আমায় ভাসাইলি রে, আমায় ডুবাইলি রে.....
                      (রম্যকথা --- দুই)
                     ____/// শ্যামল চৌধুরী


মাস সমাপনের প্রাক্কালে মধ্যবিত্ত চাকুরিজীবীদিগের মানসপটে শতসহস্র বাসনা উঁকি মারিয়া যায়। মাহিনা হস্তগত হইবার পর সেই অর্থের কিয়দংশ ব্যয় করিয়া মনপ্রাণে সন্তোষ সৃজন করে এইরূপ নান্দনিক হরেক রকমের কার্য সমাধা করিতে হইবেক, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজনদের সহিত সাক্ষাৎ করিতে হইবেক --- এইরূপ কত মনোবাঞ্ছা ঘুরপাক খাইতে থাকে।


মাস সমাপ্ত হইল, মাহিনায় পকেট ভারী হইয়া উঠিল। কার্যালয় হইতে গৃহে প্রবেশ করিয়া গৃহদেবীর সকাশে সমুদয় মাহিনা অঞ্জলি স্বরূপ নিবেদন করিলাম। গৃহদেবী যশস্বী গণিতবিদের সদৃশ হিসাবে নিমগ্ন হইয়া জানালা দিয়া আকাশের পানে বারংবার তাকাইয়া হিসাব কষিয়া সমুদয় মাহিনার নিটোল দেহ দক্ষ শল্য চিকিৎসকের ন্যায় সাংসারিক খরচের বিভিন্ন খাত মোতাবেক সুনিপুণভাবে ব্যবচ্ছেদ করিয়া বিভিন্ন অংশে বিভাজিত করিলেক।


অতঃপর গৃহিণী গৃহের ঘটিবাটি ঘাটিয়া, নাড়িয়া চাড়িয়া, ঝাঁকাইয়া ইহাদের ভিতরেরকার দ্রব্যসামগ্রী আন্দাজ কষিয়া, ললাটে চিন্তার ভাজ ফেলিয়া লেখনী ও পত্র লইয়া কি যেন  ধার্যকরণে আবিষ্ট হইলেক। ধার্যকরণ প্রক্রিয়া সম্পাদনের অব্যবহিত পরেই একদা স্মিত হাস্যে নিকটে আসিয়া লিখিত একটি দীর্ঘ শ্বেত পত্র আমার হস্তে প্রদান করিলেক।
জিজ্ঞাসা করিলাম, ইহা কি ?
গৃহিণী উত্তর প্রদান করিলেক, মাসিক প্রেমপত্র !


খুলিয়া দেখিলাম যৌবনে শেষ বৈকালিক প্রহরের ডাকপিয়ন হইতে প্রাপ্ত সেই বহু আকাঙ্খিত মধুময় প্রেমপত্র ইহা নহে !  ইহা বিষফল সদৃশ গাত্রদাহ উদ্রেককারী তাবৎ মাসের সাংসারিক নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ক্রয় করিবার ফর্দ।


আমার মস্তিষ্কের অভ্যন্তরে ঝিঁঝি পোকার ক্রন্দনের ন্যায় ঝিনঝিন করিয়া উঠিল, বুকের খাঁচায় সুরক্ষিত হৃদপিণ্ড ধপ্ ধপ্ করিয়া বিকট গতিতে নাচিয়া উঠিল --- কারণ আজিকার এই দ্রব্যমূল্যের ক্রমাগত উর্ধমুখী প্রবণতা হেতু নাভিশ্বাস উঠা পরিস্থিতিতে সমগ্র মাহিনার বৃহৎ অংশ আজিকেই তিরোহিত হইবে। এই কলিযুগে মধ্যবিত্তের জীবনটি মধ্যযুগীয় ক্রীতদাসদের জীবন সদৃশ অনুমিত হইল। এই উদরে অন্নে (পেটে ভাতে) চালিত মনুষ্যের মনে সন্তোষ জাগরণ ঘটাইবার অর্থ কোথা হইতে আসিবেক ? সৃষ্টিশীলতাহীন, বিনোদনহীন, আনন্দহীন টানাপোড়েনের মধ্যবিত্তের এই জীবনকে ধিক্কার জানাই।


