দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে, কংক্রিটে আগুন ছড়ায়,
খিদের ভাষা বোঝে না কেউ, শহর ব্যস্ততায় খোয়ায়।
ফুটপাতে পড়ে আছে একটা মানুষ, আধভাঙা চাদরে ঢেকে,
চোখে বিষণ্ণ অন্ধকার — ক্ষুধার গর্জন বুক ফেঁকে।
কেউ বলে, “পাগল হবে”, কেউ হাসে মুখে ছ্যাঁকা দিয়ে,
কেউ ব্যস্ত মোবাইল স্ক্রোলে, কেউ ডুবেছে লাভের হিড়িকে।
শুধু সে জানে রাত নামলে, তার পেট জ্বলে ঘায়ে ঘায়ে,
আর কুকুরটা পাশে শুয়ে ভগবানের মত মাথা চায়।
সে ছিল কৃষকের ছেলে, রোদ্দুরে পাকা ধানের গন্ধ ছিল তার শিরায়,
ভূমির প্রেমে বাঁধা পড়েছিল, যত্নে জোগাড় করত জল-হাওয়া-ছায়া।
কিন্তু একদিন হাওয়ার নাচে নদী উঠে এল গাঁয়ের প্রাণে,
ফসল ভেসে গেল লাশের মতো — আর কিছু রইল না বাঁচার টানে।
খালি হাতে এল শহরে, হাতে ছিল এক চিলতে মাটি,
মায়ের দেওয়া ঠাকুরের মন্ত্র, আর বাবার ছেঁড়া ঘাঁটি।
ভেবেছিল, কাজ পাবে, ঘর পাবে, হাঁসির মতন ভাত পাবে,
কিন্তু শহর তার গলা চেপে বলল — “তুই কি ভিখারির বাচ্চা তবে?”
তবুও চেষ্টা করে সে — ইঁট টানে, বাঁশ তোলে, পাঁজি গোনে,
মাস গেলে মজুরি কাটে, কারখানার পয়সা খোলে না কপোলে।
একদিন পড়ল অসুখ, গায়ে আগুন, পেটে শূন্যতা ঠাঁই নেয়,
হাসপাতালে বলে, “বেড নাই”, আর লাল টিকিট তার কপালে সেঁটে দেয়।
তারপর থেকে পথ তার ঠিকানা, পেট তার প্রতিবাদ করে,
শুধু জ্যোৎস্না বোঝে তার কান্না, যখন হাওয়ায় শীত জ্বলে।
আর প্রতিটি রাতে যখন ধনী শিশুরা খেলনায় ঘুমায় সুখে,
সে তখন আকাশের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে এক অভিশাপে:
"যারা ভাত ফেলে দেয় আবর্জনায়, তাদের সন্তানের মুখে লাগুক সে মাটি,
যারা রুটি কাড়ে শ্রমিকের হাত থেকে, তারা শোনো — ঈশ্বরও কাঁদে রাতি।
হে শাসকেরা, তোমরা রাজপ্রাসাদে যাদের নিয়ে জলখাবার খাও,
একদিন দেখো — তোমার শিশুরাও পেটে খিদে নিয়ে মরে যায়, দাও দাও দাও!”
এই শহর জানে না সে কি ভাবে দুঃস্বপ্ন জোগায় প্রতিদিন,
এক অনাহারী যখন পাথরের মাঝে ঘুমায়, তাতে জন্ম নেয় শত কৃশ চিত্ত-প্রবীণ।
জেগে উঠে অভিশাপ, ভাতের খিদের মতো কর্কশ,
তার চিৎকার — তোমার বিলাসের ভিতরে গোপন ভয়াবহ এক কল্পকথার গ্রন্থ।
আজও সে বেঁচে আছে, নাম নেই, কাগজে নেই, ভোটে নেই,
শুধু তার ক্ষুধা আছে, তার অভিশাপ আছে, আর অন্ধকারের বুক ফাটিয়ে যায় এক স্নেহহীন "হেই!"
ভবিষ্যতের কপালে জ্বলজ্বলে সেই আগুন আঁচড় দেয়,
যখন শিশুরা পিঠে বই না নিয়ে খোঁজে— “মা, আজ কিছু খেতে দেবে?”
হে সমাজ, হে সভ্যতা,
তোমার ছেঁড়া নীতির পরতে লুকিয়ে থাকা এই নরক-গাথা
ভবিষ্যতের চোখে একদিন লিখে যাবে —
"খিদের দেশের সংবিধানে
ভাত না পেলে গণতন্ত্র মরে —
আর অভিশাপে জন্ম নেয় এক অনাহারীর প্রলয়..."