গীতিকবিতা কি ও কাকে বলে :-


গীত বা গান মনুষের মনেরভাব প্রকাশের এক প্রকার স্বভাবজাত মাধ্যম। মনের ভাব কেবল কথায় ব্যক্ত হইতে পারে, কিন্তু কণ্ঠভঙ্গীতে তাহা স্পষ্টীকৃত হয়। “উঃ ” এই শব্দ কণ্ঠভঙ্গীর গুণে দুঃখবোধক হইতে পারে, বিরক্তিবাচক হইতে পারে, এবং ব্যাঙ্গোক্তিও হইতে পারে। “তোমার বিরহে মরিলাম!” ইহা শুধু বলিলে, দুঃখ বুঝাইতে পারে, কিন্তু উপযুক্ত স্বরভঙ্গীর সহিত বলিলে দুঃখ শতগুণ অধিক বুঝাইবে। এই স্বরবৈচিত্র্যের পরিণামই সঙ্গীত। সুতরাং মনের বেগ প্রকাশের জন্য আগ্রহাতিশয্যপ্রযুক্ত, মনুষ সঙ্গীতপ্রিয় এবং তৎসাধনে স্বভাবগতঃ যত্নশীল।
কিন্তু অর্থযুক্ত বাক্য ভিন্ন চিত্তভাব ব্যক্ত হয় না, অতএব সঙ্গীতের সঙ্গে বাক্যের সংযোগ আবশ্যক। সেই সংযোগোৎপন্ন পদকে গীত বলা যায়। গীতের জন্য বাক্যবিন্যাস করিলে দেখা যায় যে, কোন নিয়মাধীন বাক্যবিন্যাস করিলেই গীতের পরিপাট্য হয়। সেই সকল নিয়মগুলির পরিজ্ঞানেই ছন্দের সৃষ্টি। গীতের পরিপাট্যজন্য আবশ্যক দুইটি—স্বরচাতুর্য্য এবং শব্দচাতুর্য্য। এই দুইটি পৃথক্ পৃথক্ দুইটি ক্ষমতার উপর নির্ভর করে। দুইটি ক্ষমতাই একজনের সচরাচর ঘটে না। যিনি সুকবি, তিনিই সুগায়ক, ইহা অতি বিরল। কাজে কাজেই, একজন গীত রচনা করেন, আর একজন গান করেন। এইরূপে গীত হইতে গীতিকাব্যের পার্থক্য জন্মে। গীত হওয়াই গীতিকাব্যের আদিম উদ্দেশ্য; কিন্তু যখন দেখা গেল যে, গীত না হইলেও কেবল ছন্দোবিশিষ্ট রচনাই আনন্দদায়ক, এবং সম্পূর্ণ চিত্তভাবব্যঞ্জক, তখন গীতোদ্দেশ্য দূরে রহিল; অগেয় গীতিকাব্য রচিত হইতে লাগিল।


অতএব গীতের যে উদ্দেশ্য, সেই কাব্যের সেই উদ্দেশ্য, তাহাই গীতিকাব্য। বক্তার ভাবোচ্ছ্বাসের পরিস্ফুটতামাত্র যাহার উদ্দেশ্য, সেই কাব্যই গীতিকাব্য।


বিদ্যাপতি চণ্ডীদাস প্রভৃতি বৈষ্ণব কবিদিগের রচনা, ভারতচন্দ্রের রসমঞ্জরী, মাইকেল মধুসূদন দত্তের ব্রজাঙ্গনা কাব্য, হেমবাবুর কবিতাবলী, ইহাই বাঙ্গালা ভাষায় উৎকৃষ্ট গীতিকাব্য।


