(সূচনা পর্ব)
ঘুম ভেঙে বারান্দায় গিয়ে বসে ধুম্রশলাকায় আগুন জ্বালাবার সময়ও খেয়াল করিনি ঠিক পাশের বারান্দাতে সমান্তরালে বসে আছে পড়শীর নুবাইল কন্যাটি...


ধুম্রছায়া হাওয়ায় ভেসে তার ঘ্রাণগ্রন্থিতে আঘাত করলে আনমনাভাব কেটে যাবার পর সম্ভবত সে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়েছিল, ঠিক জানি না। উপস্থিতি টের পেলাম যখন শুনলাম কিছুটা বিরক্তিমাখা কন্ঠে কেউ বলছে;


- "ছিহ! আপনি সিগ্রেট খান?"


আমিও তাকে উত্তর দিতে চাইছিলাম,
- "সিগ্রেটই তো খাচ্ছি, কারো মাথাটাথা তো আর নয়।"


তবে সবকিছু তো আর বলা যায় না। অযথা আবেগও অনেক সম্ভাবনার অপমৃত্যু ঘটায়। আমি সম্ভাব্য ঘাতকের তালিকায় নাম লেখাতে চাইছিলাম না বলেই হয়ত অজান্তে জবাব পাল্টালাম,


- "দুঃখিত, আপনাকে দেখি নি। আপনি তো দীপি, তাই না?"


দীপিতা উত্তর দিলেন,
- "নাহ, ওটা দীপিতা। মা-বাবা আদর করে দীপি ডাকেন। কিন্তু আপনার কান তো তুখোড়, নাকি দেয়ালেই কান পেতে রাখেন?"


যদিও আমি প্রায় কান পেতেই জানি এসব, তবু নিজের মান ঊর্ধমুখী রাখতে বললাম,
- "তেমন নয়, আসলে গেটের সামনে একদিন আংকেল আন্টি আপনাকে এই নামে ডাকছিলেন, তখন শুনেছিলাম। স্মৃতি ভাল আমার, মনেও আছে।"


তবে আসল সত্য হলো রাত বাড়লে যখন চারদিক নীরব হয়ে আসে, তখন আমার এই পাশাপাশি ফ্লাটে দীপিদের পারিবারিক কথোপকথন আবছা ভেসে আসে। তবে বিগত বছর তিনেকে দীপিতা নিশ্চয়ই মা-বাবার সাথে একসাথে নিচে নেমেছিল, আর সেটা অবশ্যই আমাদের ফ্লাটবাড়ির একমাত্র গেটখানা দিয়ে। এই সামান্য মিথ্যেটুকু তাই ভরসা করে বলাই যেত। এরমাঝে অবশ্য এতরাতে এভাবে একাকি কথা বলবার সুযোগ আবার কবে আসবে তা ভেবে কথা এগুবার ছুঁতো হাতড়ে বেড়াচ্ছিলাম আসমানের এই বান্ধবহীন নিম্নপ্রদেশে।


তবে এবার দীপিতাই কথা বাড়ালো!


- "আপনি প্রতিরাতেই এখানে এসে বসেন, না?" জিজ্ঞেস করলো।


আমি অবাক হয়ে উত্তর দিলাম,
- "হ্যা, এই শহরে হাঁটবারও জায়গা নেই, বারান্দাই ভরসা। তবে আপনি কি করে জানলেন? খেয়াল করেছেন নাকি নজরে রেখেছেন?"


দীপি হাসলো, উত্তর না পেয়ে আবারও প্রশ্ন করলাম,


- "খেয়ালে না নজরে রাখেন?"


দীপিতা এবার কিছুটা বিব্রত, কি ভেবে যেন বলল,


- "আসলে দুটোই। আপনি যখন এসে বসেন, আমি আসি না। সেজন্যই যতটুকু..."
আমি আশাহত হলাম, বললাম,


- "তাহলে আমি ভেতরে যাই, আপনি বসেন।"


- "না না, তা কেন? আপনিও বসুন। অসুবিধা নেই, কথা বলতে ভালই তো লাগছে। শুধু সিগ্রেটটা এখন আর ধরাবেন না।" দীপিতা উত্তর দিল...


আমি হাসলাম, হাসতে হাসতেই নিজেকেই নিজে জানাচ্ছি এমন স্বরে উচ্চারণ করলাম,


- "শ্রেয়াস অন্ততঃ বারান্দাতে আর সিগ্রেট ধরাবে না।"


- "বাব্বাহ, এত দ্রুত পরিবর্তন? যাকগে, আপনার নামটাও জানা, এভাবে নিজে বলে জানাতে হবে না। পাশাপাশি দরজা, দরজাতেই লেখা আছে।" দীপিতাও হাসছিল।


আমি আসলে গলে যাওয়া চরিত্রে অভিনয় করছি ভেবে অমন ঢংয়ে বলেছিলাম, নাম জানাবার উদ্দেশ্য ছিল না। তবু বললাম;


- "আপনার বুদ্ধি ভাল।"


(এরপর...)
- "পড়ে দেখতে বেশি বুদ্ধি লাগে না। দেখতে ভাল সেটাও বলে ফেলুন।"
- "বলবার কিছু নেই, নাহলে সিগ্রেট ছাড়ি?"
- "ছেড়েই দিয়েছেন? ভেতরে গিয়েই তো ধরাবেন।"
- "সেটা তো আপনার আড়ালে, সামনাসামনি তো নয়।"
- "ফ্লার্ট করছেন?"
- "চেষ্টা করছি। মাত্রা না ছাড়ালে নিশ্চয়ই বকবেন না?"
- "সে দেখা যাবে। আমি অবশ্য যাকে তাকে এমনিতেও বকি না।"
- "দীপি, আমি শ্রেয়াস। যে-সে ভেবে বসবেন না!"
- "এখনও ভাবছি না, তাই কথা বলছি। তবে আমি এখন উঠবো। আজ বেশি কথা হয়ে যাচ্ছে।"
- "আজ বেশি কথা হয়ে যাচ্ছে, মানে এরপরেও হতে পারে?"
- "হয়ত পারে! সে পরে দেখা যাবে..."
- "দেখা যাবে আর কি কথা হয়। তবে আমি আসলে যেন বারান্দায় আসা থেমে না থাকে।"
- "মনে থাকবে। আপনি বাঘভাল্লুক নন, আবার সিগ্রেটও ছেড়ে দিলেন, আসা তো যায়-ই। তবে এত সহজ ছেড়ে দেয়া, নাকি অভিনয় করছেন?"
- "তাই মনে হচ্ছে?"
- "সেটা জানা দরকার।"
- "জানতে হলে তো কথা বলা লাগে।"
- "তাহলে হবে।"
- "ঠিক আছে দীপি, আমি উঠি, নইলে আপনি ভেতরে যান।"
- "আপনি দুইবার দীপি বলে ডাকলেন। শুনতে খারাপ লাগছিল না।"
- "এতকিছু খেয়াল করছেন?"
- "আমি এমনই। ভেতরে যাই..."
- "আমিও যাই।"
- "আপনি কেন?"
- "বারান্দাটা এখন থেকে পুরোনো বারান্দা নেই, তাই?"
- "আচ্ছাহহহ?"
- "হা হা, যাই!"
- "হু, বাই!"


ভিতরে গিয়ে সিগ্রেট ধরালাম, অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছিলো। দেয়াল পেরিয়ে এই ঘ্রাণ কি দীপিতার রুমে যাবে? সম্ভবত যাবে না। এখন সময় কয়টা? ঘড়ি আর মোবাইল দুটাই বলছে, রাত আড়াইটা। আগামিকাল তবে ঠিক দু'টায় বারান্দায় গিয়ে বসতে হবে। আমি জানি, দীপিতা কালও বারান্দায় বসবে। আমি আসবার আগেই কি? সম্ভবত না... কিংবা আসবার সাথে সাথে? হতে পারে... এরপর আবছা আলোয় চোখে চোখ পড়লে আমাদের কেউ না কেউ বলে উঠব, "কেমন আছেন?"


আমরা জানবো, আমরা ভাল আছি... অথবা কেউ ভাল নেই... বিরল অসুখে..


(প্রতীক্ষার সূচনা)
কারো প্রতি অনুরাগ সবচেয়ে গভীর থাকে যখন সে অচেনা থাকে, তখন মানুষটার সবকিছু রহস্যের মতো মনে হয়। দীপিতা... মানে দীপি বিগত তেইশ ঘন্টা ধরে আমার কাছে একটা আকর্ষণীয় প্রচ্ছদের পুস্তক, আমি যার শিরোনাম জেনেই তা পড়তে উন্মুখ; ভেতরে কী খুঁজে পেতে পারি সেটা কল্পনা করি, তবে কী পাবো সেটা নিশ্চিত নই।


মাঝখানের সময়টা খাপছাড়া গেছে। ওর সাথে আমার সম্পর্ক নেই কোনো, ভালোবাসা নেই। কোনোকিছুই ছিল না কখনো, তবু এই সময়টায় সম্ভবত কিছু একটার অভাব ছিল, দীপিতার অভাব? মানুষ প্রেম আবরণ ভান করে পরে থাকতে পারে না, যদি পরে ফেলে, তার আগে প্রেমে পড়ে যায়। মাঝের এই সময়টায় আমি আবরণ খুঁজেছি কোনো। হয়ত সেটা প্রেমের নয়, তবে আমি যা, তার চেয়ে কিছুটা আকর্ষণীয় করে তুলবে। আমি এখনও মানি, প্রেম একটা জৈবিক ব্যাপার...


আমি নিশ্চিত ছিলাম দীপি আজও আসবে। মানব মানবীর একে অপরের প্রতি আকর্ষণ হয়ত যুগপত ঘটে, সেটাতে সংশয় থাকে, তবে উভয়েই বোঝে। খুব আস্তে বারান্দার দরজা খুলে দীপি নিজের বারান্দায় এসে দাঁড়ালো, যেন সবই খুব স্বাভাবিক। আমি কান পেতে ছিলাম, যতটা টের পাওয়া উচিত, তার থেকে বেশি পেলাম। ওদিকে তাকাই নি তবু। কিছুটা সময় পর সে নিজেই বলে উঠল,


- "আজ দেখছি আপনি সত্যিই পরিবেশবাদী হয়ে গেছেন!"


আমি প্রশ্ন করলাম, না তাকিয়েই,


- "কেন?"


দীপিতা উত্তর দিলো,
- "এই যে, ধোঁয়ার গন্ধ নেই, তামাক পুড়ছে না।"
- "এখানে তো সিগারেট ধরানোয় কাল নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল!"
- "নিষেধাজ্ঞা? কই? আমি কেবল বলেছিলাম তখন আর না ধরাতে!"
- " হা হা, আমি বলেছিলাম, 'শ্রেয়াস অন্ততঃ বারান্দাতে আর সিগ্রেট ধরাবে না'।"
- "নিজের ডায়লগ নিজেই মুখস্ত করে বসে আছেন দেখছি?"
- "যা বলেছি, সেটা ভুলে যাব তাহলে?"
- "নাহ, তাহলে ভিতরে চলে যাওয়া ছাড়া গতি নেই।"
- "আমিও চাইছি না আপনি যান, তাই মনে রাখা।"


দীপিতা এরপর সম্ভবত সম্ভবত সম্পূর্ণ শরীর ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকালো। এর আগে তাকিয়েছিল নাকি জানি না, আমার দৃষ্টি ছিল সামনে। রাস্তার হলদে সোডিয়াম লাইটে চেনাপথ, গলির দোকান, সব অপার্থিব লাগে। সব সাদাকালো দেখায়, আলাদা রঙ বোঝা যায় না। সুস্পষ্ট নড়চড় টের পেয়ে আমিও ঘুরে তাকালাম। সরাসরি দীপিতার চোখের দিকে। আবছা আলোয় চোখ ভীষণ জ্বলজ্বলে লাগে। মনে হতে থাকে, সেই চোখে ঘোর...


