কাল একটু জলপাইগুড়ি গিয়েছিলাম। অফিসের কাজে। যাওয়ার পথে গাড়ীতে কিশোরকুমারের বাংলা গান চলছিল। “ এই যে যদি যায় সাগরে” আর “চিতাতেই সব শেষ” । গানটা শুনতে শুনতে কেমন যেন হারিয়ে গেলাম আমার সেই ছোটো বেলায়। বারবার আমার সদ্য প্রয়াত কাকা আর আমার বড় জেঠা যাকে আমি আজন্ম বাপ্পু বলে ডাকতাম তাদের কথা মনে পড়ছিল। চোখের কোন থেকে দুফোঁটা জলও ছলকে এলো। বারবার মনে হচ্ছিল সব যেন কেমন পাল্টে যাচ্ছে অতিদ্রুত। কেমন যেন একটা হয়ে যাচ্ছি জীবনে। বয়স যত বাড়ছে যেমনি বাড়ছে জীবনের একাকীত্ব।
আমার আশৈশব দেখা জমজমাট বাড়িটা আস্তে আস্তে কেমন ভাবে যেন ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। আমাদের বাড়িতে প্রায় ৪০/৪৫ বছরের পুরনো একটা গানের স্কুলে আছে। আমার বড় জেঠা প্রতিষ্ঠিত। প্রতিবছর সেই স্কুলে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। আগে যখন ছোটো ছিলাম এই পরীক্ষা দিনটায় যেন মনে হত একটা অকাল দুর্গাপুজা। কত আবেগ কত আনন্দ করতাম। সাধারণ জিনিস আনার জন্য যদি মা বা বম্মা দোকানে পাঠাতো তাতেই একেবারে খুশিতে ডগমগ করতাম। মনে হতো কত দায়িত্ব । এখনও সেই পরীক্ষা হয়। প্রতিবছরের মত। কিন্তু সেই আবেগ বা আনন্দ আর খুঁজে পাই না।
এখন বাইরে থাকার দরুন প্রায়দিনই মাংস খাওয়া হয়। সে হোটেলই হোক বা বাড়িতে। কিন্তু আগের সেই বহু প্রতীক্ষিত রবিবারের মায়ের হাতের মাংসের স্বাদ এখন যেন মুখে লেগে আছে। এখন শিলিগুড়ি থেকে বাড়িতে গেলেই মা যদিও রান্না করে কিন্তু সেই রান্নার মধ্যে সেই স্বাদ সেই গন্ধ যেন খুঁজে পাইনা।
সন্ধ্যা বেলার চায়ের সাথে চারাচুর বা প্রিয়া বাটারবাইট বিস্কুট প্রায় দিনই খাওয়া হয়। কিন্তু ছোটো বেলায় বড় জেঠার ঘর থেকে চুরি করে খাওয়ার সেই স্বাদ এখনও যেন মুখে লেগে আছে। আহা কি অমৃতই না ছিল।
সকালবেলায় কাকার গায়ে তেল মাখতে মাখতে গুনগুন করে সেই গান – কথা বলে না। কথা বলে না। কেন বলে না। এখন চেষ্টা করেও আর কোনও দিনই শোনা হবে না। বা আমার ঠাকুমা ( চার বছর ধরে রোগ শয্যায় ) যাকে আমি বু বলে ডাকতাম তার হাতের চাটনি, ছোলার ডাল বেঁটে ধোঁকার ডানলাম, শীতকালে বম্মার হাতের পায়েস, পিঠে, কুলের আঁচার এখনও যেন আমায় তারিয়ে বেড়ায়।
হাজার চেষ্টা করেও এই স্মৃতিগুলো আমাকে রেহাই দেয় না। এই ভরা শীতেও আমার শৈশবের বসন্ত খুঁজে বেড়াই। বারবার মনে হয়। সবাই কেন এই ভাবে হারিয়ে যাচ্ছে ? এখন ভাবি অখন আমি স্বর্গে মধ্য স্বপ্ন খুঁজতাম। আর এখন স্বপ্নের মধ্য স্বর্গ খুঁজি।