  উপরোক্ত আলোচনায় এ কথা স্পষ্ট যে গীতিকবিতা একধরনের কবিতা , যার সাথে কবিতা ও সঙ্গীতের বৈশিষ্ট্য একই সাথে বিদ্যমান থাকে। সঙ্গীতধর্মিতাই হল গীতিকবিতার প্রধান বৈশিষ্ট্য। গান থেকেই গীতিকবিতার উদ্ভব। ইংরেজি ‘lyrical poetry' শব্দ থেকে বাংলায় গীতি-কবিতাটির সৃষ্টি হয়েছে। অর্থাৎ lyric শব্দের মূলে আছে লায়ার নামক গ্রীক বীণাজাতীয় বাদ্যযন্ত্র, গ্রিস দেশে Lyre বা বীণা সহযোগে গায়ক তার ব্যক্তিগত অনুভবকে যখন গান করে গাইত তাকে বলা হতো ‘Lyric’ কখনো সে গান হতে সংঘবদ্ধ গায়কদের কোরাস; আনন্দ অথবা বেদনার আবেগমণ্ডিত গীতিরূপ। কালক্রমে সুরের আবরণ খসে পড়লে গীতি কবিতা হয়ে আত্মভাবনামূলক মন্ময় বাণীরূপ।এরই নিরিখে সমগ্র বিভিন্ন ইউরোপের আখ্যানকাব্য ও ইলিয়াড ওডিসিকে এই অবিধায় ভূষিত করা হত কারণ এগুলি বাদ্যযন্ত্র সহযোগে গান করা হত।
প্রাচীন গ্রিসের মতো বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগে লেখা আখ্যান কাব্য, খণ্ড কাব্য প্রায় প্রতিটি ধারাকেই গীতি-কবিতা রূপে চিহ্নিত করা হয়। যেমন বৈষ্ণবপদাবলী, শাক্তপদাবলী, অনুবাদমূলক কাব্য, মঙ্গলকাব্য সমস্তই তো সুর করে পাঠ করা হয় এবং  এখনো হয়। আধুনিক গীতি কবিতায় সুর করে গাওয়ার রেওয়াজ না থাকলেও তার আত্মমগ্ন ভাবোচ্ছাসে সংগীতময়তা বর্তমান।” তবে মনে রাখা আবশ্যক, হৃদয়োস্থিত ভাবের প্রকাশ তথা ব্যক্তিগত আবেগের অভিব্যক্তি মাত্রেই গীতি কবিতা নয়। সেই ব্যক্তিক ভাবাবেগ কে এক বিশ্বাসযোগ্য ও অবশ্যম্ভাবী বাচনিকরূপ ধারণ করতে হবে। ভাবগত মন্ময়তাকে অর্জন করতে হবে ভাষাগত তন্ময়তা।


চীনা ভাষায় গীতিকবিতা Shin যার অর্থ শব্দ-সংগীত, বাঙলা গীতিকবিতা নামটির মধ্যেও গীতিকবিতার সেই প্রাথমিক সাংগীতিক কাঠামো বা ভিত্তির ইংগিত সুস্পষ্ট। অবশ্য গীতিকবিতা মাত্রই গান করার জন্য রচিত হয় না। গীতিকবিতার ধ্বনিবিন্যাসে অন্ত্যমিল ও ছন্দের নিয়মিত গতিপ্রবাহে সংগীতের গুণ বা ধর্মকে প্রকাশ করা হয়। গীতিকবিতা বলতে সাধারণত এমন স্বল্পায়তন কবিতাকে বোঝায় যা সংগীতকে বিন্যাসের অনুকরণে কবির নিজস্ব চিন্তা অনুভূতি কল্পনাকে স্তবক বিভাগে ও ছন্দের সুরময়তায় প্রত্যক্ষভাবে প্রকাশ করে। বস্তুত গীতিকবিতা সম্পূর্ণরূপেই কবি-হৃদয়ের প্রতিচ্ছবি।