কয়েক কিসিমে’র বস্তা এবং গৃহিণী কর্তৃক নির্ধারিত এবং প্রদেয় অর্থ লইয়া বাজারে গমন করিলাম। মুদির দোকানীকে শৈশবের ধারাপাত পঠনের মতোন ফর্দ দেখিয়া সুরে সুরে পণ্যসামগ্রীর নাম সমূহ জ্ঞাত করিলাম। মুদিও অনুরূপ ফর্দ তৈরী করিয়া আমাকে অর্থের অঙ্ক জ্ঞাত করিলে বিগত মাসের তুলনায় বর্তমান মূল্যের অঙ্কে বিস্তর ব্যবধান লক্ষ্য  করিয়া উচ্চস্বরে উষ্মা প্রকাশ করিলে মুদি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির ফিরিস্তি শুনাইতে লাগিলঃ
মহামারীর পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববাজারে সবকিছুর মূল্য ঊর্ধমুখী, জ্বালানীর মূল্য তথা পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধি, পণ্য পরিবহনে রাজনৈতিক দলীয় লোকজন, বিভিন্ন  সমিতি এবং শৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত বাহিনী দ্বারা চাঁদাবাজি, মধ্যস্বত্বভোগীদিগের দৌরাত্ম, দুর্যোগ পরিস্থিতিতে সরকারী পণ্যকর অটুট রাখা, মজুদদার ব্যবসায়ী সিণ্ডিকেটের সহিত রক্ষকদের সখ্যতা, সড়কের বেহাল অবস্থা প্রভৃতি কারণে পণ্যমূল্যের দিনদিন উর্ধগতি ঘটিতেছে জানাইল মুদি। বিশ্ববিদ্যালয়ের মেঝেতে মুদির পদযুগল স্পর্শ না করিলেও উহার দ্রব্যমূল্যে সার্বিক নেতিবাচক  বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণের ধরণ শুনিয়া আমি মন্ত্রমুগ্ধ শ্রোতা হইয়া অস্ফুট স্বরে বলিলাম ---- উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে।


বাজারে আসিবার প্রাক্কালে গৃহিণী আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করিলেক, একটি বৃহদাকার ইলিশের অমৃতরূপ স্বাদ এবং সামুদ্রিক লাক্ষা মৎস্য ভক্ষণ করিবার তাহার বাসনা উদয় হইয়াছে।


দ্রব্যমূল্যের দৈত্য-দেহ সদৃশ স্ফীতির কারণে বাজারে আনীত প্রায় সমূদয় অর্থ এখনই মুদিকে প্রদান করিতে হইবেক। গৃহিণীর কথিত প্রেমপত্রের উল্লেখিত দ্রব্যাদি কর্তন করিয়া আপন গৃহকে কুরুক্ষেত্র পরিণত করিবার দুঃসাহস আমি অবদমিত করিয়া মৎস্য ক্রয় করিবার আকাঙ্খা পরিত্যাগ করিলাম। ভাবিলাম, গৃহদেবী রুষ্ট হইলে পুনরায় বাজারে ফিরিয়া সেই উপাদেয় মৎস্য ক্রয় করিয়া তাহার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করিব।


মুদির দোকান হইতে সাধারণ মধ্যবিত্তের বাহন রিকশা করিয়া গৃহ অভিমুখে রওনা হইলাম। নগরীর রাজপথের দুইধারে সুউচ্চ অট্টালিকারাশি, রাজপথের পাশে ও মধ্যে মনুষ্য ও যান্ত্রিক যানে পরিপূর্ণ। তবু আমার মনে হইলেক, আমি মহাসমুদ্রে ভাসিতেছি আর ডুবিয়া ডুবিয়া লোনাজল গলাধঃকরণ করিতেছি ---- কোন কূল কিনারা নাহি। হাজারো দুঃখের  মধ্যেও যেমন মানুষ্য নিজের জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হইয়া হাসিয়া উঠে, আমিও তদ্রূপ গাহিয়া উঠিলাম, আমায় ভাসাইলি রে, আমায় ডুবাইলি রে, অকুল দরিয়ার মাঝে কূল নাই রে........।