- "আপনি জানতেন আমি এইসময় আসবো?"
- "আন্দাজ করছিলাম।"
- "কেন?"
- "কাল তো এমন সময়েই এসেছিলেন।"
- "আজ এমন সময় আসবো আন্দাজ করলেন কেন? এর আগে তো কখনো আসি নি।"
- "গতকালের আগে তো কথাও হয়নি, গতকালের আগে বলেন নি যে আবার কথা হতে পারে।"
- "তারমানে তো আজকেও নয়।"
- "আপনি জানতেন না আজকেও হবে? এসময় আমি এখানে থাকতে পারি?"
- "তেমনটা নয়। আসলে আশা করছিলাম।"
- "কেন?"


দীপিতা হয়ত সরাসরি এমন প্রশ্নের আশংকা করেনি। উত্তর এড়াতে অথবা কিছুটা সময় নিতে দৃষ্টি সরিয়ে সামনে তাকালো। সম্ভবত ওই সোডিয়াম ল্যাম্পপোস্টগুলোর দিকেই। তাদের দিকে দৃষ্টিতে অস্বস্তি নেই, ল্যাম্পপোস্টগুলো রাত্রিতে মায়াময়, তবে সবকিছুর প্রতি একদম কৌতূহলশূন্য।


আমার মনে হলো, এভাবে প্রশ্নটা করা উচিত হয়নি। অন্যদিকে সরে যেতে এবার আমিই প্রশ্ন করলাম,


- "কতক্ষণ থাকবেন বারান্দায়?"
- "আপনি কতটা সময় থাকবেন?"
- "আপনি যতক্ষণ থাকবেন।"
- "এই রে, তাহলে তো সমস্যা হয়ে যাবে।"
- "কেন?
- "এই 'কেন'টাও কিন্ত কঠিন প্রশ্ন হলো!"
- "হা হা, কিভাবে?"
- "আমি ভাবছিলাম আপনি যতক্ষণ আছেন, ততক্ষণ থেকে চলে যাব।"
- "তাহলে তো একজন আরেকজন যাবার অপেক্ষায় থেকে কারোরই যাওয়া হবে না।"
- "হ্যা, এখনই সিদ্ধান্ত না বদলালে চিরতরে এখানেই থেকে যেতে হবে।"
- "খুব যন্ত্রণার হয়ে যাবে নাকি?"
- "উম, এখনো তেমন মনে হচ্ছে না।"
- "কেন?"
- "আপনি আরেকবার 'কেন' বললে কিন্তু এরপর থেকে আপনাকে উত্তরগুলো নিজেই বলে যেতে হবে, এটা নতুন নির্দেশ।"
- " হা হা! কেন? আমি আপনার নির্দেশ মানতে বাধ্য?"
- "হয়ে যান।"
- "আর জিজ্ঞেস করবো না, 'কেন'। জানতে চাইছি বাধ্যগত হলে আমার কী লাভ?"
- "লাভ সুদে আসলে দেয়া যাবে। তার আগে কী কী লাভ আশা করছেন সেগুলো বলে ফেলুন দেখি।"


বিপদে পড়ে গেলাম। এই মুহূর্তে অন্যকিছু চাইছি, অনেককিছু নয়, কেবল একটাকিছু। কিশোরের গভীর অভিমানের মত বালখিল্য আবেগ এসে ভর করছে। কোনো শব্দ খুঁজে পাচ্ছি না। আমার ইচ্ছা করছে আমি দীপিতার হাত স্পর্শ করি। চাইলে দেবে? আচরণে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছি না তো? প্রসঙ্গ এড়াতে, আর নিজেকে সামলাতে বললাম,


