মিলুপা, তোমাকেই বলে যাব সব কথা।
তোমারই তো সব জানবার কথা, বুঝবার কথা!
যেমন আগেও বুঝে যেতে আমার অপ্রকাশ,
মনের যত চাওয়া!
মুখ দেখেই বুঝে যেতে, আমার মন খারাপ কী-না!
চিনে যেতে আমার আকাশে মেঘের রঙ, বিষাদ ছুঁয়ে যাওয়া।


আজও বুঝলে তুমিই বুঝবে- নিরব অশ্রুপাতের ভাষা,
কী কথা বলে যায়; না বলে। কী কথা যায় না বলা।
মনে পড়ে?
চোখ বুজে তর্জণী আংগুল কামড়ে; অংগুলি নির্দেশে দেখাতেম- পূর্বসূরিদের কবরস্থান, একটির পর একটি কবর দেখিয়ে জিজ্ঞেস করতেম তাদের নাম, ধাম।
তুমি বলতে থাকতে হয়বত খাঁ থেকে শুরু করে ঈশা খাঁ, সৈয়দ নাসিরুদ্দিন শাহ্‌ সিপাহসালার আর
পারিবারিক সব ঐতিহ্যের কথা।
মন দিয়ে শুনতে থাকতেম সেসব কাহিনীর বীর গাঁথা।
আমাকে মুগ্ধ করে রাখতো মিলুপা, তোমার আন্তরিকতা।


ভাবতেম, এ বংশ তোমাকে পেয়ে গর্বিত! আর আমিও এ গর্বের অংশীদার। তারপর আরো জানাতে পারিবারিক কিছু সদস্যের অকাল মৃত্যু আর দূর্দশার খবর! আমি ভাবতেম, এই যে এই গোরস্থানের বেড়া ডিংগিয়ে দু'জন দুই বাধাই করা কবরের কার্ণিশে বসে আজ গল্প করছি, একদিন আমরাও লুকিয়ে রবো এমনই কোন বাধাই করা অনাড়ম্বর মৃত্যুহিম ঘরে। উচ্চ বংশ, উঁচু জাত, অর্থ বিত্ত প্রতাপ কিছুই বেশিদিন  থাকে না! মিছেই বড়াই এসব!


নয়ান্দরের পুকুর চেনালে যেদিন, সেদিন গল্প বলেছিলে এক হতভাগিনীর, যার গোসল হতো দুধ পুকুরে। একবার সে রাজকন্যার শখ হলো দুধ- দিঘীতে আয়েশি স্নানের, দীঘল সে দিঘীর চার পাশ থেকে মাটি কেটে সিঁড়ি বানানো হলো দিঘীর মধ্য তল অবধি। রাজকন্যা দিঘীতে নামতেই ছুটে এলো দুধের নহর! আর তার জলপ্রপাতে হারিয়ে গেলো রাজকন্যার মৃত দেহ। শুধু তার দীঘল চুল ভেসে ওঠলো দুধের সরের সাথে মিশে। সেই থেকে দুধের সর দেখলেই মনে পড়ে রাজকন্যার চুল, আর দুধে ভরা ভান্ড দেখলেই দুধের নহর।


মিলুপা, তোমার সেই গল্প বলার স্মৃতি আমাকে এখন একজন গল্পকার বানিয়েছে। তোমার লেখা প্রতি সপ্তাহের পোষ্টকার্ড আর চিঠি সেসময় আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। পরিবারে নিতান্তই অবহেলা অনাদরে বেড়ে ওঠা এই আমাকে যে স্নেহ আদর তুমি দিয়েছিলে, আজো সেই সম্বল নিয়েই এগিয়ে চলেছি। মাঝে মাঝে জীবন পথে হোচট খেলে, ব্যথা পেলে, মানসিক আশ্রয় সেই তোমাকে মনে পড়ে যায়!বিড়বিড় করে ডাকি তখন-                              
" মিলুপা, আমার চুলে একটু বিলি কেটে দেবে?
   মাথাটা খুউব ধরেছে!
   মিলুপা, তোমার লেখা সে'রকম চিঠি কেন আর আসে না?"