সুতরাং বলা যায়  গীতিকবিতা বলতে মূলত যা বোঝানো হয় তার সঙ্গে সংগীতের কোনো সম্পর্ক নেই। এ সম্পর্কে সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রই স্পষ্ট বলেছেন: “গীতের পারিপাট্য জন্য আবশ্যক দুইটি—স্বরচাতুর্য ও শব্দচাতুর্য। দুইটি ক্ষমতাই সচরাচর একজনের ঘটে না। যিনি সু কবি, তিনিই সু গায়ক। ইহা অতি বিরল।” এ থেকে প্রমাণিত হয়—একজন গীত রচনা করেন আরেকজন গান করেন। যদিও গীত হওয়াই গীতিকাব্যের আদিম উদ্দেশ্য, তবুও ছন্দোবিশিষ্ট আনন্দদায়ক পদ অনেক সময় চিত্তাকর্ষক হওয়ায় গীতিকাব্য রূপে পরিগণিত হতে থাকল।


অবশ্য গীতিকবিতার আলোচনায় বঙ্কিমচন্দ্রের সর্বশেষ মন্তব্যটি অত্যন্ত মূল্যবানঃ “গীতের যে উদ্দেশ্য যে কাব্যের সেই উদ্দেশ্য তাহাই গীতিকাব্য। বক্তার ভাবোচ্ছ্বাসের পরিস্ফুটতামাত্র যাহার উদ্দেশ্য, সেই কাব্যই গীতিকাব্য।” অর্থাৎ বক্তার ভাবোচ্ছ্বাসের পরিস্ফুটন গীতিকাব্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য, সেদিক থেকে দেখতে গেলে মন্ময় কবিতা মাত্রই গীতি-কবিতা। এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ কবিতার যে দুটি স্থূল বিভাগ দেখিয়েছেন : “কোনো কাব্য বা একলা কবির কথা, কোনো কাব্য বা বৃহৎ সম্প্রদায়ের কথা। মূলত গীতি-কবিতা একলা কবির কথা, কবির নিজের কথা বলে বলেই অনুভূতির তীব্রতা এই কবিতার প্রাণ। তবে কবির ব্যক্তিগত অনুভূতি যে-কোনো বিষয় আশ্রয় করেই গড়ে উঠতে পারে। সুতরাং গীতি-কবিতার বিষয়ের ব্যাপ্তি অত্যন্ত বেশি। তবে মনে রাখা দরকার ব্যক্তিগত উচ্ছ্বাস কেবলই ব্যক্তিগত স্বার্থে সীমিত থাকলে তা কবিতার মর্যাদা লাভ করতে পারে না তার আবেদন সর্বজনীন হতে হবে, সেই কারণেই কোনো ধর্মীয় বিষয় এখানে প্রাধান্য লাভ করতে পারে না।  


গীতিকবিতায় কথা ও সুরের সমন্বয় থাকে। গানে একাধিক ভাব-কল্পনা সম্ভব নয; গীতি কাব্যে ভাব-কল্পনার বিচিত্রতা ও সুর-সঙ্গতি শুধু সম্ভবপর নয়, সুসাধ্যও বটে।  


যে-কবিতায় কবির আত্মনুভূতি বা একান্ত ব্যক্তিগত বাসনা-কামনা ও আনন্দ-বেদনা তার প্রাণের অন্তঃস্থল থেকে আবেগ-কম্পিত সুরে অখণ্ড ভাবমূর্ত্তিতে আত্মপ্রকাশ করে, তাকেই গীতি-কাব্য বা গীতিকবিতা বলে। এতে পরিপূর্ণ মানবজীবনের ইঙ্গিত নাই; এটি একক পুরুষের একান্ত ব্যক্তিগত আনন্দ-বেদনায় পরিপূর্ণ। কবি এখানে আত্ম-বিমুগ্ধ, তাই সমস্তটি কবিতাব্যাপী তার প্রাণ-স্পন্দন অনুভব করা যায়। কবি তার ব্যক্তি-অনুভূতি অথবা বিশিষ্ট মানসিকতা একে স্নিগ্ধ কান্তি দান করে। তার চরিত্রের কমনীয়তা, নমনীয়তা বা দৃঢ়তা এতে প্রতিফলিত হয়। সংক্ষেপে বলা যায়, গীত কবিতা কবির আত্ম-মুকুর বিশেষ। এখান  রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য সুস্পষ্ট তিনি গীতিকবিতা সম্পর্কে বলেছিলেন যে -


