.  বাংলা ১৪২৫ সালের ২২শে শ্রাবণ রবীন্দ্রনাথের ৭৭তম প্রয়াণ বার্ষিকীতে সকল রবীন্দ্র ভক্তকে জানাই আমার আন্তরিক প্রীতি সুধা সিঞ্চিত বিনম্র প্রণাম।
    আমরা যারা প্রকৃত রবীন্দ্র অনুরাগী, রবি ঠাকুর হয়তো তাদের সারা জীবনের চলার পথের নিত্য সঙ্গী। তবুও ২৫শে বৈশাখ এবং ২২শে শ্রাবণ এই দুটি দিন যেন রবি ঠাকুর আমাদের স্মরণ ও মননকে আরো নিবিড়ভাবে নাড়া দিয়ে যায়। তবে দিন দুটি কিন্তু দুই ভিন্নভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। ২৫শে বৈশাখ তার আবির্ভাব মুহূর্তে কেউ তেমন বুঝে উঠতে পারেনি যে কোন্ উজ্জ্বল প্রতিভার পদার্পণ ঘটল এই ধরণীতে। কিন্তু ২২শে শ্রাবণ বিশ্ববাসী সচেতনভাবে উপলব্ধি করেছিল যে কোন্ মহর্ষি, মহান স্রষ্টা, মহান সঙ্গীত প্রতিভা আমাদের ছেড়ে চিরবিদায় নিলেন। যাবার বেলায় তিনি দীর্ঘ আশি বছরের সাধনার সঞ্চিত মহাধন অকৃপণভাবে দান ক'রে গেছেন, যা আমাদের কৃষ্টিকে, চেতনাকে, মননকে সার্বিকভাবে পরিপূর্ণ ক'রে দিয়ে গেছে সুদীর্ঘ অনাগত কালের জন্য।
    ছোট বেলায় তার কাব্যিক ভাবনার শুরু "জল পড়ে পাতা নড়ে" দিয়ে।তারপর এত দ্রুত তার কাব্যিক চেতনার বিকাশ ঘটতে থাকে, যে তার বিস্ময়কর প্রতিভায় তখনকার বিদগ্ধ পাঠক সমাজ চমকে ওঠে। সেই বিকাশের প্রথম পর্বেই কবির চোখে জন্মের মতো মৃত্যুও খুব সহজসুন্দর রূপে প্রতিভাত হয়ে ওঠে। তারই প্রতিফলন দেখি 'ভানুসিংহের পদাবলীর' সেই বিখ্যাত গানে - মরণ রে, তুঁহুঁ মম শ্যাম সমান। তারপরই যে বিখ্যাত কবিতায় তার ভাবাবেগ ঝরনা ধারার মতো গতিময় ছন্দে ঝ'রে পরে তা হল 'নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ' যেখানে এক ভোরবেলা নবোদিত সূর্যের আলোর ছোঁয়ায় তরুণ কবির উদ্বেলিত অন্তর থেকে বেরিয়ে এল - আজি এ প্রভাতে রবির কর/ কেমনে পশিল প্রাণের পর/ কেমনে পশিল গুহার আঁধারে প্রভাত পাখির গান।/ না জানি কেন রে এতদিন পরে জাগিয়া উঠিল প্রাণ।/ জাগিয়া উঠেছে প্রাণ ওরে, উথলি উঠেছে বারি/ ওরে, প্রাণের বাসনা প্রাণের আবেগ রুধিয়া রাখিতে নারি।
এই পর্বের আরো যে সব কবিতা আমাদের মনকে নাড়া দেয় তার মধ্যে একটি হল 'বধূ' - বেলা যে প'ড়ে এল জলকে চল।/ পুরানো সেই সুরে কে যেন ডাকে দূরে-/ কোথা সে ছায়া সখী, কোথা সে জল!/ কোথা সে বাঁধা ঘাট, অশথতল!/ ছিলাম আনমনে একেলা গৃহ কোণে,/ কে যেন ডাকিলে রে জলকে চল।
এরপর তার জীবনদর্শন এগিয়ে চলে এক পরিপূর্ণতার দিকে  যার ছবি আমরা দেখি 'সোনার তরী' কবিতায়।- গগনে গরজে মেঘ, ঘন বরষা/ কূলে একা বসে আছি, নাহি ভরসা।/ রাশি রাশি ভারা ভারা/ ধান কাটা হল সারা,/ ভরা নদী ক্ষুরধারা খরপরশা।/ কাটিতে কাটিতে ধান এল বরষা।
যে কবিতার শেষে জীবনের চরম পরিণতি এবং পরম উপলব্ধির কথা- ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই ছোট সে তরী/ আমারই সোনার ধানে গিয়েছে ভরি।/ শ্রাবণগগন ঘিরে/ ঘন মেঘ ঘুরে ফিরে,/ শূন্য নদীর তীরে রহিনু পরি/ যাহা ছিল নিয়ে গেল সোনার তরী।
