তারিখটা মনে আছে?
৫ই ফাল্গুন...
ও এসেছিল আমাদের কাছে।
তুমি বললে মেয়ে হলে বেশ হত ...
কেন হল ছেলে !
হাসপাতালের বেডে শুয়ে ক্লান্ত আমি,
শুধু হেসেছিলাম।
ওর ছোট্ট ছোট্ট হাত পা , নরম শরীর যখন আমার শরীর ছুঁতো
মনে হত...আহা রে বাছা আমার !
খুব পেটুক ছিলাম আমি। খেতে বড় ভালবাসতাম।
কিন্তু ও আসার পর যেন ও খেলেই আমার খাওয়া...
ওতেই শান্তি !
তারপর যখন বাবু টলমল পায়ে হাঁটতে শিখল ...
মনে আছে সেই লাল জুতোটার কথা !
তুমি কিনে এনেছিলে...
জুতোটা যত প্যাকপুক আওয়াজ করত ও তত ছুটত।
মাত্র দেড় বছর বয়েসে ওকে তুমি স্কুলে ভর্তি করে দিলে...
আমার আপত্তি শোননি
সহবত শেখার স্কুল...
ছেলে নাকি আমাদের সহবত শিখবে !
আর কিছু বলিনি আমি,
শুধু প্রথম যেদিন ও স্কুলে গেল খুব কেঁদেছিলাম।
আমার ছোট্ট ছেলেটাকে নাকি সেদিন স্কুলে ম্যাডামরাও রাখতে পারেনি...এত কেঁদেছিল ।
আস্তে আস্তে বড় হল আমাদের ছোট্ট সোনা...
তুমি বললে আজকালকার দিনে শুধু পড়ালেখা করলে কিছু হয়না
দিলে ভর্তি করে আঁকার স্কুলে, অভাবের সংসার তাও।
আঁকায় খুব মনও ছিল আমাদের বাবুর...
রংবেরঙের পেন্সিল পেলে তো আর কথাই নেই...
চারিদিকে রঙের আঁচড় কেটে দিত...
মনে আছে ওই দিনটার কথা!
যেদিন ও প্রথম একটা বসে আঁকোতে ফার্স্ট হয়েছিল...
তুমি বলেছিলে, বাবু আরও বড় হতে হবে তোমাকে।
খুব বোকা ছিল আমার ছেলেটা...
বড় হবার বড় সাধ ছিল ওর।
সমসময় বলত মা, কবে বাপির মত বড় হব?
বেশ মজা হবে, যা ইচ্ছে করতে পারব।
ওর স্বপ্ন পূরণ হল...
বড় হল ও।
তোমার বরাবরের শখ ছিল ছেলে ইঞ্জিনিয়ার হবে...
বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে এডমিশনও নিল
কিন্তু তখন অত টাকা ছিল না আমাদের
সামর্থ্য খুব কম...
তারউপর তখন তুমি রিটায়ার্ড পারসন...
আমিই চেষ্টা করতাম ভাতেভুতে খেয়ে বাবুর কলেজের ফিজ জোগাতে ।
আমার বাবু হস্টেলে ভাল আছে, এটা ভাবলেই
বেগুনপোড়া দিয়ে মাখা ভাতটাও অমৃত মনে হত।
তারপর একদিন ছুটিতে ও বাড়ি এল...
গলা জড়িয়ে ধরে বলল,' মা গো একজনকে ভালবাসি।'
প্রথমটায় খুব রাগ হল শুনে...
তুমি বোঝালে আজকালকার দিনে এসব নর্মাল। মেনে নাও।
মেনে নিলাম, বাবুর কথা ভেবে।
কিছুদিন পর মেয়েটি বাড়িতে এল...
বেশ চিকন মুখখানি, চটপট কথা বলে...
মনে ধরল আমার।
বুঝলাম বড় ঘরের মেয়ে...
ভয় হল আমার বাবুকে ওরা মেনে নেবে তো !
যদি না নেয় ভেঙ্গে যাবে ছেলেটা আমার !
ভয়টাই সত্যি হল...
ওরা মানল না।
ছেলের কথা ভেবে সেদিন নিজের সম্মানের কথা ভাবলে না তুমিও
কথা বললে মেয়েটির বাড়ির লোকের সাথে।
নাহ! সেদিন ওরা তোমার আধখানা কথাও শুনল না।
পরিবারের চাপে আস্তে আস্তে মেয়েটিও বেঁকে বসল...
সেদিন ঘরের দরজা বন্ধ করে খুব কাঁদল আমার ছেলেটা ।
বন্ধ দরজাটা আর খুলল না...
ভাঙতে হল।
ভিতরে তখন আমার বাবুর নিথর দেহ।
হ্যা গো ও কেন এমন করল !
আমাদের ভালবাসাটা কি তাহলে ভালবাসা ছিল না !
তুমি একবার যেও তো ওই স্কুলটাতে...
একবার জিজ্ঞেস করো তো ওরা ওদের সহবত শিক্ষার সিলেবাসে
মা বাবাকে উপেক্ষা না করা কে অ্যাড করেছে কিনা !
না জানি কত মায়ের কোল খালি হল...
শুধু এই সহবতের অভাবে।
ভয় হয়...
বড় ভয় হয় ।।