বেড়াতাম সূর্যোদয় থেকে
সূর্যাস্তের দিকে,
যেমন প্রাচীন গ্রিক দেবগণ পশ্চাদ্ধাবন করতেন
সুন্দরীদের প্রান্তরে প্রান্তরে, বন-বনান্তরে?
আহ্‌ কী দিন রাত্রি ছিল একদা আমার।


তোমার কটিদেশে হিংস্রতার আস্ফালন দেখতে পাচ্ছি।
তোমার আস্তিনের অন্ধকারে কোনো বাঘনখ লুকিয়ে নেই তো?
তোমার ঝলমলে আংটির গহ্বরে ক’ফোঁটা কালো জহর
জমা করে রেখেছ আমার জন্যে?
তোমার মনের অলিগলিতে কোনো দুরভিসন্ধি নেই,
এ-কথা আজ আমি জোরাল কণ্ঠে উচ্চারণ করতে পারছি কই?


শহর, হে প্রিয় শহর আমার, হে বিশ্বাসঘাতিনী
ইদানীং তুমি আমাকে বড় বেশি সন্দেহপ্রবণ করে তুলেছ।
তোমাকে নির্ভয়ে আলিঙ্গন করতে পারছি না আর,
চুম্বন এঁকে দিতে পারছি না তোমার রক্তিম ওষ্ঠে-
এ এক চরম শাস্তি যা আমাকে খাচ্ছে কেবলি।
এই যে তোমার সঙ্গে কথা বলছি এই দারুণ আড়ালে,
কে জানে কেউ আড়ি-পেতে শুনছে কিনা আমাদের এই কথাবার্তা!
কে জানে ক’জন পঞ্চ ব্যঞ্জনপুষ্ট ঘাতক এখন তৈরি হচ্ছে গুপ্ত আস্তানায়,


যেখানে মৃত্যু তার ভোগ নিতে আসে,
যেখানে দাঁড়কাকের মতো কী একটা পাখা ঝাপটায় সর্বক্ষণ
যেখানে হাজার হাজার মৃন্ময় বদনা নরমুন্ড হয়ে নাচে
জ্যোৎস্নায়?
ওরা কোনো যূপকাঠ নির্মাণ করছে কিনা ঘোর অমাবস্যায়,
কে আমাকে বলে দেবে?


বুকের রক্ত ঝরিয়ে
যে-বাগান গড়ে তুলেছি দিনের পর দিন,
তুমি তার প্রতিটি ইঞ্চি তছনছ করে দিয়েছ এক অন্ধ ক্রোধে।
একদা যেসব সুন্দর উপহার তুলে দিয়েছিলে আমার হাতে,
নিজের হাতেই তুমি আজ সেগুলি
ছিনিয়ে নিতে চাও আবার? আমার বুকের মধ্যে
যে রুপালি শহর জেগে থাকে তার আশ্চর্য কলরব নিয়ে,
সেখানে তুমি পাথুরে স্তব্ধতা ছড়িয়ে দিতে চাও
কিসের নেশায় হে শহর আমার, হে ভয়ংকর ভাস্কর?


তোমার কাছে গোলাপ প্রার্থনা করে আমি নতজানু,
তুমি কেন ক্যাকটাস ছুড়ে দাও?
তোমার চোখে দেখছি ফলের সম্ভার, পোকাকীর্ণ শব,
বিবাহবাসর, ঘাসঢাকা গোরস্থান, নবজাতকের তুলতুলে শরীর,
বৃদ্ধের তোবড়ানো গাল, যুবকের মসৃণ চিবুক, মরা মাছ,
উড়ন্ত মরাল, কংকালসার মহিষ, যুবতীর গ্রীবা, পোড়ো বাড়ি,
সতেজ ডালিয়া আর লুটেরার লোভী হাত আর সন্তের চোখ,


হে শহর, হে আমার আদরিণী বেড়াল,
এ তোমার কেমন ঢঙ বলো তো?
যেন তোমাকে আমরা খেতে দিইনি কোনো দিন
সকালবেলার আলোর মতো দুধ,


যেন তোমার নরম পশমে আঙুল ডুবিয়ে বসে থাকিনি
ঘণ্টার পর ঘণ্টা,
যেন তোমার চোখে চোখ রেখে বলিনি মনে রেখো!


হে শহর, হে প্রিয় শহর, হে অন্তরঙ্গ আমার,
তুমি কি সেই ভীষণ দলিলে সই করে ফেলেছ,
যার প্রতাপে আমি কাঁদব দীর্ঘ পরবাসে?
আমার সঙ্গে কোনো ছলাকলার প্রয়োজন নেই,
তুমি অসংকোচে উচ্চারণ করতে পারো নিষ্ঠুরতম ঘোষণা-
আমি রৌদ্রমাখা ধ্বংসস্তূপের মধ্য দিয়ে হেঁটে চলে যাব
প্রতিবাদহীন, কোনো অভিমানকে প্রশ্রয় না দিয়েই।
তবে যাবার আগে
আমি তোমার সবচেয়ে ভয়ংকর রূপও দেখে নিতে চাই, হে
বিশ্বাসঘাতিনী।
আমি অপেক্ষা করব,
তোমার নীলচক্ষু বৎসদের সকল খেলা গোধূলিতে মিলিয়ে গেলে,
আমি তোমার ওষ্ঠে চুম্বন এঁকে
সৌন্দর্যের ভিতরে মৃত্যু এবং মৃত্যুর ভিতরে সৌন্দর্য দেখে যাব,
আমি সন্তের মতো অপেক্ষা করব উপবাসে দীর্ঘকাল।


   (ইকারুসের আকাশ কাব্যগ্রন্থ)