অর্থাৎ আমাদের জীবনের সুকর্মের ফসল যদি কিছু থাকে, সেটুকুই প্রবাহমান কালের তরণীতে ঠাঁই পাবে, কিন্তু আমাদের নিজেদের ঠাঁই সেখানে মিলবে না। সংসারের খেলা সাঙ্গ হলে আমাদের বিলীন হয়ে যেতেই হবে ধরার ধূলিতে। এই পর্বেরই আর একটি আত্মচেতনা জাগরণের কবিতা 'ঝুলন'- আমি পরানের সাথে খেলিব আজিকে মরণখেলা/ নিশীথবেলা।/ সঘন বরষা গগন আঁধার/ হেরো বারিধারে কাঁদে চারিধার/ ভীষণ রঙ্গে ভবতরঙ্গে ভাসাই ভেলা/ বাহির হয়েছি স্বপ্ন শয়ন করিয়া হেলা/ রাত্রিবেলা।
যেখানে শেষের দিকে আছে- প্রাণেতে আমাতে মুখোমুখি আজ/ চিনি লব দোহে ছাড়ি ভয় লাজ,/ বক্ষে বক্ষে পরশিব দোহে ভাবে বিভোল/ দে দোল দোল।/ স্বপ্ন টুটিয়া বাহিরিছে আজ দুটো পাগল/দে দোল দোল।
এই রকম ভাবের ঘোরে আত্মভোলা হয়ে থাকতে থাকতে একসময় কবির হঠাৎ মনে হল, স্বার্থপরের মতো কেবল নিজেকে নিয়ে নিমগ্ন থাকলে মহাজীবনের সত্যিকারের সার্থকতা কোথায়! তখন কবি লিখলেন 'এবার ফিরাও মোরে' যেখানে তিনি বলছেন - সংসারে সবাই যবে সারাক্ষণ শত কর্মে রত,/ তুই শুধু ছিন্নবাধা পলাতক বালকের মতো/মধ্যহ্নে মাঠের মাঝে একাকী বিষণ্ণ তরুচ্ছায়ে/ দূরবনগন্ধবহ মন্দগতি ক্লান্ত তপ্ত বায়ে/ সারাদিন বাজাইলি বাঁশি। ওরে তুই ওঠ আজি।
এইবারে তিনি উপলব্ধি করতে শুরু করলেন সবার সাথে একাত্মতার অনুভব। তার লেখায় ফুটে উঠল দেশাত্মবোধ। তিনি লিখলেন - চিত্ত যেথা ভয় শূন্য, উচ্চ যেথা শির,/ জ্ঞান যেথা মুক্ত, যেথা গৃহের প্রাচীর/ আপন প্রাঙ্গন তলে দিবসশর্বরী/ বসুধারে রাখে নাই খন্ড ক্ষুদ্র করি।
যার শেষে তিনি বলেন - নিজহস্তে নির্দয় আঘাত করি পিতঃ/ ভারতেরে সেই স্বর্গে করো জাগরিত।
মহৎ কবির অন্তরে উপলব্ধি হয়েছিল যে তার পুণ্য মাতৃভূমি ভারতবর্ষ যেন এক মহামানবের মিলন ক্ষেত্র, যার বিচ্ছুরণ আমরা পাই 'ভারত তীর্থ' কবিতায় - হে মোর চিত্ত পুণ্য তীর্থে জাগো রে ধীরে/ এই ভারতের মহামানবের সাগর তীরে।
রবি ঠাকুর নিজের কালজয়ী প্রতিভা সম্বন্ধে হয়তো সচেতন এবং প্রত্যয়ী ছিলেন। তাই বোধ হয় তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে শতবর্ষ পরেও জগৎবাসীর পক্ষে তার সৃষ্ট কবিতা গানকে ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়। সেই ইঙ্গিত ফুটে উঠেছে '১৪০০ সাল' নামের বিশিষ্ট কবিতায়, যেখানে তিনি আবেগ মথিত কণ্ঠে ভবিষ্যতদ্রষ্টার মতো বলেছিলেন- আজি হতে শতবর্ষ পরে/ কে তুমি পড়িছ বসি আমার কবিতাখানি কৌতূহল ভরে।
    ইতিমধ্যে ক্রমে ক্রমে জীবনের আরো পরিপূর্ণতা উপলব্ধি করার পর কবি যেন অন্তরে শুনতে পাচ্ছেন বেলা শেষের ডাক- ওগো আমার এই জীবনের শেষ পরিপূর্ণতা/ মরণ আমার মরণ, তুমি কও আমারে কথা।
এই পর্বের আরো কিছু লেখা- যাবার দিনে এই কথাটি বলে যেন যাই-/যা দেখছি যা পেয়েছি তুলনা তার নাই।
কিম্বা- পেয়েছি ছুটি, বিদায় দেহ ভাই,/ সবারে আমি প্রণাম ক'রে যাই।/ ফিরায়ে দিনু দ্বারের চাবি, রাখি না আর ঘরের দাবি/ সবার আজি প্রসাদ বাণী চাই,/ সবারে আমি প্রণাম করে যাই।