- "সুদ আসলের হিসাব বছর শেষে হয়, এত দ্রুত না জানাই, ভেবে এরপর বলি?"
- "কতটা সময় লাগবে ভাবতে?"
- "আপনি যতটা দিতে রাজী।"
- "হা হা! তাহলে আপনাকে পুরো একটা জীবন দেয়া হলো!"
- "সার্কাজম?"
- "না, তা কেন?"
- "মনে হলো।"
- "হা হা, অতকিছু মনে করতে হবে না, সত্যিই দিলাম।"
- "তাহলে এখান থেকে চলে যাবার আগে বলবো, ঠিক আছে?"
- "আচ্ছা। এর মাঝে আর কিছু বলবেন না?
- "সেটা বোঝাই নি।"
- "তাহলে বলতে থাকুন।"
- "ভাবছি কী বলা যায়।"
- "ভেবে কী বের করলেন?"
- "এই যে প্রশ্ন করছি, কী বলা যায় তাও জানতে চাইছেন, এসবও তো বলা, তাই না? এর বাইরে ঘাস-ফুল-লতাপাতা ছাড়া মাথায় কিছু আসছে না। অবশ্য বাংলা নাটকের সংলাপের মত প্রশ্ন করা যায়, আপনার পাহাড় পছন্দ নাকি সাগর।"
- "যদি সত্যি জিজ্ঞেস করতেন, তবে আমি বলতাম আমার পছন্দ নিজ কক্ষের ছাদ।"
- "আকাশ নয় কেন? আপনি কি নৈরাশ্যবাদী?"
- "তা নয়, তবে বিছানায় শুয়ে উপরে তাকালে ছাদটাই চোখে পড়ে। এতবার পড়ে যে প্রিয় হয়ে গেছে। ওটা আমাকে নিজের চাহিদার সীমার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।"
- "মানুষ তো সীমা মানতে চায় না। আপনি তার বাইরে?"
- "সীমা কেবল কল্পনার থাকে না, বাস্তব অন্যরকম। নিজের চাহিদার সীমা জানা লাগে, সেটাই আপনাকে ভালো থাকতে দেবে।"
- "আপনাকে নৈরাশ্যবাদীই মনে হচ্ছে, কোথায় যেন হতাশা টের পাচ্ছি।"
- "হতেও পারি। এমন কেউ থাকতে পারে না? যাইহোক, আমি এখন আসি। ভিতরে গিয়ে ছাদের দিকে তাকিয়ে থাকি, নিজের সীমাটার কথা মনে করে আসি।"
- "নৈরাশ্যবাদী বলায় রাগ করেছেন?"
- "না, অত অল্পে রাগ করলে চলে?"
- "আপনি কিন্তু বলেছিলেন আমি চলে যাবার পর আপনি যাবেন।"
- "তাহলে আমি আপনাকে অনুরোধ করছি আপনি চলে যান, আমি আমার কথামত আপনার পরেই যাব।"
- "আচ্ছা, তবে যাই।"
- "শুনুন, যাবার আছে বলে যাবার কথা ছিল কী লাভ আশা করছেন, সেটা নাহয় বলেই যান।"


আমি বেশি সময় ভাবলাম না। জীবনের ছোটখাটো অনেক সিদ্ধান্তও মানুষ ভেবেচিন্তে নেয়, তবে আমার মনে হলো, ভাবাটা জরুরি নয়। আমি বললাম,


- "আপনি হাতটা বাড়ান। আমি ছুঁয়ে দেখতে চাই!"


দীপিতার চোখে, শরীরের ভাষায় দ্বিধা সুস্পষ্ট। আড়ষ্ট কন্ঠে বললো,


- "মানা করবো না, তবে এখন নয়। ঠিক একবছর পর এই সময়ে। এরমাঝে আমি বারান্দায় আসবো না, আপনি আসলেও না, যখন না থাকবেন তখনো না।"


আমি এবারও ভাবার সময় নিলাম না। বললাম,


- "ঠিক এই সময়, একবছর পর। একবছর খুব বেশি সময় নয়।"
- "আসি তাহলে।"
- "আচ্ছা। তবে একবছর পর আমি অবশ্যই আসছি।"
- "সময় বলে দেবে।"
- "সময় নিজে থেকে বলবে।"
- "যাই, ভালো থাকবেন।"
- "আপনিও।"


নিজ রুমে ফিরে এলাম। বিছানায় শুয়ে আবার সেই ভরসা সিগ্রেট, বারান্দায় ধরানো নিষেধ, এখানে নেই। চোখে এখনো গতকাল আজ আজকের সবকিছুর দৃশ্যপট ফিরে আসছে। মনে হচ্ছে, আমি গতানুগতিক যেভাবে একা চলে আসি সেখান থেকে, সেভাবে আসিনি। আমার সাথে চলে এসেছে একটা কমিটমেন্ট। প্রেমের নয়, ভালোবাসার নয়, ওসব আমি বুঝি না। তবে কোনো কমিটমেন্ট অবশ্যই, একটা অপেক্ষা পর্বের কমিন্টমেন্ট, যা আজও বুঝিনি, তেমন ভিন্নকিছুর মোহে।


দীপিতাকে আমি চিনি না। আমি অন্য হাজার নারীকে চিনি, আকর্ষণীয়া। তাদের দিকে আমি তাকিয়েছি প্রথাগত পুরুষের চোখে। দীপিতার পরনে কী ছিল আজ? ঠিক চোখে ভাসছে না। ওর চোখ মনে পড়ছে, মনে পড়ছে... ওর চোখ ছিল বেদনার মত মনকাড়া!
আমি জানি, এই একটা বছর আইনস্টাইনের থিওরী অফ রিলেটিভিটি আরও বেশি করে মনে করাতে পারে। তবে এক বছর খুব দীর্ঘ সময় নয়, ঠিক এক বছরেই পেরিয়ে যাবে...


আবারো বারান্দায় (সমাপনী পর্ব)
কিছুক্ষণ পর আমি বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াব। গত একটা বছরে আমি আরও বহুবার বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়েছি, আর প্রতিটাবার আমার চোখে ভেসে উঠেছে আশ্চর্য একটা মোহমাখা স্মৃতির রিক্যাপ। চক্র ভেঙে ফেলতেও নাকি চক্রের ভিতর প্রবেশ করতে হয়। মোহও এক আশ্চর্য অলঙ্ঘনীয় চক্র, কিছু মোহের জন্ম কোথায় আর কোন কারণে, কেই বা জানে?


