কবিতায় রূপকের ব্যবহার সম্বন্ধে আগের আলোচনাতে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। এবার আলোচনা করবো রূপকের ব্যবহার করতে গেলে কী কী সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।  এক, সাদৃশ্যময়তা যেন বজায় থাকে রূপকে। উদাহরণ স্বরূপ বলছি। একটা রূপকের ব্যবহার সম্বন্ধে আগের আলোচনাতে আমি লিখেছিলামঃ-


"কলি শত ফুটে হ্রদে সরোবরে পান্না
দলিতের কোকোনদে, বয়ে চলে
কান্না।
দিবা রাতি বাজে সুর আকাশের হাতছানি
কেড়ে নিতে কমলেতে, লুট মার রাহা-
জানি।"


এখানে গরিব দলিত পরিবারের সুন্দরী তনয়ার সম্বন্ধে বলা হয়েছে। সুন্দরী তনয়াদিগকে আমি কমল বা পদ্মফুলের সাথে তুলনা করেছি মানে একটি শ্রেষ্ট ফুলের সঙ্গে তুলনা করেছি।


কয়লার খনিতে হিরে পাওয়া যায়। তার সাথেও তুলনা চলতে পারে। সেখানে খনি হবে দলিত পরিবার আর হিরে হবে তনয়া। হিরের প্রতি আকর্ষণ সেই তো প্রাচীন যুগ থেকে। কাজেই সবাই চাইবে তাকে আত্মস্থ  করবার জন্য। তেমন হীরক কুচি যদি উচ্চবর্গে জন্মগ্রহণ করে তবে তার সদগতি খুব ধুমধামেই হয় আর প্রাচুর্যের অতিসায্য তার জীবন অতিবাহিত হতে পারে। কিন্তু দলিত গরিব পরিবারের সে সকল হীরক কুচি, তারা তো থাকে অরক্ষিত, তারা অতি সহজেই কূ নজরে পরে অসামাজিক ব্যাক্তিত্বের। অনেক দালাল ফড়েরা নিত্য নৈমত্তিক ঘোরা ফেরা করতে থাকে তাদের আস পাসে। তাদের পরিবার কে মিথ্যা বলে ভাল কাজ দেবার আর তাদের ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাদের পাতা ফাঁদে ফাসিয়ে তাদের বিক্রি করে দেয় দেশ বিদেশে পতিতালয়ে। এমন কাহিনী আজকাল হর হামেশাই শোনা যায়। যাই হোক যে কথা বলছিলাম যে, "সামঞ্জস্যতা", বজায় রাখতে হবে রূপক ব্যাবহার করতে গেলে। সামঞ্জস্যতা বজায় না রাখতে পারলে রূপকের পিছনে আসল ঘটনা প্রকাশ করা খুবই কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। অনেক সময়ই ধাঁধায় পর্যবাসিত হয় সে লেখা বা একটি রূপকের সুনির্দিষ্ট অর্থের বদলে এক এক জনা এক এক ভাবে মানে বু্ঝে নিতে পারে। সেক্ষেত্রে কবি সুনির্দিষ্ট ভাবে কী বলেছেন তা কখনই প্রষ্ফুটিত  হয় না।


একই ভাব যা আমি কমল বা পদ্মফুলের সাথে তুলনা করে লিখেছি, তা আবার হিরের  সাথে তুলনা করে লিখতে চেষ্টা করবো আজ।


দ্বিতীয়ত, রূপকের ব্যাবহার করলেও আমি কবিতাতে ঠিক কী বোঝাতে চাইছি তার একটু হিন্টস দিয়ে রাখা। ঠিক যেমনটা আমি এখানে করেছি বা করে থাকি। কমল বা শতদল আর সরোবরের কথা বললেও , "দলিতের কোকোনদে", কথাটা কিন্তু প্রথিত হয়েছে সে লেখায় আর আমি ঠিক কী বলতে চাইছি, এটুকু লেখাতেই যথেষ্ট। এই ব্যপারটাও খেয়াল রাখতে হবে রূপক ব্যবহারে কবিতা লিখতে গেলে।


রূপক অবশ্যই রুচি সম্মত হতে হবে নইলে লেখা সেই মানে পৌছতে সক্ষম হবে না।


কলেজ লাইফে আমাদের বন্ধু শুদ্ধসত্ব তার প্রেমিকাকে কবিতা লিখে দিত এমন, "আমার হৃদয়ের ল্যাম্পপোষ্টে তোমার বাতি জ্বলে, আমার হৃদয়ের চাকা তুমি, ইত্যাদি" যদিও কথাগুলি অর্থবহ, তবুও সেগুলি আমাদের কাছে হাসির খোরাক ছাড়া আর কিছুই ছিল না।


হিরে তায় খনি তায় দীপ্ত সে চমকেতে
ধারে তারি কতজনা শত কত চোখ
ফাটে।
কেহ গানে কেহ মানে ধরে নিতে চাহে ধরা
আগু পিছু যুযুধান, শত ছলে মনো-
হরা।
জ্যোতি তারি বিভাবসু চমকেতে ধাবমান
উজলেতে শত তারা রাত ভরা আশ-
মান
কালিমাতে লালিমা সে দীন তারি নীড় অতি
লোভিষ্ট্র কূজনেতে দেয় সবে ফাঁদ
পাতি।
আলো ধারা প্রবাহেতে মিলে দিতে তারি প্রাণ
দীনো জনে পূজনেতে, দূর তাহে দিতে
দান।
চমকিত শত বাজে আশমান ঘন ঘোর
চমকিত হতে হিরে, কুঠুরিতে শত
দোর।


হিরের সাথে তুলনাতে একই ব্যপার লিখলাম। এর পরের আলোচনাতে কবিতাটির বিশ্লেষণ সহকারে রূপক ব্যবহার নিয়ে আর এক একবার আসবো।


আন্তরিক শুভকামনা সহ সঞ্জয় কর্মকার।