আজ ১১ টার স্টেট বাস ধরে চলে যাব শিলিগুড়ি। কিছু কাজ নিয়ে গেলাম এখান থেকে। আবার ১০-১২ দিন বাদেই আসতে হবে। সকাল ছটার সময়ই ঘুম থেকে উঠে গিয়েছি। বাইরে থেকে চা খেয়ে আসবার পর হোটেলের পিছনের গেটে চলে যাই টুনটুনির খোঁজে। তখন থেকে বেলা ১০ টা অবধি বার বার গেছি দাঁড়িয়ে থেকেছি কিন্তু আজ আর টুনটুনির দেখা পেলাম না। তাই কবিতায়;


"বিচ্ছেদের গান"


টুনটুনি নেই কত্ত খুঁজি কাল হয়েছে ঝড়
তাই কি টুনি নীড় হারা হায়!
ছেড়েই গেছে ঘর।


মনটা ব্যাকুল দুখের ছায়ে কচুর বনের পানে
চেয়েই যে রই হতাস নয়ন
বিচ্ছেদের ওই গানে।


আর তো নাহি হেথায় রবো সাঙ্গ হলো কাজ
গেলাম টুনি আসছে বারে
আসিস নেড়ে ল্যাজ।


ঠিক এগারোটায় আমার ক্লায়েন্ট বাইক নিয়ে এসে হোটেল থেকে আমায় নিয়ে গিয়ে বাস ধরিয়ে দেয়। অত লম্বা স্টেট বাস। যাত্রী মাত্র কয়েক জন হাতে গোনা। সামনের দিকেই তিন সিটের জানালার ধারের সিট টিতে বসে পড়ি। হটাত মনে হয় কবিতা লিখি। যেই ভাবা সেই কাজ। ব্যাগের ভিতর থেকে আমার এ-৪ সাইজের পাতা দিয়ে আর এক দেরশো কবিতা দিয়ে স্পাইরাল বাইন্ডিং করা বইটি বেড় করে নি। বস্তুত কথা কাহিনীর সব কবিতাই এই বইটির উল্টাদিকের সাদা পাতায় লেখা হয়েছে। এরপর কবিতায়ঃ-


"জ্যান্ত আজব শহর"


ভালোয় ভালোয় বেড়িয়ে এলাম জ্যান্ত আজব শহর হতে
চলছে রে বাস সো সো করে পড়লো মহলম হৃদয় ক্ষতে।
জানলা দিয়ে দেখছি আকাশ কালোয় কালোয় মেঘের ছায়
ঘর বাড়ি সব ছুটছে পিছে অন্ত হলো
পেটের দায়।


বাসটা ফাঁকা যাত্রী নেই তাও রে ভাড়া আগের দর ওই
সরকারি তো তাই তো এমন; লস হলো তো তাতেই সই।
টুনির কথা পড়ছে মনে তার চেয়ে বেশি পরীর গান
কাল দিয়েছে মাংস কষা সেই পানেতেই
মনের টান।


একটা পরী উঠলো বাসে বসলো আমার তিন সিটেতেই
সে আর আমি মাঝে শিশু তার রূপেতেই
মুগ্ধ হই।