প্রতীক্ষাপর্ব শেষ হয়ে এলো বলে। আর মাত্র ৫, ১০ বা ১৫ মিনিট সময় পর কী অপেক্ষা করছে সেটা আমি জানি না। আসলে, আমিতো দীপিকে সেভাবে চিনিও না। যাকে সেভাবে চিনিনা জানিনা, তার জন্য এমন উদগ্রীব হয়ে প্রতীক্ষা করাটা কিছুটা অস্বাভাবিক। এই প্রতীক্ষা পর্বে আবেগের নানা ধাপ ছিল। সে রাতে বারান্দা থেকে চলে আসবার পরে প্রথম সাতটা দিন ছিল অন্যরকম একটা ঘোরের, আনন্দের, সংশয়ের, কিছুটা যন্ত্রণার। ঘুম, মনোযোগ সবকিছু কমে গিয়েছিল, বেড়ে গিয়েছিল কেবল সিগ্রেট। এরপর প্রায় পৌনে এগারোটা মাস মোটামুটি স্বাভাবিক, শুধু প্রতিরাতে কিংবা একদম একাকি নিরিবিলিতে মাঝেমাঝে ভেসে উঠতো দীপি। আমি যখন দীপিতার কথা ভাবি, ওর পরিচয় হয় দীপি, দীপিতা নয়। মানুষ তাদের প্রিয়মুখেদের নাম সংক্ষিপ্ত করে ফেলে, আদুরে করে ফেলে। কিন্তু দীপি আমার প্রিয়মুখ হলো কবে থেকে? দীপি কি আদুরে?


বিগত একটা বছর প্রতিদিন কিছু মুহূর্ত বাদ দিলে আমি শ্রেয়াস, অবিকল আগের শ্রেয়াস। আমার চোখ গিয়েছে অন্য নারীর দিকে, অন্য তরুণীর দিকে, কামনা জেগে উঠেছে। তবে কিছু একটা পরিবর্তন তো আমার মধ্যেও ছিল। নারীপ্রিয় হয়ে উঠবার আমার যে সহজাত সক্ষমতা, সেটা ভোঁতা হয়ে যাচ্ছিল। সক্ষমতা কাজে লাগাতে ইচ্ছেদেরও যে জেগে ওঠা লাগে। তবে সক্ষম হতে পারবার এই অক্ষমতায় আমি অসুখী ছিলাম না। সুচারু একটা অপেক্ষা পর্ব শেষ করবার জেদ, অথবা জেদও না, নেশা চেপে বসেছিল যা পেরোলে আমারও হয়ে উঠবার সম্ভাবনা থাকে সবচেয়ে সক্ষম, অন্তত একজনের জন্য নিজেরই কাছে। ব্রক্ষান্ডে জ্ঞাত পৃথিবী একটাই, যেখানে একটা মানুষ আবার হয়ে উঠতে পারে আস্ত আরেকটা পৃথিবী।


প্রতীক্ষার শেষ একটা মাস দিন গোণা শুরু হয় আবার। শেষ একটা মাস কাটিয়েছি প্রথম সাতটা দিনের মত অস্থির ও বেকার। তবু সময় যতই ধীরে কাটছে বলে মনে হোক, সময় বহমান। এইযে আমি আজ এখানে, আমি বারান্দার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি, এইতো, এখনই...


বারান্দায় দাঁড়িয়ে কিছু সময় নীরব, কিছুটা সময় নিথর দৃষ্টিতে কেবল সামনের রাস্তার সোডিয়ামবাতি। আমি দীপিতার উপস্থিতি টের পাচ্ছি! বিগত একবছরের যে প্রতীক্ষা, সেখানে সংশয় ছিল, শংকা ছিল। বহুবার ভেবেছি, ছলনা কিংবা খেয়ালে বলে বসা কোনো মিথ্যা প্রতিশ্রুতি নয়তো? ঠিক এ মুহূর্তে আমি জানি, তেমনটা নয়। দীপিতা মনে রেখেছে নির্দিষ্ট তারিখ... সময়...


দীপিতা আবারো দাঁড়িয়ে, পাশাপাশি বারান্দায়। এত নীরবে এসেছে, দরজা ঠেলে ঢুকবার আওয়াজ আলাদা করা যায়নি, নাকি খোলাই রেখেছিল? হঠাৎ শুধু ভেসে এসেছে বাতাস সম্বল করে মৃদু একটা ঘ্রাণ। খানিকটা সময় নিশ্চুপ, খানিকটা সময় কথা শুরু করবার মতো কোনো শব্দ পাচ্ছিলাম না। গত একটা বছর কল্পনায় কতকিছু ভেবেছি, কিন্তু যদি সত্যি দীপিতা আসে, তবে কী বলে কথা শুরু করব সেটা ভাবিনি। দীপিতাই বলে উঠল,


- “তারপর? শ্রেয়াস দেখছি দিনক্ষণ মনে রেখেছেন?”
- “মনে না রাখলে খুশি হতেন?”
- “না, অপমানিত হতাম।“
- “আর মনখারাপ?”
- “সেটাও কিছুটা হতো।“
- “কেবলই কিছুটা?”
-  “আজব! আমার কি সামান্য হাত ধরবার অনুরোধ রাখতে না পেরে অশ্রুগঙ্গা বইয়ে দেয়া উচিত বলে ভাবছেন?”
- “হাত ধরবার ব্যাপারটা তাহলে সামান্য?”
- “আপনি কি ঝগড়া করতে এসেছেন?”
- “আমি যার-তার সাথে ঝগড়া করিনা?”
- “যার-তার কাতারে নামিয়ে আনলেন?”
- “নাহ, তাহলে আমি আজকে এখানে কেন?”
- “কেন?”
- “হাত ধরতে...”