নোবেল জয়ী কবির কতখানি বিনম্রতা, ভাবলে আপনিই শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে। কবির কণ্ঠে বিনম্র আত্মনিবেদনের সুর - আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণ ধূলার তলে,/ সকল অহংকার হে আমার ডুবাও চোখের জলে।
    জীবনের শেষ পরিণতি   যে মৃত্যু তাকে তিনি নির্ভয়ে এবং সানন্দে আহ্বান জানিয়ে 'মৃত্যুঞ্জয়' কবিতায় বলেন,- যত বড় হও, তুমি তো মৃত্যুর চেয়ে বড় নও।/ আমি মৃত্যু-চেয়ে বড়, এই শেষ কথা ব'লে/ যাব আমি চ'লে।
জীবনের প্রান্ত সীমায় এসে বিশ্বকবি রূপে খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছেও মহৎ এবং বিনয়ী কবির উপলব্ধিতে জেগে ওঠে নিজের সীমাবদ্ধতার কথা। তিনি মুক্ত কণ্ঠে ‘ঐকতান’ কবিতায় স্বীকার করেন - আমার কবিতা, জানি আমি,/ গেলেও বিচিত্র পথে হয় নাই সে সর্বত্রগামী।/ কৃষাণের জীবনের শরিক যে জন,/ কর্মে ও কথায় সত্য আত্মীয়তা করেছে অর্জন,/ যে আছে মাটির কাছাকাছি,/ সে কবির বাণী লাগি কান পেতে আছি।
    অনেক জ্ঞানী গুণী জন রবীন্দ্রনাথকে বলেছেন mystic কবি। আসলে রবীন্দ্রনাথকে পুরোপুরি বুঝে ওঠা সত্যিই খুব কঠিন ব্যাপার। আমরা দেখতে পাই, ২২শে শ্রাবণ তার মহাপ্রয়ানের মাত্র দিন দশেক আগেও কবির সজীব লেখনীতে ধ্বনিত সেই রহস্যাবৃত বাণী।- প্রথম দিনের সূর্য প্রশ্ন করে ছিল সত্তার নূতন আবির্ভাবে, কে তুমি! মেলেনি উত্তর। বৎসর বৎসর চলে গেল, দিবসের শেষ সূর্য শেষ প্রশ্ন উচ্চারিল পশ্চিম-সাগর তীরে, নিস্তব্ধ সন্ধ্যায়, কে তুমি-/ পেল না উত্তর।
    তাই সুরসাধক মহাকবির ভাবের গভীরতা যে ঠিক কতখানি তা সঠিকভাবে উপলব্ধি করা বোধহয় আমাদের পক্ষে পুরোপুরি সম্ভব নয়। সেই জন্য আজকের নিবেদিত শ্রদ্ধার্ঘ আমি শেষ করতে চাই এইরকম কটি ছান্দিক পংক্তির মাধ্যমে যার শিরোনাম


"সুরের কবি সাধক রবি"
  '''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''
কবিগুরুর কতই কথা
       ধ্বনিত তার গানে।
নেই কো কথা, সব কথারই
      থাকতে হবে মানে।
কখনো বা দূর দেশী সেই
       রাখাল ছেলে সেজে
গাইল কী গান কে-ই বা জানে,
       উঠল কানে বেজে।
কখনো বা গ্রাম ছাড়া ঐ
       রাঙা মাটির পথে
হারিয়ে যেত বাউল সেজে
       সহজ সাধন মতে।
থাকত নিজেই কান পেতে সে
       মনের গহন দ্বারে
বিবাগি কোন্ ভ্রমর কী গান
       গাইত বারে বারে।
পরাণ বীণায় ঘুমের জালে
       কত-না সুর গান-ই,
না ছিল তার ছন্দ বাঁধন
       না ছিল তার বাণী।
নিদ্রা হারা রাতের সে গান,
       কন্ঠে সে তান পুরে -
নিজেই কবি ভাবত ব'সে
       বাঁধবে কেমন সুরে।
যতই চাই, আমরা তাকে
       বুঝব কেমন ক'রে !
অধরা কোন্ স্বপ্ন মায়ায়
       যায় যে হৃদয় ভ'রে।
না-ই বা গেলাম বুঝতে তাকে,
       খুঁজতে সঠিক মানে।
সে সাধ্য কই! তারচেয়ে রই
       বিভোর গানে গানে।
         ------------