ভেবেছিলাম তার রূপের গল্প কাহিনী লেখা শুরু করি। কিন্তু মনকে বশে আনতেই হলো। তেমন লিখতে হলে তো তার দিকে অপলক চাইতে হবে আমায় আর হৃদয়ঙ্গম করতে হবে সে রূপের সুধা। মানে কবিতার চক্করে গণধোলাই খাবার বুদ্ধি। আবার যদি কোনও ভাবে লিখি ও ভাবছি যদি খাতাটা চায় দেখতে! সেখানেও তো বিপদ। তাই খাতা পেন ব্যাগে গুটিয়ে রেখে জানালা দিয়ে প্রকৃতি দেখাই সমীচীন মনে হলো। তবে ধূপগুড়ি পৌছাবার আগেই যখন সামনে তাকিয়েছি তার হাতটি চোখে পড়লো কারণ সে সামনের সীটের পিছনে লাগানো হ্যান্ডেলটা ধরে ছিল। হাতের দু আঙুলে স্পষ্ট খুলে ফেলা আঙটি র ছাপ। বোঝাই যাচ্ছে সদ্য খুলে ফেলা তা। ভাবছিলাম যে লকডাউনে সেগুলি বোধহয় গেছে। সে যে আর্থিক সঙ্কটে আছে বুঝতে পারলাম। আঙুলের দিকে তাকিয়ে এসব চিন্তা করছিলাম। হয়তো বা অনেক ক্ষণই তাকিয়ে ছিলাম অজান্তেই। সেই সুন্দরী হয়তো বা আমার চিন্তা তরঙ্গ অনুভব করেই জানি না বিরক্তি কি লজ্জার বশে আমাকে জিজ্ঞাসাই করে বসে , "কোথায় যাবেন?"। আমি বলি , "শিলিগুড়ি"। বলেই তাকে প্রশ্ন করি, "লক ডাউনে তো আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে যাওয়া মানা, আপনি কোথায় যাচ্ছেন"। সে বলে আমি আমার বোনের বাড়ি ধূপগুড়ি যাচ্ছি আর আগে থেকেই তার সাথে কথা হয়েছে আমার। আর তাছাড়া কাল ই ফিরে আসবো আমি। অনুমান করতে পারলাম সে কেন যাচ্ছে। হতেই পারে আমার অনুমান সত্যি কারণ তার পরেই যখন জিজ্ঞাসা করলাম , "আপনার মেয়ের বয়স কত হলো?" সারে চার বছর শুনেই প্রশ্ন করি কোন ক্লাসে পড়ে। সে বলে, "ভর্তি করি নাই স্কুলে"। আজকের দিনে এই বয়সের বাচ্চাদের অন্তত দু বছর ক্লাস হয়ে যায়। বুঝতে পারি, কেন! তাকে উৎসাহিত করি এই বলে যে, "আমার বড় মেয়েকেও আমি নার্সারি কেজি তে পড়াই নাই। আসলে বাচ্চাদের ছোট বয়সে পড়ার চাপ দিতে নাই। আপনি ওকে সিক্স প্লাস হলেই স্কুলে দেবেন। তার হাতে শুধু একটা শাখা ছিল আর গলারটা যে ইমিটেশন বেশ বুঝতে পারি। বুঝতে পারি লক ডাউনে সোনার চুড়ি গুলি গেছে। তাকে আর একটা প্রশ্ন করি, ওর বাবা কি করে? সে এবার যেন একটু থমকে যায়। অবশ্য সামলে নিয়ে বলে, "বাজারে ব্যাবসা করে"। কিসের ব্যাবসা আর জিজ্ঞাসা করে তার অস্বস্তি বাড়ালাম না। একটু পরে সে আসছি বলে ধূপগুড়ি তে নেমে যায়। আমি শুধু ভাবতে ছিলাম যে, যার রাজ রানী হওয়া উচিত ছিল সে আজ কতটাই দৈন্য। নিয়তির কি নিষ্ঠুর পরিহাস। সে সময় যে ভাব বা ভাবনা মনে এসেছিল তখন না লিখতে পারলেও এখন এখানে সরাসরি লিখছি।


"নিয়তি


কপালে কি লেখা রয় নিয়তির পরিহাস
আঁকা বাঁকা গতি ধায়; মানুষ কি তার ই দাস!
কিচরেতে শত দল শোভা তারি আলাপন
সুন্দরী ললনা"র সুখী নাহি হয় প্রাণ।
মাধুর্য সীমাহীন তন মন বদনেতে
লালিত্যে ভরপুর কেন দুখ আঁখি পাতে!
আমি কবি ভাবি তাই লিখে যাই কবিতাই
নিয়তির চেয়ে বড়; ভাবি আর কিছু নাই।


সমাপ্ত।