কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের যত দুঃখ
============================


অভিজাত-বংশের জমিদারপুত্র রবীন্দ্রনাথ। সোনার চামচ মুখে নিয়ে যার জন্ম। বাইরের রবীন্দ্রনাথ এবং ভিতরের রবীন্দ্রনাথ। বাইরের রূপ জমিদার এবং ভেতরের রূপ একজন সংবেদনশীল মানুষ ও কবি। এরই মধ্যে রয়ে গেছে জানা-অজানা রবীন্দ্রনাথ।রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দুই ছেলে ও তিন মেয়ে। তারা হলেন শমীন্দ্রনাথ, রথীন্দ্রনাথ, মাধূরী লতা বা বেলা, রেনুকা বা রানী ও মীরা বা অতশী। রবীন্দ্রনাথের পিতা মহর্ষী দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও মাতা ছিলেন সারদা দেবী।
রবীন্দ্রনাথকে আমরা জানি একজন সুখী মানুষ, একজন জমিদারের ছেলে, যার কোনো অভাব- অনটন নেই, সম্মানীয় ব্যক্তি, কবিও একজন নিবিড় প্রেমিকের মাত্রায়। অথচ তাঁর ব্যক্তিগত জীবন ছিল দুঃখ ও শোকে ভারাক্রান্ত। মাত্র ১৩ বছর বয়সে তিনি মাতৃহারা হন। তার বিয়ের রাতে তার জ্যেষ্ঠ ভগ্নিপতি সারদা প্রসাদ মারা যান। এর চার মাস পর তার সবচেয়ে প্রিয় বৌদি কাদম্বরী দেবী, যিনি তাকে মাতৃহারা বেদনা ভুলিয়ে ভালোবাসা ও পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে কবি হয়ে ওঠার প্রেরণা জোগাচ্ছিলেন, ঠিক সে সময় তিনি আফিম খেয়ে আত্মহত্যা করেন। মাত্র ৪১ বছর বয়সে শেষ হয়ে যায় রবীন্দ্রনাথের দাম্পত্যজীবন। ১৯০২ সালে তার স্ত্রী মৃণালিনী দেবী মারা যান। রেখে যান তিন মেয়ে ও দুই ছেলে। বেলা ও রেনুর বিয়ে হয়ে গেলেও রথী ও মীরা তখন নাবালক। ছোট ছেলে শমী ছিল একেবারে শিশু। রবীন্দ্রনাথের স্ত্রী মৃণালিনী দেবী মারা যাওয়ার পর রানী (রেনু) খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে। এই মেয়েকে তিনি বিয়ে দিয়েছিলেন সত্যেন্দ্রনাথের সঙ্গে। যাকে তিনি নিজের পয়সায় বিলেত পাঠিয়েছিলেন ডাক্তারি পড়তে। মৃত্যুপথযাত্রী এই কন্যা রানীকে বহু চেষ্টা করেও বাঁচানো যায়নি। রানীকে হারাবার পর ১২ বছরের শমী তখন বন্ধুর সাথে মুঙ্গেরে বেড়াতে যায়। সেখানে শমীর কলেরা হয়। কলেরায় শমী মারা যায়। কবির আদুরে মেয়ে মাধুরী লতা বা বেলা যাকে কোলেপিঠে করে তিনি মানুষ করেছিলেন, তাকে বিয়ে দিয়েছিলেন কবি বিহারী লালের ছেলে শরৎচন্দ্রের সাথে। বিয়ের পর রবীন্দ্রনাথ শরৎকে বিলাতে পাঠিয়েছিলেন পড়তে। বিলাত থেকে ফিরে এসে মেয়ে এবং তার জামাই শরৎচন্দ্র জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে