অহং বনাম আত্মা
লেখকঃ- উৎস চক্রবর্তী


অহং নিজেকে সেবা করতে চায়, আত্মা অন্যদের সেবা করতে চায়।
অহং বাহ্যিক স্বীকৃতি খোঁজে, আত্মা অভ্যন্তরীণ সত্যতা খোঁজে।
অহং জীবনকে একটি প্রতিযোগিতা হিসাবে দেখে, আত্মা জীবনকে একটি উপহার হিসাবে দেখে।
অহং নিজেকে সংরক্ষণ করতে চায়, আত্মা অন্যত্র অন্যকে সংরক্ষণ করতে চায়।
অহং বাহ্যিক দেখায়, আত্মা অভ্যন্তরীণ দেখায়।
অহংকার অভাব অনুভব করে, আত্মা প্রাচুর্য অনুভব করে।
অহং নশ্বর, আত্মা চিরন্তন।
অহংকার লালসার প্রতি আকৃষ্ট হয়, আত্মা প্রেমের প্রতি আকৃষ্ট হয়।
অহং জ্ঞানের সন্ধান করে, আত্মা প্রজ্ঞার সন্ধান করে।
অহং পুরস্কার সন্ধান করে, আত্মা যাত্রা উপভোগ করে।
অহংকার ব্যথার কারণ, আত্মা নিরাময়ের কারণ।
অহং ঈশ্বরকে প্রত্যাখ্যান করে, আত্মা ঈশ্বরকে আলিঙ্গন করে।
অহং আমিই, আত্মা আমরাই।


ভারি সুন্দর বিষয়ের অবতারণা। এ লেখা বুঝতে হলে অহং ই বা কী আর আত্মাই বা কী তা সঠিকভাবে অনুধাবন করতে হবে।


প্রথমেই আসি অহং এর প্রসঙ্গে। অহং মানে ঔদ্ধত্য, দাম্ভিকতা, গর্ব , অহঙ্কার, ব্যক্তি, আমি, আত্ম, আত্মপ্রাধান্য, আত্মশ্লাঘা, দম্ভ, স্বার্থ বা আত্মম্ভরিতাকে বোঝায়।  আত্মম্ভরিতা অর্থে আত্মপরতা বা স্বার্থপরতাকে উল্লেখ করে।


অপরদিকে আত্মা হলো ঐশ্বরিক। ইসলাম ধর্মে আত্মাকে রুহ বলে। “রুহ” একটি আরবি শব্দ। তবে বাংলাদেশের মুসলমানরা আত্মাকে বাংলাতে আত্মা বা জান বলে অভিহিত করে। মুসলমানরা মনে করে প্রতিটি জীবের শরীরের ভিতরেই আত্মা বা জান বিদ্যমান। মৃত্যুর সময় রুহ কবজকারী ফেরেশতা আজরাইল জীবের শরীরের ভিতর থেকে আত্মা বা জান বের করে নিয়ে যায়। মৃত্যুর পর কবরে আত্মাদের তিনটি প্রশ্ন করা হয়ে থাকে। এর মাধ্যমে কবর জীবনে মানুষের পাপ-পুণ্য বিচার করা হয়।


হিন্দু বিশ্বাসমতে "আত্মা" হলো চিৎকণা, যা সকল চৈতন্যময় জীবে পরিব্যাপ্ত। এই আত্মা জীবাত্মা ও পরমাত্মা এই দুই ভেদ রয়েছে। পরমাত্মা হল পরমেশ্বর ভগবান এর এক বিশেষ রূপ। প্রতিটি জীবের হৃদয়ে জীবাত্মা (আত্মা) ও পরমাত্মা উভয়ই বতর্মান। জীবাত্মার কারণে দেহে চৈতন্য লাভ করে। জীবাত্মা বহু হলেও এক অভিন্ন পরমাত্মা সকল জীবে অবস্থান করে তার পালন করেন। অদ্বৈতবাদিদের মতে জীবাত্মাকে পরমাত্মার অংশ বলা হয় ।