এতক্ষণ আমরা একজন আরেকজনের দিকে না তাকিয়ে কথা বলছিলাম। এবার বুঝলাম, দীপিতা হুট করে আমার দিকে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। দীপিতা বলে উঠল,
- “আচ্ছা, ধরুন।“


পাশ ফিরে তাকিয়ে আমি কিছুটা হতবুদ্ধি হয়ে গেলাম। বারান্দার রেলিং পেরিয়ে আমার দিকে বাড়ানো দীপিতার হাত। অন্ধকারেও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, নববধূর মত মেহেদির কারুকাজ হাতে, হাতভর্তি কাঁচের চূড়ি। দীপিতা হালকা সেজেছে, সেজেছে যত্ন নিয়ে। আমি বোকার মতো বলে উঠলাম,


- “সত্যি ধরবো?”
- “একবছর আগের ইচ্ছেটা মরে গেছে? না মরে গেলে ধরুন।”
- “না, তা নয়। কিন্তু হাত ধরবার পর?”
- “হাত ধরবার পর আবার কী? একমিনিট ধরে থাকবেন, এরপর ছেড়ে দেবেন, চলে যাব।“
- “তাহলে বরং পরেই ধরি। আমি চাইনা আপনি এত দ্রুত চলে যান।“
- “হাত ধরবার অনুরোধই তো কেবল ছিল, সেটা মেটালে আর কী থাকে? কেন থাকবো?”
- “হাত ধরে যদি নতুন অনুরোধ করি?”


দীপিতার মুখ কালো হয়ে গেল নাকি আমি বুঝলাম না, ও আমার চোখের দিকে না তাকিয়ে হাত সরিয়ে সামনের দিকে তাকালো। আমরা আবার পাশাপাশি, বারান্দায়, কেউ কাউকে দেখছি না... দীপিতা সামনের দিকে তাকিয়ে হালকা স্বরে বললো,


- “আমার পক্ষে কাউকে আর কোনো অনুরোধ রাখবার কথা দেয়া সম্ভব নয়।“
- “কেন?”
- “আপনাকে না একবার বলেছিলাম আমার সামনে ‘কেন’ শব্দটা আর উচ্চারণ করবেন না।“
- “এটাও মনে আছে?”
- “থাকবে না কেন?”
- “এতটা মনোযোগও আশা করিনি।“
- “মনোযোগ চাইছেন না তাহলে?”
- “কথা রাখবার কথা দেয়া আর সম্ভব না হলে মনোযোগ কামনা মনঃকষ্ট বাড়াবে।“
- “বাব্বা, উনিও মনঃকষ্টে ভুগবেন দেখছি।“
- “আরও অনেকে ভুগেছে নাকি?”
- “নাহ, ভুগবে।“
- “কে?”
- “আমি...”


দীপিতা সম্ভবত নাটক করছে। নাকি করছে না? আমি ঠিকঠাক বুঝতে না পেরে বললাম,
- “কেন?”
- “আমি যাকে পছন্দ করি, আপনাকে কথা রাখবার কথা দিলে সেও মনঃকষ্টে ভুগবে কিনা, তাই।“


জানিনা, কেন যেন মনখারাপের অনুভূতি হলো না। মনে হলো আমি একটা শৃংখল থেকে মুক্ত হলাম। অথবা... অথবা ঠিক নিশ্চিত না, হতে পারে আমি পরিস্থিতি বুঝতে পারছি না। প্রচন্ড মনখারাপের অনুভূতি আমাকে যেন গ্রাস না করে, সে কারণে আমার অবচেতন মন আমাকে নির্ভার করতে ভ্রান্ত একটা জগতের দিকে নিয়ে যেতে চাইছে, মোহমুক্ত একটা জগত। আমি অনেকটা ভাবলেশহীন কন্ঠে বললাম,


- “তাহলে আমি আর আপনার মনঃকষ্টের কারণ হচ্ছি না। নতুন পুরনো কোনো অনুরোধই মাথায় রাখবার প্রয়োজন নেই।“
- “হাতটাও ধরবেন না?”
- “তার আর প্রয়োজন নেই।“
- “কেন?”
- “তাহলে আমারও কিছু সময় মনঃকষ্ট নিয়ে পার করতে হবে।“
- “আপনি পঞ্চাশের দশকের বাংলা সাহিত্য থেকে মনঃকষ্ট শব্দটা কিভাবে তুলে এনেছেন বলুন তো।“
- “আপনি কি আমার সাথে রসিকতা করছেন?”
- “রসিকতা শব্দটা বাদ দিয়ে সহজে ‘মজা’ শব্দটা ব্যবহার করলে সহজ শোনায়।”
- “মজা করছেন?”
- “হু, করছি।“
- “আমি এসব নিতে পারছিনা, দুঃখিত, আমি আসি।“
- “শ্রেয়াস, সহজ করে বলুন, ‘সরি, আমি চলে যাচ্ছি, বাই।“
- “এত মজা নেয়ার প্রস্তুতি নিয়ে আসিনি। বিদায় নিচ্ছি।“
- “হাত না ধরেই?”
- “হ্যা, আপনার পছন্দের মানুষটা অন্য কেউ গভীর রাতে আপনার হাত ধরেছে জানলে কষ্ট পাবেন। আমি কারো কষ্টের কারণ হতে চাই না, এই একুশ শতকেও খাঁটি মনঃকষ্টের। জগতের সকল প্রাণি সুখী হোক।“
- “গৌতম বাণীতে সার্কাজম, অভিনব?”
- “এভাবে আমিও একবার বলেছিলাম, ‘সার্কাজম’। আর অভিনব না বলে সহজ করে জোস বলতে পারতেন। সে যাই হোক, আমি যাই। ভাল থাকবেন।”


দীপিতা কি ব্যাঙ্গাত্মক সুরে বলে উঠলো, “আমার ললাট”? বুঝতে পারলাম না ঠিক, তবে আমার মনে হলো এখানে দাঁড়িয়ে থাকা অর্থহীন। এখান থেকে দ্রুত চলে যেতে হবে। এরপর কিছুদিন সিগ্রেট বেশি হলে, হোক! কিছুদিন বারান্দার দিকে হাঁটা ধরে থমকে যেতে হলে, হোক! এসব সামান্য ব্যাপার। দীপিতার সাথে আমার কখনোই কিছু ছিল না, কিংবা হয়নি। হয়নি যে ভেঙে যেতে হবে। জীবন চলবে, জীবন অবশ্যই স্বাভাবিক হবে আবারো। মানুষের হৃদয় পৃথিবীর অন্য যেকোনো কিছুর চেয়ে অনেকবেশি সর্বংসহা...