চার বছর ছিলেন। এই ঠাকুরবাড়িতে শরৎচন্দ্রের সাথে কবির ছোট জামাই নগেন্দ্রনাথের বিবাদের সূত্র ধরে শরৎচন্দ্র বাড়ি ছেড়ে স্ত্রীকে নিয়ে চলে যান। এরপর রবীন্দ্রনাথের সাথে শরৎচন্দ্রের সম্পর্কের ইতি ঘটে। এই টানাপড়েনের মধ্য দিয়ে বুকভরা অভিমান নিয়ে বেলা মৃত্যুর দুয়ারে গিয়ে পৌঁছে। এমন সময় বেলার অসুখ খুব খারাপের দিকে চলে যায়। রবীন্দ্রনাথ প্রতিদিন গাড়িতে করে গিয়ে মেয়েকে দেখে আসতেন। বাবার হাত ধরে মেয়ে বসে থাকত। তখন কবি বিহারী লালের ছেলে শরৎচন্দ্র টেবিলের ওপর পা রেখে সিগারেট খেয়ে রবীন্দ্রনাথের প্রতি অপমানকর মন্তব্য করত। আর সে অপমান নীরবে সহ্য করে রবীন্দ্রনাথ দিনের পর দিন মেয়েকে দেখতে যেতেন। একদিন দেখতে গেছেন বেলাকে, কিন্তু মাঝপথে শুনলেন বেলা মারা গেছে। মেয়ের মৃত্যু সংবাদ শুনে তিনি আর ওপরে উঠলেন না। মেয়ের শেষ মুখটি না দেখে ফিরে এলেন বাড়িতে।


তাঁর ছেলে রথীন্দ্রনাথ লিখেছেন বাড়িতে এসে তাঁর মুখে কোনো শোকের ছায়া নেই। কাউকে বুঝতে দিলেন না কী শোকে, কী অসহ্য বেদনার মধ্য দিয়ে তিনি সন্তানকে হারিয়েছেন। এভাবে রবীন্দ্রনাথের জীবনের প্রতিটি আঘাত হয়ে উঠত বেদনাভরা বিষণ্ণতার গান। মানুষের জীবনে দুঃখ আছে, মৃত্যু আছে কিন্তু পৃথিবী এক জায়গায় দাঁড়িয়ে নেই। পৃথিবী অনন্তের দিকে ধাবিত। এটাই রবীন্দ্রসঙ্গীতের মূল সূর। তবুও আমরা চলব, জীবন চলবে। অনন্তের সন্ধানী রবীন্দ্রনাথ, দুঃখ এবং মৃত্যুকে জয় করে জীবনকে করেছেন জীবন্ত।
কবির ছোট মেয়ে মীরার বিয়ে হয় ১৩ বছর বয়সে। রবীন্দ্রনাথ নারীমুক্তি আন্দোলন করেছিলেন কিন্তু মেয়েগুলোকে বিয়ে দিয়েছিলেন খুব অল্প বয়সে ১২-১৩, কারো বা ১১ বছর বয়সে। মীরার বিয়ে হয়েছিল নগেন্দ্রনাথের সাথে। বিয়ের পর কবি নগেন্দ্রনাথকে আমেরিকায় পাঠিয়েছিলেন কৃষিবিদ্যা শেখার জন্য। রবীন্দ্রনাথের ইচ্ছা ছিল স্বদেশের কৃষিকাজের উন্নতিকল্পে নগেন্দ্রনাথকে কাজে লাগাবেন। কিন্তু নগেন্দ্রনাথ বিদেশে থাকাকালীন রবীন্দ্রনাথের কাছে বারবার চিঠি লিখতেন, আমার টাকার দরকার, আমার টাকার দরকার। উত্তরে রবীন্দ্রনাথ লিখতেন আমার জমিদারি থেকে  আমি যে টাকা প্রাপ্ত হই, পুরোটাই তোমাকে দিয়ে দেই।


রবীন্দ্রনাথ মেয়েগুলোকে যাদের হাতে সম্প্রদান করেছিলেন তারা কিভাবে টাকার জন্য চিঠি লিখে তাকে তাগিদ দিত,কত যে নিষ্ঠুর আচরণ করত এবং রবীন্দ্রনাথ কিভাবে এসব অপমান নীরবে সহ্য করতেন তা আমরা তার বিভিন্ন লেখায় জানতে পারি।
