একদা এক ভিখারি ছেলে, জীর্ণ বসনা গায়ে
বলে- ‘দাও মোরে দুটি টাকা, তব খোদার রাহের তরে,
তিন দিন ধরে আছি অনাহারে, ঘরে বোনটি কাঁদে
অসহায় তরে কিছু দিলে তবে, খোদার রহম পাবে।’


শুধিলাম বাছা, ক’খানা ছোরা, পকেটে তোমার আছে?
কয়জনারি পকেট কেটে, আসিয়াছ মোর পরে!
তাই শুনে ছেলে আঁখি জল করে, তাকায় আরশ পানে
ক্ষণ দূরে গিয়ে দুটি টাকা চায়, অন্য পথিক জনে।
মনে ভাবলাম, একি করলাম! কেইবা বলতে পারে
হয়তো ক্ষুদ্র দুইটি টাকায়, কোন মনিষীর প্রাণ বাঁচে।


দিন চার পরে, তেমাথার মোড়ে, ব্যাটা এসে পড়ে পায়ে
বলে 'স্যার, আজ কিছু না দিলে, ছাড়বনা তোমারে,
ঘরে বোনটি ভুগছে জ্বরে, দানা পানিও যে নাই
তোমার দয়ায় হয়তোবা তার- জীবন বাঁচানো যায়।’


পাষাণ হৃদয় সব ভুলে যায়, শুধুই স্বার্থ খুঁজে
অসহায় তরে কিছু দিলে পরে, তার তর কি সহে!
দিয়ে দুই লাথি, বুক সোজাসোজি-বললাম,'শালা হারামি
তোদের জ্বরের ভাইরাস কি, সবার ঘরে ছড়াবি?
জ্বর হলে পরে, শুয়ে থাক ঘরে, সেইটাই বলে ডাক্তারি
অন্য লোকে জ্বর ছড়ালে, আখেরাতে কি পার পাবি!’


জুম্মার শেষে,দিন কয় পরে,গোর পাড়ে গিয়ে জিয়ারতে
দেখি বাছা বসে- নয়ন জোড়া, ভাসাইতেছে আনমনে,
হেরিলাম,'ওহে,কার শোকেতে, করেছ অশ্রু সজল?’
বলল,‘ও স্যার,বোনটি আমার ছেড়ে গেছে এই ধরাতল।’
দিয়ে টাকা দশ, বললাম ওহে, ‘পেটে গিয়ে কিছু দাও’
মলিন বদনে হেসে বলে- ‘ওটা তুমিই নিয়ে যাও।’

ভাবলাম, এই দশটি টাকা, দিতাম যদি আগে
হয়তো অনাথ শিশুটিকে আজ, যেতে হতোনা গোরে।
মানব জাতির এই বড় গুন, ভুলে যায় সব ভুল
নইলে কি আর বাঘ-হাতি মেরে, আনন্দে মশগুল!


তারপর এক বিকেল বেলা- পাড়া জুড়ে শুনি শোর
চিৎকার করে বলছে সবাই, ধরা পড়েছে চোর,
দুটি পাকা আম, এইতো প্রমাণ, ব্যাটা সেই ভিখেরি
পড়শিরা বলে এমনি করেই, করছে নিত্য চুরি।


বললাম আমি, ‘ডাণ্ডা মেরে, ভাঙলে কয়েক হাড়
চোর ব্যাটাদের ভূত তাড়াতে, জুড়ি মেলা তার ভার’-
নিয়ে ডাণ্ডা, সেজে পাণ্ডা, বেধে দুই পা উপর,
দিয়ে কয় ঘা, সেজে বাহাদুর, বুকেতে মারি চাপড়।
বাছা অসহায়, বলে- ‘মাফ চাই, করবোনা চুরি আর’,
তাই শোনে শোনে জনতারা সবে, হরষে যে চিৎকার!


দুই হাত দিয়ে করজোর করে, বলে- ‘বাবা মরে যাব
যদি বল তবে সারাটা জীবন, কৃতদাস হয়ে রবো।’
তবুও সীমারের হলনা দয়া, কেউ দিলনা অম্ভ
নাক-মুখ সব ফেনিল হল, তবুও- কাঁপলনা আরশ স্তম্ভ!


দুই চোখ বেয়ে গড়ে নুনা জল, সিক্ত করে ভূ-তল
চিৎকার দিয়ে কেঁপে-কেঁপে শেষে, পিঞ্জিরা হল অচল।
জনতার রোষ, স্তব্ধ নিমিষ, সব করে হাহাকার
বিবেকের বাণে ক্ষত হয়ে মোর, আঁখি জোড়া হল ভার।


বুঝলাম আমি, করে পাপাচার, রাঙ্গিয়ে দুহাত খুনে
জেলের সেলে দুচোখ ভাসাই, আপন কর্ম বানে-
কত অন্যায়, কত’না জুলুম, করেছি জীবন ভর
নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থ বাঁচাতে, আপন করেছি পর।
সারাটা জীবন- ভরা ছিল ভুল, অন্যায় ছিল সীমাহীন
এত অপরাধ করেও হয়নি, অনুসূচনা কোন দিন।
গারদের এই লোহার খাঁচার, আধারে বসে ভাবছি
চক্ষু থেকেও সারাটা জীবন, অন্ধ হয়েই থেকেছি!


জেলের সেলে পিষ্ট হয়ে, বুঝেছি অবশেষে
মানব হৃদয় কভুও কোন, অন্যায় নাহি সহে,
বুঝেছি শেষে, দানবী মনের, রোমশ থাবার ভয়ে
মানবী এ মন কাঙ্গাল হয়ে, নিভৃতে শুধু কাঁদে!


পাষাণ হৃদয় সবই বুঝে, তবুও করে যায় ভুল
নইলে হয়তো একটি শিশুও, হতোনা ছিন্নমূল।