মা, তোমার জন্য পথ চাওয়া শেষ হয়নি
তোমার আসবার পথে তাকিয়ে থেকে কাঁদতে কাঁদতে আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম
জেগে দেখি তখনো তুমি আসো নাই
তবে তোমার আসবার আগেই এসেছিল এ দেশের কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা
আমি তখন স্বাধীনতার মানে বুঝি না,
যুদ্ধ নামের রাজনীতির খেলা বুঝি না,
মানুষ নামের নরপিশাচ চিনি না।
আমার জন্মদাতা পিতাকে চিনেও আমি চিনি না, কেবল তোমাকেই চিনি,
তোমাকেই ঘিরে আমি হাত উঁচু করে বলি তুমিই আমার রূপসী বাংলা।  
তখন আমি তোমার আদর খাওয়া বুঝি,
তোমার কোলজুড়ে ঘুমিয়ে থাকা বুঝি,
খবরের কাগজ বুঝি না,
সাংবাদিকতা বুঝিনা, তুমি সাংবাদিক সেলিনা পারভিন, তাও বুঝি না
তোমার জন্যে পথ চাওয়া বুঝি
এটুকু বুঝি ;রাত্রির ঘণ অন্ধকার পেরিয়ে তুমি আমার কাছে আলো হয়ে এসে আমাকে ভাসাও।


এমনি করে বহমান সময়ের মাঝে এদেশটায়
থাবা মেললো হায়েনার দল
তুমি লিখলে অজস্র কষ্ট কান্না,
বুকের ভেতরে কষ্ট আর আগুনকে চাপা দিয়ে এগোলে একপুরী মায়াকে কাঁধে করে।
ডিসেম্বর ১৩, ১৯৭১।
দুপুরের কিছুটা আগে আমাকে গোসল করানো কালে ওরা তোমাক নিয়ে গেলো!


তারপর!
তোমার জন্যে পথ চাওয়ায় আমার শৈশব কৈশোর তারুণ্য যৌবন পেরিয়ে বার্ধক্য এলো
কেবল ডিসেম্বর এলে খবরের কাগজে তুমি আসো
তোমার বিভৎস বিকৃতদেহ উদ্ধার নিয়ে নানা প্রতিবেদন চোখে পড়ে
প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ানে লেখা হয়ঃ
"মাটির ঢিবির পাদদেশে চোখ বাঁধা ক্ষত-বিক্ষত একটি মেয়ের লাশ পড়ে ছিলো !!
তার স্তনের একটি অংশ কাটা ;
লালছে দগদগে জমানো রক্তে সারা শরীর ভেজা!  মেয়েটির নাক ও মুখের কোন আকৃতি নেই, নরপিশাচরা অস্ত্র দিয়ে খুঁচিয়ে তুলে ফেলেছে !!"


আমার কষ্টটা বাড়ে, দুঃখ হয়
কেন যে আমি ওই অত্তো ছোট্টটি ছিলাম তখন?


বড় হয়ে আমি কীইবা করতে পারলাম, মা!!
দেশটাকে তো আর তোমার স্বপ্নের মতো পারিনি বানাতে, তেমন করে কে'ই বা এগিয়ে এলো?
তাই আমি নিঃসঙ্গ হতে হতে ক্রমশঃ হয়ে গেছি নিঃসঙ্গতর
বেঁচে থেকে আর কী লাভ পৃথিবীতে?
_________________________
★লেখাটি শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস/২২ এ রচিত। লেখাটি শহীদ বুদ্বিজীবী সাংবাদিক সেলিনা পারভিন ও তাঁর পুত্র সুমন জাহিদকে নিয়ে। সুমন জাহিদেরও গলাকাটা লাশ পাওয়া যায় রেললাইনে। তিনি ছিলেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে একজন সাক্ষী ★