"ছোট জামাই নগেন্দ্রনাথ আমেরিকা থেকে গ্র্যাজুয়েশন করে ফিরে আসেন ঠিক কিন্তু মীরার ভাগ্যে বেশি দিন স্বামীসঙ্গ লাভ হলো না। মীরা এক ছেলে ও এক মেয়ের মা হওয়ার পর নগেন্দ্রনাথ খ্রিষ্টান হয়ে মীরাকে ছেড়ে চলে যান। মীরার ছেলে নীতুকে রবীন্দ্রনাথ প্রকাশনা শিল্পে শিক্ষার জন্য জার্মানিতে পাঠান, কিন্তু কবির এমনই দুর্ভাগ্য মাত্র ২০ বছর বয়সে নীতু ক্ষয় রোগে (যক্ষ্মায়) আক্রান্ত হয় এবং রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর নয় বছর আগে নীতু মারা যায়।
এতগুলো মৃত্যুর বেদনা পার হয়ে বুকে অসহ্য যন্ত্রণায় কবি কী করে সৃষ্টিশীলতার মধ্যে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন তা ভাবতেও অবাক লাগে। কবি যেমন দুঃখকে নিবিড়ভাবে অনুভব করেছেন, তেমনি সে দুঃখের ঊর্ধ্বে ওঠার প্রচণ্ড চেষ্টা তার গান এবং কবিতার মধ্যে প্রতিফলিত হয়েছে। সব বেদনা ও দুঃখ অতিক্রম করে কবি এক অসাধারণ শক্তিবলে সারা জীবন নিত্য-নতুন সৃষ্টির আনন্দে মেতে থেকেছেন, জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত ও দুঃখ বেদনাকে আনন্দে রূপান্তরিত করেছেন।
ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো ছিলেন রবীন্দ্রনাথের বান্ধবী। বিদেশিনী এই মহিলা রবীন্দ্রনাথকে খুবই ভালোবাসতেন। ওকাম্পোকে তিনি একটি বাঙালি নাম দিয়েছিলেন বিজয়া। তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব ছিল প্রগাঢ়। একপর্যায়ে তাদের ঘনিষ্ঠতা আরো বাড়ে এবং তাদের প্রেমকাহিনী নিয়ে নানা ধরনের বইও প্রকাশিত হয়েছে। ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত গানটি হলো
‘আমি চিনি গো চিনি তোমারে ওগো বিদেশিনী’।

রবীন্দ্রনাথের মধ্যে একজন অভিমানী বালক চিরকালই কাজ করেছে। যদিও তিনি বলেছেন তার গানে ‘নয় নয় এই মধুর খেলা’ কিন্তু দুঃখের এই দেয়া-নেয়া খেলাটিও তিনি চিরকালই খেলেছেন। তিনি যে কত দুঃখের ভেতর দিয়ে জীবন কাটিয়েছিলেন তা বাইরের রবীন্দ্রনাথকে দিয়ে বোঝা যায় না। যেকেউ বড়মাপের কবি হন বা ছোটমাপের কবি হন, সবাই সমাজের একটি স্বীকৃতি চায়, মূল্যায়ন চায়, রবীন্দ্রনাথ বহু দিন সেটা বাঙালি সমাজের কাছে পাননি। এ দুঃখবোধ তার মধ্যে সব সময় ছিল। কারণ নোবেল পুরস্কার (১৯১৩ খ্রি:) পাওয়ার পর যখন তাকে সংবর্ধনা দেয়া হলো তখন তিনি বললেন, ‘আমি এই সম্মানের পাত্রকে ওষ্ঠ পর্যন্ত তুলব কিন্তু গলা পর্যন্ত ঢুকতে দেব না।’ কত বড় অভিমান ও দুঃখ নিয়ে মানুষ এ কথাটি বলে তা আমাদের এতোবছর পরেও ভাবতে অবাক লাগে।