'যাহাকে আমরা গীতিকাব্য বলিয়া থাকি অর্থাৎ যাহা একটুখানির মধ্যে একটিমাত্র ভাবের বিকাশ , ঐ যেমন বিদ্যাপতি'র -  


ভরা বাদর মাহ ভাদর  


শূন্য মন্দির মোর, -


সে-ও আমাদের মনের বহুদিনের, অব্যক্ত ভাবের একটি কোনো সুযোগ আশ্রয় করিয়া ফুটিয়া ওঠা'।  


গীতিকবিতার মধ্যে আমরা আন্তরিকতাপূর্ণ অনুভূতি, অবয়বের স্বল্পতা, সঙ্গীত-মাধুর্য্য ও গতিস্বাচ্ছন্দ্য - এই কয়েকটি জিনিস প্রত্যাশা করি। বলাবাহুল্য যে, গীতিকবিতা গান না হলেও আজ পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যে যে গীতি-কবিতা সৃষ্টি হয়েছে, তাতে সুরের প্রাধান্য অব্যাহত রয়েছে।


উইকিপিডিয়া গীতিকবিতাকে সজ্ঞায়িত করেছে নিম্নরূপে -


গীতি কাব্য একজন কবির একান্ত ব্যক্তি-অনুভূতির সহজ, সাবলীল গতি ও ভঙ্গীমায় সঙ্গীত-মুখর জীবনের আত্ম-প্রতিফলন। এটি গীতি কবিতা নামেই সাহিত্যামোদী ব্যক্তিবর্গের কাছে সমধিক পরিচিত। গীতিকবিতার ভিত্তিমূল বলতে গিয়ে উইকিপিডিয়র বক্তব্য হলো -
গীতি কাব্য অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ বলে সাধারণতঃ দীর্ঘকায় হয় না। কারণ কোন অনুভূতিই দীর্ঘকাল স্থায়ী নয়। কিন্তু কোন কবি যদি গীতি কবিতায় তার ব্যক্তি-অনুভূতিকে একান্ত আন্তরিকতার সাথে অনায়াসে দীর্ঘকারে বর্ণনা করতে পারেন, তবে তার মূল রস ক্ষুণ্ন হয় না। কবির আন্তরিকতাই শ্রেষ্ঠ গীতি কবিতা বা গীতি কাব্যের একমাত্র কষ্টি-পাথর।
ইংরেজ কবি উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ  গীতিকবিতা সম্পর্কে বলেছেন, এই রচনা প্রবল আবেগের প্লাবন। তিনি বলেছিলেন -

“Poetry is the spontaneous overflow of powerful feelings, it takes its origin from emotion recollected in tranquility."


হেগেলের মতে, গীতিকবিতা তীব্রভাবেই মন্ময় ও ব্যক্তিগত প্রকাশ। এই সংজ্ঞা ঊনবিংশ বা বিংশ শতাব্দীর গীতিকবিতা সম্পর্কে প্রযোজ্য সন্দেহ নেই। কিন্তু বাংলা সাহিত্যে প্রাচীনকালের ও মধ্যযুগের গীতিকবিতা আধুনিক গীতিকবিতার মত মন্ময় কবির আত্মগত ভাবনা-আবেগ-অনুভূতি প্রধান রচনা নয়, তাদের আবেগ-অনুভূতি অনেকটা পরিমাণেই গোষ্ঠীগত বা সমাজগত-যেমন, বাঙলার মধ্যযুগীয় বৈয়ব গীতিকবিতা। সেইজন্য প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় গীতিকবিতা এবং আধুনিক গীতিকবিতা এই শ্রেণীবিভাগ করতে হয়। সাম্প্রতিক কালের সমালোচকদের আলোচনায় সঙ্গীতধর্মিতাই গীতিকবিতার অন্ত-সার, তার সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যরূপে নির্দেশিত হয়েছে।


