নব্বইয়ের দশকে নাটোর-জয়পুরহাট রুট এ চলাচলকারী ট্রেন এ নাটোর থেকে যাত্রা শুরু করে জয়পুরহাট (৭০ কি.মি ) পৌঁছতে সকাল থেকে সন্ধ্যা হয়ে যেত। পাড়াগায়েও স্টেশন ছিল।  এইটুকু রাস্তায় প্রায় সতেরোটা স্টেশন ছিল। নামগুলো ছিল দারুন ,যেমন:বীরকূটশা,হেলালিয়া,ছাতিয়ানগ্রাম,জাফরপুর ! ট্রেনের নাম তো আরো মজার ! থার্টিন আপ,ফোর্টিন ডাউন,সখিনা,উত্তরবঙ্গ শাটল,রকেট মেইল,উত্তরা মেইল।টিনের সিট,আগে গেলে আগে পাবে ভিত্তিতে বারাদ্দ। ২x১ ইঞ্চির শক্ত কাগজের টিকেট,সরকারী বানী হিসেবে লিখা থাকতো 'ছেলে হোক মেয়ে হোক দুটি সন্তানই যথেষ্ট "। কিন্তু ট্রেনের টিটি এই টিকেট পেলে মুখ কালো করতো,বিরস মুখে সাইন করতো। টিকেটবিহীন যাত্রী পেলে খুশিতে চকচক করতো তাদের চোখ,দশ -পনেরো টাকার ভাড়া চার পাঁচ টাকায় সই। এমনকি সিগেরেট নিয়েও ভাড়া মাফ করার কাহীনি ছিল। ছাত্ররা আবার তাও দেয়না।দু একজন ভদ্রতার খাতিরে টিকেট কাটলেও তা আবার 'হাফ টিকেট !'(মুল ভাড়ার ৬৬% )মানুষ গিজগিজ,হাঁস -মুরগী- ছাগল -পাগল -ফকির কেউ বাদ যায়না। জানালার পাশে ট্রেনের গা ঘেষে ঝুলিয়ে দেওয়া হত ডাবের বাদা,কুমারের হাড়িপাতিল,সাইকেল,গরুর গোবরের তৈরী লম্বা লম্বা জালানীর বোঝা। ট্রেনের মাঝে যাত্রীদের গল্প,চাচাদের হেলাল ৭৮৭ নং বা মতি বিড়ির টান,উঠতি যুবকদের পা ছেড়ে বা দরজার হ্যান্ডেল ধরে K-2 সিগ্রেটের ধোঁয়া,বাচ্চাদের কান্না,মা চাচীদের দুখ -সুখের গল্প ,হকারের 'এই চানাচুররররর বা টাইগার বাম যেখানেই লাগাবেন সেখানেই কাম অথবা এই ক্ষীরা লাগবে জালি ক্ষীরা ' জমিয়ে রাখত ট্রেন।সদ্য বিয়ে করা গ্রাম্য যুবকের বৌ কে সাত-আট টাকায় সোনালী মালা,বা মাথার খোপা কিনে দেওয়া আর সেটা নিয়ে বৌ এর লাজুক হাসি লাখ টাকায় মিলবেনা। কালের পরিক্রমায় এখন উত্তরা আর রকেট মেইল টিকে আছে।  এখন তো আন্ত:নগরের যুগ! ঘন্টাখানেক লাগে সেই একই দুরত্বে ,স্টেশন ও কমে চার পাঁচটায় দাঁড়িয়েছে ! জীর্ন সেই বাতিল  স্টেশনগুলো যখন  অতিক্রম করে ট্রেন  তখন নস্টালজিক হয়ে যাই,কত রংরুপে আর জনসমাগমে ভরপুর ছিল একসময় এই স্টেশন গুলো,আজ পরিত্যাক্ত ,জীবন সায়াহ্নে ! আসলে জীবন যত গতিময় হচ্ছে,আবেগ আর অনুভুতি পাল্লা দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে ।