যে-কোনো দিনেরই মতো তিমিরের নাড়ী-ছেঁড়া আলো
ব্যাপক ছড়িয়ে পড়ে। একটি তরুণী
লাল নীল ঘুড়ি
ছেড়ে দেয় বায়ু স্তরে; বিকেলে চায়ের কাপে প্রফুল্ল চুমুক,
ঘোরানো সিঁড়িতে গাঢ়-মিহি স্বরে কথোপকথন,
ছাদের ওপারে ছিল জ্বলজ্বলে ডাগর বেলুন,
চাঁদ বলি তাকে। কবি তাঁর
শব্দের ঝর্ণাকে ব্যালে শিক্ষকের ধরনে নিপুণ
পরিচালনায়
মোহন গন্তব্যে পৌঁছে দেন। এখানে আগুন নিয়ে
দ্যুতি, বলে তাঁকে গাছপালা,
নীড়ে-ফেরা পাখি, অস্তরাগময় শহরে কলোনি।


অকস্মাৎ চতুদিকে দৃষ্টি-অন্ধ করা কী বিপুল
উদ্ভাসন; মাটিতে আগুন,
লতাগুল্ম, গাছে-গাছে গোলাপের, চামেলীর পরাগে আগুন,
পাথরে-পাথরে লকলকে
জিভের মতন জ্বলে আগ্রাসী আগুন,
পশুপাখি, মানুষের ভেতরে আগুন, অন্তরীক্ষে,
জলের ওপরে আর ভেতরে আগুন জ্বলে; যেন এ-শহর
পরেছে চকিতে উরু, জানু, বুক, মাথা
জুড়ে আগুনের শাড়ি। মর্ত্যভূমি বজ্ররশ্মিজালে
বন্দি হয়ে চোখের পলকে রূপান্তরে কী উত্তপ্ত ভস্মাধার।


সাইরেন বড় মূক, ঘোষণা করার মতো কোনো
কণ্ঠস্বর নেই
এখন কোথাও। সংখ্যাহীন ঝলসানো গোরু-ঘোড়া
মাঠে কি গোয়ালে, আস্তাবলে পড়ে আছে
ইতস্তত ভীষণ নিষ্প্রাণ, প্রভুভক্ত কুকুরের ক্ষয়ে-যাওয়া
নিঃস্পন্দ শরীর সমর্পিত
নগ্ন বারান্দায় নৈবেদ্যের মতো। নিস্তব্ধ বসন্ত, পাখিদের
অজস্র কংকাল নগ্ন গাছে-গাছে। এমনকি পাথরের নিচে যতো
প্রাণী টিকে থাকে প্রতিহিংসার মতো,
তারাও এখন চিহ্নহীন।


মাটি আর দেবে না কিছুই। কোনোখানে এক ফোঁটা
জল নেই ভয়ানক দূষণ ব্যতীত। ফলমূল
কোথাও নির্দোষ নেই আর। খাদ্য আছে শস্যাগারে,
অথচ ভক্ষণযোগ্য নয় এককণা।


তেজস্ক্রিয় ভস্মের ঘোমটা-টানা পৃথিবীর ঠোঁটে,
রোদ চুমো খায় পুনরায়। কিন্তু এই রোদ নিয়ে
উৎসব করার মতো কোনো প্রাণী নেই।
দশ দিকে। মহাজন অথবা ঘাতক, গৃহী কিংবা
ঘরছাড়া চিরপলাতক, জুয়াড়ী অথবা নববিলাসের
টানে সাতঘাট জল-খাওয়া বাবু, দূরন্ত সাহেব,
অথবা পটের বিবি, বেশ্যার দালাল,
তুখোড় দোকানদার অথবা খদ্দের,
ট্রাফিক পুলিশ কিংবা ধাবমান যান,
মুর্দা কিংবা মুর্দাফরাস কারুরই
নামগন্ধ নেই।
যোজন যোজনব্যাপী ধুধু চরাচরে। ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে
থরে থরে সাজানো কৌটায়,
নানান রঙের জামা কাপড়ের ভাঁজে ভাঁজে আর
কার্পেটে পাপোষে মৃত্যু বুঁদ হয়ে আছে। ক্ষণে ক্ষণে
ঠোঁট চাটে টুপ ভুজঙ্গ মৃত্যু, যেন
নিজেকেই আকণ্ঠ করবে পান। চতুর্দিকে ক্রুর দাবদাহ,
বস্তুত পৃথিবী পঞ্চতপা।


হঠাৎ ভূতল থেকে কেউ
উঠে আসে হামাগুড়ি দিয়ে কায়ক্লেশে আদিম শিশুর মতো,
পারে না তাকাতে ঝলসিত পৃথিবীর দিকে, চোখ
তুলতেই দ্যাখে একজন এক টুকরো আনন্দের মতো ফল
বাড়িয়ে দিয়েছে তার প্রতি রমণীয় ভঙ্গিমায়।
নারী আর পুরুষের তীব্র থরো থরো
আলিঙ্গনে আদিগন্ত নগ্ন স্তব্ধতায়
আনন্দ-বেদনা জাত কবিতার মতো হেসে ওঠে ভালোবাসা।


   (অবিরল জলভ্রমি কাব্যগ্রন্থ)