বিখ্যাত আমেরিকান সমালোচক ব্ল্যাকমিউর বলেছেন, এই কবিতার রচনায় শব্দগুলি সাঙ্গীতিক ধ্বনির বিন্যাসের মধ্য দিয়ে কবিতার অর্থ তৈরি করে।  


ইংরেজ সমালোচক অ্যাবারকম্বির মতে, একজন কবি ভাষাকে আনন্দদায়ক ও উত্তেজক সঙ্গীতে পরিণত করার জন্য রচনা করেন না, তিনি তাঁর বক্তব্য যাতে আমাদের মনে বিচিত্রভাবে প্রভাব বিস্তার করে, তার জন্যই ভাষায় একটি আনন্দদায়ক ও উত্তেজক সঙ্গীত রচনা করেন।  
ইংরেজ ঔপন্যাসিক জেমস জয়েসের মতে, গীতিকবিতা এমন এক রূপ যাতে শিল্পী নিজের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সম্পর্কে তাঁর প্রতিমূর্তি উপস্থাপিত করেন।


R. J. Rees-এর কথায় গীতিকবিতা—

'the poems in question are reasonably short, and have a definite unity of thought and feeling'


গীতি কবিতা সম্পর্কে  পি. বি. শেলি বলেছেন-

“Poetry is indeed something divine"



বাংলা গীতিকবিতার উদ্ভব ও বিকাশ এবং তার স্রষ্টা সম্পর্কে কবিদের কথা এখানে অপরিহার্যভাবে এসে পড়ে। সাধারণ বিশ্বাস, পাশ্চত্য গীতিকাব্যের প্রভাবেই বাংলা গীতিকবিতার সূচনা হয়। এই মত কত শতাংশে সত্য হলেও, সবটাই তা কিন্তু নয়।  

পাশ্চাত্য গীতিকাব্যের প্রভাবের সঙ্গে দেশীয় সাহিত্যের এই দিকগুলিকে স্বীকার না করলে ইতিহাসকেও অস্বীকার করা হবে। মাইকেল মহাকাব্যের ধারার সূচনা করলেও সেই মহাকাব্যের মধ্যেই কোথাও কোথাও গীতিকবিতার আভাস ছিল। পরে আত্মভাবমূখ্য সনেট –‘আত্মবিলাপ', 'বলগভূমির প্রতি' এবং কবিতার মাধ্যমে তিনি গীতিকাব্যের পূর্ণ প্রবর্তন করেন।


টপ্পা গান থেকে আধুনিক গীতিকবিতার উদ্ভব


অনেক বিজ্ঞ সাহিত্যিকের ধারনা টপ্পা গান থেকে আধুনিক  বাংলা গীতিকবিতার উদ্ভব ঘটে , টপ্পা একধরনের গান , কবিগানের সমসাময়িককালে কলিাতা ও তার শহরতলিতে রাগ রাগিনী সম্বৃদ্ধ একধরণের ওস্তাদি গানের প্রচলন ঘটেছিল , এগুলোই টপ্পা গান হিসেবে পরিচিত । টপ্পা গানের জনক রামনিধি গুপ্ত , তিনি বিহারের ছাপড়ায় গমন করে হিন্দুয়ানী টপ্পা গানের শিক্ষা গ্রহণ করেন ।




বিহারীলাল চক্রবর্তীই বাংলা গীতিকবিতার বিশিষ্ট সুরটিকে প্রথম অনুধাবন করেন। রবীন্দ্রনাথ এই জন্যেই তাকে 'ভোরের পাখি' বলেছেন।



হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, নবীনচন্দ্র সেন, অক্ষয়কুমার বড়াল, দেবেন্দ্রনাথ সেন এঁরা হলেন ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকের কবি। শ্রেষ্ঠ গীতিকবি অবশ্যই রবীন্দ্রনাথ।  

