"ধন্যবাদ কবি" - এই দুটো শব্দই আমার মূল আলোচ্য বিষয়।


একটি মানুষ প্রথম শিষ্টতা শেখা শুরু করে তার জীবনের প্রারম্ভে, শিশুকালে বাবা-মা'র কাছে। এরপর শিখতে থাকে তার অগ্রসরমান জীবনের প্রতিটি ধাপে। শিক্ষক, আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধব, বন্ধুদের পরিবার, কর্মক্ষেত্রে, সাহিত্যে, শিল্পে, রাজনীতি, ধর্ম, আসর-অনুষ্ঠানে, জীবনের প্রবাহমান বহুদা শাখা প্রশাখায়। সুললিত আন্তরিক শিষ্টতা মানুষকে মানুষের কাছে আকর্ষণীয়, বন্ধুত্বপূর্ন, সুমিষ্ট রূপে উপস্থাপন করে, গ্রহনযোগ্য করে। আমি প্রচুর পশ্চিমা চলচ্চিত্রে দেখেছি, কেউ যদি কোনো মা'য়ের সন্তানকে চকোলেট বা খেলনা উপহার দেয়, এবং শিশুটি তার সরলতায় খুশী কিন্তু নীরব থাকে, তখন মা বলে, "কি বলতে হয় বাবা?" তখন, শিশুটির মনে পড়ে, মা যে শিষ্টতাটি শিখিয়েছিল তাকে এবং মিষ্টি করে বলে, "থ্যাংক ইউ"। এটি শিশুর ধন্যবাদ, প্রথম শিষ্টতার পাঠ।


এখন, বাঙালি অনেক সময় বলে, "দাদাভাই, শুকনো ধন্যবাদে তো  চলবে না"। এই "শুকনো" ধন্যবাদ চলতে পারে, কর্পোরেট জগতে, দোকানির সাথে, বাজারে মৎস-মাংস বিক্রেতার সাথে, পকেট থেকে টাকা ফুটপাতে পড়ে গেলে বা শাড়ির আঁচল রিকশার চাকায় যখন পেঁচিয়ে যাচ্ছে, তখন তাতে দৃষ্টি আকর্ষণ করে যে ব্যক্তি, তার সাথে। কিন্তু বাবা-মা'র উপহার, আদরে, বন্ধুর বন্ধুত্বে বা উপকারে বা শিক্ষকের আদর-উৎসাহ সহকারে পাঠদানের সফলতায়, আপনি শুধু শুকনো "ধন্যবাদ" কি বলতে পারবেন? না, পারবেন না। আপনি, "ধন্যবাদ! ধন্যবাদ! মিষ্টি আমার মা/বাবা!", "ধন্যবাদ বন্ধু!", "ধন্যবাদ স্যার!" তো বলবেনই, গভীর অনুভুতির অনুসঙ্গী হিসাবে, জড়িয়ে ধরবেন বাবা মা বা বন্ধুকে, করবেন করমর্দন এবং শিক্ষকের পা ছুঁয়ে তার আশির্বাদ-দোয়া নেবেন।


এবার বলি কবিদের শিষ্টতা। প্রকৃত কবিদের মন ও মনন শোভা, সহস্র সারি সারি বর্ণিল গোলাপ শোভিত বিশাল বাগানের যে সুষমা এবং সুরভি, একদম তার মতো। প্রকৃত কবিদের শিষ্টতা, রেশমী কোমল মখমল পরশ, মাখনের মতাে মসৃণ, মধুর মতো মিষ্টি, তুলতুলে পশমের অনুভব। আর কবিদের বৈশিষ্ট্য যদি বলি, ধার করি কবিতা আসরের শ্রদ্ধেয় কবি, কবি কবীর হুমায়ূনের কথা - "কবিরা উত্তম মানুষ, তাদের সব কিছু হয় সত্য সুন্দর"।