আমি অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে আমার কক্ষের দিকে ঢুকে যেতে শরীর ঘুরিয়েছি, দীপিতাকে দেখতে চাইনা। কিন্তু আমি তো কেবল ওর হাত দেখছিলাম মুগ্ধ চোখে, কী পরেছিল ও আজকে? ঠিক চোখে ভাসছে না। না ভাসাই মঙ্গল, আমি ফিরে যাচ্ছি... কিন্তু দীপিতা এবার জোরে ডেকে উঠল,


- “এই যে... শ্রেয়াস...! ভাল করছেন না কিন্তু।“


আমি ঘরে ঢুকতে যাবার মুহূর্তে কী যেন ভেবে উত্তর দিলাম,


- “আমি আমার জন্য ভালোটাই বেছে নিয়েছি।“
- "এতবেশি ভাল বুঝলে এরপর তবে দুবছর।"
- "দুবছর কী?"
- "শাস্তি। দুবছর অপেক্ষা। এরপর... দীপিতার সাথে... আবারো বারান্দায়। তবে হাত ধরতে দেবার অফার তখন আবার রিনিউ করতে হতে পারে, সেজন্য আরও একবছর।"


আমি এতটা সময় পর এসে কী চলছে তার কিছুটা আন্দাজ করতে পারলাম। হয়ত ভালোলাগার অনুভূতি গ্রাস করলে, কিংবা কারো প্রতি অতিরিক্ত অবসেসড হয়ে গেলে অনেক পুরুষ যেমন বেপরোয়া হয়ে ওঠে, কেউ কেউ হয়ে যেতে পারে নির্বোধ, যেমন আমি। আমি ফিরে এসে দীপিতার দিকে মুখ ফিরে দাঁড়ালাম, তাকালাম দীপিতার চোখের দিকে, আমরা এবার মুখোমুখি, পাশাপাশি বারান্দায়। আমি বললাম,


- “ইফ আই এম ইওর গেম, লেট দ্য গেম কাম টু ইউ। ডোন্ট রাশ, ডোন্ট হারি...”
- "উম, পঞ্চাশ দশকের মুখে ইংরেজি বুলি কেন?”
- “সিরিয়াস মুডে চলে গেলে এ সমস্যাটা হয়।“
- “কী সমস্যা?”
- “নিজের ভাষাটা খুঁজে পাইনা, এলিয়েন হতে চাই, যাতে মনে হয় আমি নই, অন্য কেউ সাহস করে আমার কথাগুলো বলে দিচ্ছে।“
- “আপনি তাহলে আমার গেম নন?”
- “আমাকে সত্যি গেম ভাবছেন?”
- “ভাবলে সমস্যা?”
- “যাকে তাকে গেম বানিয়ে ফেলবার ব্যাপারটা আপনার পছন্দের মানুষ জানলে কষ্ট পাবেন না?”
-   “গেম নয়, বলুন খেলা। খুনসুটি খেলা।“
- “সে আপনি যে নামই দিন না কেন, অর্থ তো একই।“
- “ও আসলে কষ্টে নেই, ভ্যাবাচ্যাকায় আছে, সে কারণে পলাই পলাই ভাব।“
- “কোথায় পালাচ্ছে?”
- “বারান্দা থেকে, নিজের ঘরের দিকে। সম্ভবত সিগ্রেটের প্যাকেট ডাকছে, ‘আয় আয়’।“
- “সেটা তো আমি। আপনার পছন্দের মানুষের জায়গায় আমাকে বসিয়ে দিচ্ছেন কেন? খেলার নতুন কৌশল?”
- “কৌশল তো গত একবছরের অপেক্ষা করিয়ে রাখাটাও ছিল।“


আমি বুঝলাম গত ৫-৭ মিনিট ধরে দীপিতা আমার সাথে কী চালিয়ে যাচ্ছিল। কথার খেলা, যে খেলাটা আমরা একবছর আগেও দুবার খেলেছি। যে খেলা শুধুমাত্র খেলা নয়। আমি বললাম,