এই যুগের অপর বিশেষত্ব হল, বাঙালি মহিলা কবিদলের গীতিকবিতা রচনা। গিরীন্দ্রমোহিনী দাসী, মানকুমারী বসু, বিনয়কুমার ধর, কামিনী রায় প্রমুখের নাম এবিষয়ে উল্লেখযোগ্য। গার্হস্থ্য জীবনকেই এই মহিলা কবিদল বিশেষভাবে গ্রহণ করেছিলেন।

পুরুষ কবিগণ নিসর্গ জগৎ এবং রোমান্টিক জগৎকে ধীরে ধীরে গ্রহণ করে বিচিত্র বিষয়ের গীতিকবিতা রচনা করতে থাকেন। ফলে বাংলা গীতিকবিতা বিশেষ উন্নত ও সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। গীতিকবিতার সঙ্গে বাঙালির গানও উল্লেখযোগ্য।  

অন্যান্য কবিরাও তখন নানা ভাবের গান লিখেছেন এবং সেগুলিও কাব্যগত দিকটিও ছিল সবিশেষ সমৃদ্ধ। এই কাব্যের দিকটির কথা মনে রেখেই এইসব গানকে বলা হত—'কাব্যগীতি'।  

বিংশ শতাব্দীতে বাংলা গীতিকাব্য অবিস্মরণীয় সাফল্য অর্জন করে। বাংলা নাট্যসাহিত্যকে আশ্রয় করেও গান-গীতিকবিতার বিকাশ ঘটেছে। বাংলা গীতিকবিতার পরিণতির দুটি দিকে : এক, গদ্যকবিতায়; দুই কাব্যনাট্যে। দুটি ক্ষেত্রেই বাঙালি কবিরা উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব দেখিয়েছেন।


গীতিকবিতার ইতিহাস :-


বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রাচীন নিদর্শন চর্যাগীতি। আনুমানিক নবম থেকে দশম শতাব্দীর মধ্যে এই চর্যাগীতিগুলি রচিত হয়। সেন রাজাদের রাজত্বকালে বৌদ্ধ সহজিয়া সাধকগণ রূপক আশ্রিত ভাষায় এই চর্যাগীতিগুলি রচনা করেন। এর কারণ হিসেবে মনে হয় বৌদ্ধ সহজিয়া সাধন-তত্ত্বের কথা গোঁড়া ব্রাহ্মণ্যবাদী সেন রাজাদের বুঝতে না দেওয়া। মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ১৯০৭ সালে নেপালের রাজদরবারের গ্রান্থাগার থেকে চর্যাগীতির পুঁথি আবিষ্কার করেন। পুঁথিটি খণ্ডিত (২৩সংখ্যক পদটির কিছু অংশ এবং ২৪, ২৫, এবং ৪৮ সংখ্যক পদ পাওয়া যায়নি) হওয়ায় সাড়ে ছেচল্লিশটি পদের পাঠোদ্ধার করা সম্ভব হয়। অবশিষ্ট সাড়ে তিনটি পদ প্রবোধচন্দ্র বাগ্‌চী মহাশয় তিব্বতি অনুবাদ থেকে পাঠোদ্ধার করেন। বর্তমানে চর্যাগীতির মোট পদ সংখ্যা পঞ্চাশটি বলা হলেও আরও বহু পদের সন্ধান পাওয়া গেছে।২ চর্যাগীতির পুঁথি ছাড়াও সরোহাচার্যের দোহা, কৃষ্ণাচার্যের দোহা এবং ডাকাণর্ব নামক আরও তিনটি পুঁথি একত্রে ১৯১৬ সালে (১৩২৩বঙ্গাব্দে) বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ থেকে ‘হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধ গান ও দোহা’ নামে প্রকাশিত হয়। চব্বিশজন কবি এই পঞ্চাশটি পদ রচনা করেন। চর্যাগীতির সংস্কৃতে টীকা রচনা করেছেন মুনি দত্ত। এই পঞ্চাশজন কবির মধ্যে আদি কবি হলেন লুই পাদ বা লুই পা। বৌদ্ধ সহজিয়া সাধকদের উপাধি হল পা বা পাদ। চর্যাগীতির আদি কবি হলেন লুই পাদ বা লুই পা। লুই ১ ও ২৯ সংখ্যক চর্যার রচয়িতা। তাঁকে দশম শতাব্দীর কবি বলেছেন সুকুমার সেন। সুকুমারবাবুর অভিমত -‘… লুইয়ের জীবৎকাল দশম শতাব্দী বলিলে ভুল হইবার সম্ভাবনা কম হয়।’৩ তিব্বতি অনুবাদ থেকে লুইয়ের তিনখানি গ্রন্থের নাম পাওয়া যায়, যথা ‘শ্রীভগবদভিসময়’,‘অভিসময়বিভঙ্গ’ও ‘তত্ত্বস্বভাবদোহা-কোষগীতিকাদৃষ্টি নাম’। ড.সেনের মতে লুই কথাটি এসেছে ‘রোহিত’ থেকে (ঐ, পৃ ২১)।    


মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য মূলত দুটি ধারায় অগ্রসর হয়েছে – একটি হল আখ্যান কাব্যের ধারা অন্যটি হল গীতিকাব্যের ধারা। আখ্যান কাব্যের মধ্যে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, মঙ্গলকাব্য, চৈতন্যচরিতসাহিত্য, অনুবাদসাহিত্য ও ময়মনসিংহ গীতিকা উল্লেখযোগ্য। আর গীতিকাব্যের মধ্যে বৈষ্ণব পদাবলি, শাক্ত পদাবলি অন্যতম। কাব্যোৎকর্ষের বিচারে বৈষ্ণব পদাবলিতে মধুর রস আর শাক্ত পদাবলিতে বাৎসল্য রসের শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশিত হয়েছে।  


  আদিমধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের প্রথম নিদর্শন বড়ুচণ্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্ত্তন’ কাব্য। ১৯০৯ সালে বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বদ্বল্লভ মহাশয় বাঁকুড়া জেলার বনবিষ্ণুপুরের কাঁকিল্যা গ্রামের দেবেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের গোয়াল ঘরের মাচা থেকে ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্ত্তন’ কাব্যের পুঁথি আবিষ্কার করেন। ১৯১৬সালে (বাংলা ১৩২৩সালে) বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ থেকে ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্ত্তন’ নামে প্রকাশিত হয়। ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ প্রমুখ ভাষাতাত্ত্বিকগণের মতে ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্ত্তন’ কাব্যের পুঁথির ভাষা আনুমানিক চতুর্দশ-পঞ্চদশ শতাব্দীর মধ্যে লেখা।


  বাংলা সাহিত্যে একাধিক চণ্ডীদাসের কথা জানতে পারা যায়। প্রাক্‌চৈতন্য যুগে ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্ত্তন’ কাব্যের কবি বড়ুচণ্ডীদাস এবং পদাবলি সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি চণ্ডীদাস ছাড়াও চৈতন্যোত্তরকালে দীনচণ্ডীদাস নামক


উনিশ শতকে এদেশে যে নবজাগরণের সূত্রপাত হয়েছিল তা সাহিত্যের ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন আনয়ন করে। কাব্যের ক্ষেত্রে এই পরিবর্তন কাহিনিকাব্য ও গীতিকবিতার বিকাশে সহায়ক হয়েছিল। দুটি ধারা পাশাপাশি চললেও গীতিকবিতার ধারাটি অস্তিত্ব রক্ষা করেছে। কাহিনিকাব্য রচনার প্রবণতা বিলুপ্ত হয়েছে।  