মনুষ্য অবস্থায় জীবাত্মার কৃতকর্ম অনুযায়ী তার কর্মফল ভোগ করার জন্য স্বর্গ-নরক ভোগ করে, অথবা জন্মান্তরের মাধ্যমে বিভিন্ন যোনি ভ্রমণ করে স্থাবর-অস্থাবর দেহ প্রাপ্ত হয়। কিন্তু পরমাত্মা কর্মফল দাতা, তিনি কোনো ফলভোগ করেন না। ঐ সময়ে জীবাত্মা তার পূর্ব জন্মে অর্জিত কর্মফল বিনষ্ট করে, এবং পুনরায় মনুষ্যদেহ লাভ করে। শেষে মোক্ষলাভের মাধ্যমে জীবাত্মা পরমাত্মাকে প্রাপ্ত হয়। মোক্ষলাভই হিন্দুধর্মানুযায়ী জীবের চূড়ান্ত লক্ষ্য।


জীবাত্মা যেহেতু পরমাত্মার অংশ সেহেতু তা সবসময়ই পবিত্র হয়ে থাকে। আত্মাকে জল দ্বারা সিক্ত করা যায় না, আগুনে তা বিনষ্ট হয় না, বাতাস বা মৃত্তিকা তাকে শোষণ করতে পারে না। আমরা বস্ত্র পুরানো হয়ে গেলে বা ছিঁড়ে ফেটে গেলে তা যেমন ফেলে দিয়ে অন্য নতুন বস্ত্র পরিধাণ করে থাকি সেরূপ আমাদের শরীরটা জীর্ণ শীর্ণ হয়ে গেলে আত্মা তা ফেলে দিয়ে নতুন কোনও দেহ ধারণ করে থাকে।


যদিও আত্মা থেকেই আত্ম শব্দটি এসেছে তবুও আত্ম বলতে আমরা জাগতিক আমি বা আমার শরীরটাকেই বুঝে থাকি। আমার একটি নিজস্ব মন আছে , অবস্থান আছে, আছে রাগ কাম ক্রোধ, লজ্জা , বাসনা কামনা , লোভ লাসসা ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি আমাকে সবার চেয়ে ভালো সবার চেয়ে উপরে, সবার থেকে ধনবান সুখী সর্বদাই কামনা করে থাকি। আর সেখান থেকেই অহং ভাব বা অহঙ্কার দানা বাঁধে মন মস্তিষ্কে। বাস্তবে আমরা তাই অনেক লোভ লালসা, বাসনা কামনা পোষণ করে থাকি। মনের এই অহঙ্কার আমি বা আমাকে আমার অহং বোধ আত্মা যা পরমাত্মারই অংশ বিশেষ তার থেকে একদম ভিন্ন করে তোলে। আমার যা চাহিদা তা হলো ধন, বিষয় সম্পত্তি, স্ত্রী রমণী, ভোগ আর বিত্তবাসনা যা আত্মার কখনোই চাহিদা হতে পারে না।


আত্মা চায় শুধুই বিশুদ্ধতা। শুচি থাকতে চায় সকল সময়ই। আমার আপনার তার বা তাহাদের সকলের ভিতরেই একই পরমাত্মার অংশবিশেষ বিরাজমান তাই কবি উল্লেখ করেছেন যে,"অহং আমিই, আত্মা আমরাই।" যেভাবে আমি উল্লেখ করলাম যে আত্ম কী ভাবে আত্মা থেকে ভিন্ন অবস্থান হয়ে যায় কবি লিখেছেন,"অহং ঈশ্বরকে প্রত্যাখ্যান করে, আত্মা ঈশ্বরকে আলিঙ্গন করে।","অহং পুরস্কার সন্ধান করে, আত্মা যাত্রা উপভোগ করে। অহংকার ব্যথার কারণ, আত্মা নিরাময়ের কারণ।","অহং বাহ্যিক দেখায়, আত্মা অভ্যন্তরীণ দেখায়। অহংকার অভাব অনুভব করে, আত্মা প্রাচুর্য অনুভব করে।" ,"অহং নিজেকে সেবা করতে চায়, আত্মা অন্যদের সেবা করতে চায়। অহং বাহ্যিক স্বীকৃতি খোঁজে, আত্মা অভ্যন্তরীণ সত্যতা খোঁজে। অহং জীবনকে একটি প্রতিযোগিতা হিসাবে দেখে, আত্মা জীবনকে একটি উপহার হিসাবে দেখে।"


ভীষণ সুন্দর অনুভব উপলব্ধির একটি লেখা উপহার দেবার জন্য প্রিয় কবির জন্য রইল অনেক অনেক অভিনন্দন।