আমি এই কবিতা আসরকে বলি, "অনন্য এক আলোকিত কবিতার আসর!"। আমি যখন, খুঁজে পেয়ে এই স্বর্গ আলোকমালার মতো কবি ও কবিতার মেলা, আনন্দে আত্মহারা হয়ে ভীরু ভীরু মনে শামিল হলাম, যেনো চোখ ধাঁধানো কোনো অভিজাত রাজকীয় আসরে উপস্থিত আমি, তখন ভাবছি, "কে যে কি বলে!"। চারিদিক থেকে যেনো কানে আসছে, মন্তব্যের কথপোকথন, এর ঘরে, ওর ঘরে, জম্পেশ এক সম্রাটের দরবারের মতো, ঠিকরোচ্ছে যেন তার বিভা!। তারপর প্রকাশ করলাম প্রথম কবিতা, কিছুটা বেদনা নিয়ে, কারণ এই কবিতার রাজ্যদ্বার খুলেছে ১১ বছর আগে, আর আমি জানলাম এই আটটি মাস আগে! সে যে কি দুঃখ! যাই হোক, আমি মনে করেছি কেউ পড়বে না আমরা কবিতা! কিন্তু পড়লো, তবে মন্তব্য হলো না। কুছ পরোয়া নেই, দ্বিতীয় দিনের কবিতায় দেখি, দু'টি মন্তব্য জ্বল জ্বল করছে এবং আমি হতবাক, আমাকে এক কবি সম্বোধন করছে "প্রিয় কবি" এবং কোন কবি করছে, যিনি আসরে আছে তিন বছর ধরে এবং লিখে ফেলেছেন হাজারের ওপর কবিতা! এই শুরু হলো, সুমিষ্ট সম্বোধন পাওয়া, যা আজ, মাঝে মাঝে এমন পর্যায়ে যায় কবি বন্ধুত্বে, সম্মানে, মনে মনে লজ্জিত হয়ে পড়ি আমি নিভৃতে, আসরের প্রাজ্ঞ কবিদের কাছে! বকে দেই কবি বন্ধুদের বাড়াবাড়ির জন্য।


ফিরে আসি আমার প্রথম পদচারণার স্মৃতিতে। সেই প্রথম ক'দিনের মধ্যেই, আমার হতবাক মন একটি আশ্চর্য অনন্য পাঠ নিলো কবিতা আসরের দ্যুতিময় কবিদের থেকে, বিশেষ করে প্রাজ্ঞ অগ্রজ কবিদের থেকে। অনুভূত হলো, প্রকৃত সুনিবিড় সুমিষ্ট শিষ্টাচার সুধার শেকড়, প্রােথিত হয় এতটাই সত্তার গভীর গহনে অনড় দৃঢ়, যে প্রাজ্ঞ প্রকৃত অগ্রজ কবিদের নিভৃত প্রগাঢ় অহংকারও, সে শিষ্টতা মুছে দিতে পারে না। পাশাপাশি বহমান হয় সগৌরবে, কবিত্বের অহংকার, কবি'র শিষ্টতা। ঋদ্ধ অগ্রজ কবিরা, সে সুন্দর শিষ্টতার অনুভবে, নবীন কাঁচা বয়সী কবিদের সম্বোধন করেন "আপনি" এবং "কবি, প্রিয় বা প্রিয় কবি"। এই কবি শিষ্টতা মাধুর্য্যের কোনো তুলনা হয় না। এই তুলনাহীন শিষ্টতার উজ্জলতম উদাহরণ হলেন, আসরের শ্রদ্ধেয় কবি - "কবি কবীর হুমায়ূন, কবি অনিরুদ্ধ বুলবুল, কবি বিভূতি দাস, কবি শ.ম. শহীদ, কবি প্রনব মজুমদার, কবি মল্লিকা রায়, কবি গোপাল চন্দ্র সরকার, কবি প্রবীর চ্যাটার্জি" এবং তাঁদের মতো প্রাজ্ঞ অগ্রজ কবিগণ। (বলে রাখি, কবিরা কিন্তু চির সবুজ, চির দামাল কিশোর, মনের দিগন্তে!)


