ভোরের প্রথম আলো যখন জানালার ফাঁক গলে ঘরে প্রবেশ করে, তখন শুভ্রর ঘুম ভাঙে। সে চোখ মেলে চেয়ে থাকে ছাদের ফ্যানটির দিকে, যা ধীরে ধীরে ঘুরছে, অথচ তার ভেতরের অস্থিরতাকে থামাতে পারছে না।

কতগুলো বছর পেরিয়ে গেছে, সে হিসেব রাখেনি। রাখার প্রয়োজনও পড়েনি। জীবন তার কাছে কেবল এক দীর্ঘ শ্বাসের মতো, যা প্রতিটি মুহূর্তে বুকের ভেতর জমে থাকে, কিন্তু কখনোই মুক্তি পায় না।

তার ছোটবেলা কেটেছে স্বপ্ন নিয়ে—সে চেয়েছিল একদিন বড় হবে, মা-বাবার মুখে হাসি ফোটাবে, এমন কিছু করবে যাতে মানুষ তাকে মনে রাখে। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে স্বপ্নগুলো একে একে ঝরে পড়েছে গাছের শুকনো পাতার মতো।

একটা সময় সে সত্যিই লড়াই করেছিল। রাত জেগে পড়াশোনা করত, চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতি নিত, ভবিষ্যতের জন্য নিজেকে গড়ে তুলতে চেয়েছিল। কিন্তু সমাজের কঠোর বাস্তবতা তাকে প্রতিবার এক ধাক্কায় ফেলে দিয়েছে। প্রতিবারই সে উঠতে চেয়েছে, কিন্তু চারপাশের লোকেরা যেন তাকে টেনে নামিয়েছে নিচের দিকে।

তার বাবা বলেছিলেন, "সৎ পথে থাকলে একদিন জিতবে।" কিন্তু শুভ্র দেখল, চারপাশের অন্যরা অসততা, প্রতারণা আর চাতুরীর মাধ্যমে সফলতার শিখরে পৌঁছে যাচ্ছে। আর সে? সে প্রতিবার সত্যের পাশে দাঁড়িয়ে পরাজিত হয়েছে।

একদিন এক বন্ধুর মুখে শুনেছিল— "এখন যোগ্যতা নয়, কৌশলই জীবন।" কথাটা শুনে তার মনে হয়েছিল, সত্যিই কি এই সমাজে স্বপ্নের কোনো মূল্য নেই?

একটা সময় তার ভেতরের আগুন নিভে গেল। সে লড়াই করা ছেড়ে দিল, স্বপ্ন দেখা বন্ধ করল। এখন কেবল দিন কাটানো তার কাজ। প্রতিদিন সকালে উঠে এক কাপ চা হাতে নিয়ে জানালার ধারে বসে থাকা, আর বাইরে তাকিয়ে দেখা—লোকেরা ব্যস্ত জীবনে ছুটছে, কিন্তু তার কোনো গন্তব্য নেই।

আজও সে জানালার পাশে বসে। চোখের সামনে সূর্য উঠছে, পাখিরা ডানা মেলে উড়ছে। কিন্তু শুভ্রর মন পড়ে আছে তার সেই পুরোনো স্বপ্নগুলোর পাশে—যেগুলো একসময় আকাশ ছোঁয়ার জন্য তৈরি হয়েছিল, অথচ বাস্তবতার নিষ্ঠুর বাতাসে তারা ঝরে গেছে, নিঃশেষ হয়ে গেছে।

তার জীবন এখন এক "নির্বাসিত স্বপ্ন"—যা কখনো বাস্তবের আলো দেখেনি, শুধু দগ্ধ হতে হতে ধুলোয় মিশে গেছে।