- “অপেক্ষার এ কৌশলে কী লাভ হলো?”
- “অপেক্ষা একটা পরশপাথর। নাহ, অপেক্ষা করাটা নিজের জন্য একটা কষ্টিপাথর, নিজে কী চাইছি সেটা যাচাই করে নিতে।“
- “যাচাই করেছেন নিজেকে?”
- “করেছি, আপনাকেও, অনেকটা।“
- “এত সহজ তবে যাচাই করা?”
- “গত একটা বছর আপনার কাছে খুব সহজ ছিল?”
- “নাহ, সহজ বলতে পারলে ভাল হতো।“
- “সেটাই। আজকাল কেউ কারো জন্য অপেক্ষা করতে চায়না। কিন্তু ভালোবাসা বুঝতে সময় প্রয়োজন, ধৈর্য্য ধারণ করতে হয় গাঢ় করতে।“
- “আমরা কি তবে ভালোবাসার পথে? এত সহজে?”
- “দারুণ ব্যাপার মনে হচ্ছে না?”
- “কীভাবে?”
- “স্পর্শের আগেই প্রেম, পবিত্র প্রেমের আদর্শ সংজ্ঞার কাছাকাছি।“
- “আরে, স্পর্শের লোভেই তো প্রেমের এমন ভান।“
- “সবকিছু তাহলে ভান?”
- “এই মুহূর্তে ভানটাকেই সত্য মনে হচ্ছে। ভানের প্রতিক্রিয়ায় আমি একইরকম ভান চাইব।“
- “তাহলে কী হবে শুনি।”
- “ভান করে ভালোবাসলেও হাতখুলে সব দেয়া যেত।
     অন্ততঃ অরণ্যের বুকে ঢেলে দিতাম অঢেল জোছনা।“
- “কবিতা?”
- “না, প্রতিশ্রুতি। যদি সেটা আপনার পছন্দের মানুষের কষ্টের কারণ না হয়।“
- “ সে তো নিজেকে অন্য কেউ ভেবে বসে আছে, আর তার সূক্ষ্ম মস্তিস্কে এই স্থুল কথাটা কেন যে ঢুকছে না...“
- “নতুন কোনো অনুরোধ জানালে তাহলে আমিই কষ্ট পেতাম?”
- “হু, তেমনটাই বোঝাতে চেয়েছিলাম।“
- “কিন্তু কেন?”
- “ঝোঁকের বশে। আসলে আমি হুট করে বলে বসলাম এখনই হাত ধরুন। এরপর কী করতাম তবে? অমনটা ঠিক হয়নি। এরচেয়ে এই যে কথার খেলা খেলছি, ভালোলাগছে। প্রতিটা শব্দ স্মৃতিতে থেকে যাবে।“
- “সেটা নয়, জানতে চাইছি আমার অনুরোধ রাখলে আমিই কষ্ট পেতাম কেন?”
- “কী কী অনুরোধ করতে পারেন সেটা অনুমান করেছি, নতুন শর্ত জুড়ে দিলে ভালোলাগতো?”
- “অনুমানে কী কী ছিল?”
- “এই যেমন পাণি প্রার্থণা, ঘুরতে যাওয়া কিংবা আমাকেই চেয়ে বসা...”
- “বেশ ভাল বোঝেন দেখছি।“
- “ঠিক হয়নি।“
- “জানিনা। আমিতো নিজেই জানিনা কী অনুরোধ করতাম। কথা বাড়াবার নেশায় বলে ফেলেছিলাম।“
- “কথা বাড়াবারও নেশা হয়?”
- “হয়না বুঝি?”
- “আমার হয়নি।“
- “মিথ্যা বলছেন।“
- “ধরে ফেলেছেন?“
- “এটা তো বাড়িয় দেয়া হাত ধরবার মত কঠিন কাজ নয়। সহজ।“
- “বাড়িয়ে দেয়া হাত ধরতে সংশয় কাজ করছিল?”
- “সেটাও নয়।“
- “তাহলে?”
- “চেয়েছি মহার্ঘ মুহূর্তের সূচনা বিলম্বিত হোক।“
- “গল্প কবিতা লেখেন বুঝি।“
- “এমন প্রতীক্ষাপর্ব এলে সেটা যে কেউ লিখতে পারবে।“
- “পারলে এখন কিছু লিখে আনুন, আমি দেখতে চাই।“
- “থাকুক, কথাটা সিরিয়াসলি না নিলেই ভাল।“
- “আমি বলছি লিখে আনতে, আপনি আনবেন। সময় সর্বোচ্চ পাঁচমিনিট, একটু দেরি হলে আমি আর নেই।“


দীপিতার চোখের দিকে তাকালাম আমি, সেখানে ইশারা নাকি নির্দেশ ঠিক বুঝতে পারছি না। বুঝলাম ভেতরে যেতে হবে, এড়াবার ক্ষমতা আমার নেই। আমি নীরবে নিজের ঘরে ফিরে ড্রয়ার থেকে রাইটিংপ্যাড বের করে দ্রুত লিখতে শুরু করলাম,


“বিগত একটা বছর আমি ভালোবাসার সংজ্ঞা খুঁজে বেরিয়েছি, নিজের বদলে যাওয়াটাকে ঠিকঠাক জানতে, বুঝতে পারিনি। আসলে প্রকৃত ভালোবাসা তো এমনও হতে পারে, যা অনেক স্পর্শেও ছোঁয়া যায়না। প্রকৃত ভালোবাসা হতে পারে স্বপ্নের ঘোরে চোখে ভেসে ওঠা কালোকাঠের দোচালা একটা বাড়ি, যা কখনো গড়া হবেনা। হতে পারে একটা রহস্য, যা না ভেদ করেই দুটো জীবন অস্তাচলে যেতে পারে, হাসিমুখে।


আমি জানিনা তুমি কী ভাবছো, কী ভাবতে পারো। জানিনা এটা মোহ নাকি ভালোলাগা নাকি ভালোবাসা, নাকি অন্য কোনো নাম তার। ঠিক এই মুহূর্তে ভালোবাসা আমার কাছে ক্ষণিকে নেয়া একটা সিদ্ধান্ত। ঠিক এই মুহূর্তে আপনি থেকে তুমি পর্বে চলে আসা এই চিরকুট দস্তাবেজে। আর এ কথাগুলো লেখা শেষ হলে আমার তরফ থেকে ঘোষিত যে সম্পর্ক, ভালোবাসা, প্রেম অথবা অন্য যে নাম হোক তার, সেটাও ষ্পর্শের কামনা এড়িয়ে, ষ্পর্শ ব্যতিরেকেই...”


(সমাপ্ত)