আধুনিক বাণিজ্যিক যুগের এই হুড়োহুড়ি ব্যস্ততা, মিডিয়াগুলোর অধীর চঞ্চলতা, শুদ্ধ সুমিষ্ট সম্বোধনের প্রাণরস শুকিয়ে কাষ্ঠরূপ করে দিয়েছে। শুধু প্রাণরসহীন, হৃদরক্ত উষ্ণতা বর্জিত - ধন্যবাদ আর ধন্যবাদ। যেনো রোবট কথা বলছে। কবি মনকে ছুঁড়ে দেয় যেনো অবজ্ঞার বেদন বালুচরে। আরো বেশী অনুভূত হয় সে বেদনা, যখন প্রাণের দ্বার উজার খুলে কবিতার প্রশংসা করি, আর তার বদলে ফিরে আসে - ধাতব ধ্বনির মতো ধন্যবাদ। যেনো জলে ঝাঁপ দিয়ে ডুবে মরা থেকে উদ্ধার করা ব্যক্তিটি, গায়ের জল ঝেড়েটেরে, ধন্যবাদ বলে বাড়ির পথ ধরলেন। এবং কখনো আসেই না কোনো প্রতিধ্বনি, যেনো অযোগ্য সে প্রাপ্তি'র, যার জন্য যেনাে কষ্টার্জিত খরচ বহন করতে হবে, অথবা মনে হয় কবি তো নই-ই, সৌখিন কবির কণা মূল্যও নেই ধন্যবাদ প্রাপ্তির। আমি এবং আমার সমবয়সী কিছু কবি বন্ধুরা, খুব প্রাণবন্ত মন্তব্য দানে, সম্বোধন আদান প্রদানে। আমি, আমার প্রিয় কিছু কবিদের "প্রিয় কবি" সম্বোধনের সাথে, আরো বিশেষণ যোগে সম্বোধন অলংকৃত করেছি, যেমন করেছেন দেখেছি, কবি প্রনব মজুমদার, সেদিন যেমন আমায় করলেন, "অনুভবের কবি"। এ সবই, কবিতা আসরের কবিদের মাঝে মুগ্ধকর নিবিড় বন্ধনের হৃদয়োষ্ণ প্রভাবক। "manners maketh man" and to add to it myself, i say, "when it comes to a Poet, specially a Bengali Poet, A Poet himself is an ultimate bearer of sublime manner or represents as such." (জানি না এর আগে এরকম কেউ বলেছে কিনা, এই আলোচনা লিখতে গিয়ে মাথায় quote-টি তৈরী হলো, কেউ না বলে থাকলে, বিখ্যাত হবার একটা সুযোগ থেকে গেলো!!)


অনেক কথা বলেছি, শুধু এই কথাটি বলতে, আসরে সম্বোধন আদান প্রদানে "কবি বা প্রিয় কবি" বলা বাধ্যতামূলক নয়। নয়, সে তো সবাই জানি! কিন্তু আমার সুলেল, সুরভিত, নরম আবেগী কবি মন, চিৎকার করছে, "আমরা কবি, আমরা উত্তম মানুষ, আমরা সত্য সুন্দর, আমরা আলোকিত হৃদয়!, আমাদের মানায় না, শুষ্ক কাষ্ঠবত আচরণ।" যদি ধন্যবাদ লেখা যায়, তবে তার সাথে আর দুটি অক্ষরও লেখা যায়, "কবি"। ধন্যবাদ কবি। প্রিয় কবি না হয় নাই বা বললেন। আমরা যারা ইতোমধ্যে, অগ্রজ কবিদের কাছে থেকে শিষ্টতার পাঠ নিয়েছি, তারা প্রিয় কবির উর্ধ্বে উঠে "কবিবন্ধু", "কবি প্রিয় আমার", এ রকম স্নেহশীল পর্বে উত্তরণ করেছি, যেনো আমরা আজ আত্মার আত্মীয়।


তাই আলোচনার শেষান্তে অনুরোধ, নতুন পুরোনো সকল কবিদের, "ধন্যবাদ কবি" - এই দু'টি মাত্র শব্দ, এটি আপনার কবিতায় মন্তব্য দানকারীর অতি সামান্যতম প্রাপ্তি প্রত্যাশা। আর যারা নীরবতাকেই "বাঙময়" মনে করেন, তাদের কিছু বলার নেই। আমরা সবাই ব্যস্ত, ব্যস্ততার অজুহাতে দু'টো শব্দ লেখা যাবে না, এটি কবিতার আসরে গ্রহনযোগ্য নয়, যেখানে প্রতিদিন মোবাইলে ফেইসবুক, ওয়াটস্ অ্যাপে আমরা তর্জনী মধ্যমা দিয়ে গড়ি অনন্ত শব্দের ফল্গুধারা! শেষে অগ্রজ কবিদের আরেকটি কথা ধ্বনিত করছি, প্রোফাইলে সত্য সুন্দর পরিচিতিও কবিদের মাঝে আন্তরিক বন্ধুত্বপূর্ণ সংযোগ স্থাপনে সহায়ক হয়। সকল কবিরা সুখী, সুস্থ্য, দীর্ঘ কবিতাময় জীবন যাপন করুন, এই শুভকামনা। ধন্যবাদ প্রিয় কবি।