আধুনিক বিশ্বের চাঞ্চল্যে প্রভাবিত কবিরা গীতিকবিতার মধ্যেই প্রতিভা বিকাশের স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করেছেন। আধুনিক কালে গীতিকবিতা উপজীব্য বিষয়ের বৈচিত্র্যে বর্ণাঢ্য হয়ে উঠেছে। আধুনিক মানুষের জীবনের নানা রকম দিক, মনো জগতের নানা রকম ভাবনা অবলম্বনে গীতিকবিতা তৈরি হয় বলে এতে অন্তহীন বৈচিত্র্যের সৃষ্টি হয়েছে। আর এই বিষয় বৈচিত্র্যের হাত ধরেই বৈচিত্র্য এসেছে আঙ্গিকে, ভাষা ব্যবহারে ক্ষেত্রে, রূপ-ছন্দে ইত্যাদি নানা ক্ষেত্রে।

গীতিকাব্য ধারা বাংলা সাহিত্যের এ ধারার প্রথম প্রকাশ ঘটে মধ্যযুগের বৈষ্ণবকবিতায়। বৈষ্ণব পদাবলি সাহিত্য-সম্ভারকে আমারা সময়গত দিক থেকে তিনটি পর্বে বিভক্ত করতে পারি।  


                        ১. প্রাক্‌চৈতন্য যুগ – আগে কবি, পরে ভক্ত। কবিরা হলেন জয়দেব (সংস্কৃত),       বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস প্রমুখ।


                       ২.  চৈতন্য যুগ – মুরারি গুপ্ত, নরহরি সরকার, বাসু ঘোষ, নন্দ ঘোষ, যাদবেন্দ্র প্রমুখ।  


                       ৩.  চৈতন্য পরবর্তী যুগ – আগে ভক্ত পরে কবি। কবিরা হলেন জ্ঞানদাস, গোবিন্দদাস, বলরাম দাস, গোবিন্দ চক্রবর্তী, রায় শেখর, জগদানন্দ, লোচনদাস প্রমুখ।


অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে শাক্তগীতিকবিতার উদ্ভব হয়। এর উদ্ভবের পিছনে সমকালীন বাংলা দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক পরিবেশের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।সাধন-সংগীতই শাক্তপদাবলি নামে পরিচিত। শাক্তপদালির দুটি শাখা – এক উমা সংগীত, দুই শ্যামাসংগীত। অষ্টাদশ শতাব্দীর সামাজিক অব্যবস্থা, দুঃখ-দারিদ্র্য, অন্নাভাবের ঘটনা শাক্তপদাবলির আগমনী, বিজয়া ও ভক্তের আকূতি পর্যায়ের মধ্যে চিত্রিত হয়েছে।যাঁর হাত ধরে শাক্তপদাবলির উদ্ভব ও বিকাশ লাভ করেছে তিনি হলেন সাধক কবি রামপ্রসাদ সেন (১৭২০-১৭৮১)।কমলাকান্ত ভট্টাচার্য : (ইং১৭৬৮- ১৮২৪)।


লালন ফকির (জন্ম ১৭.১০.১৭৭৪, মৃত্যু ১৭.১০.১৮৯০)-এর ব্যক্তি জীবন বিষয়ে খুব বেশি জানা যায় না। ভাঁড়ারা, কুষ্টিয়া, বাংলাদেশে জন্ম। ১১৬ বছর বেঁচে ছিলেন। ধর্ম বিষয়ে উদার সাধক। জন্মগতভাবে তিনি হিন্দু না মুসলিম তা নিয়ে সংশয় আছে। তিনি এবং তাঁর সমসাময়িক শিল্পী গগন হরকরা শিলাইদহে ঠাকুর পরিবারের প্রজা এবং ডাকহরকরা ছিলেন। গগনের বিখ্যাত গান‘আমি কোথায় পাব তারে, আমার মনের মানুষ যেরে’। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ এঁদের গানের দ্বারা আকৃষ্ট হয়েছিলেন। লালন সহজ সরল কবিত্বময় গানের মধ্যে দিয়ে জীবনের আদর্শ, মানবতাবাদ ও অসাম্প্রদায়িক মনোভাব ব্যক্ত করেছেন-


‘সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে,


লালন ভাবে জেতের কি রূপ দেখলেম না এ নজরে।


পরবর্তীকালে এর নবরূপ প্রকাশ পায় প্রধানত কবিগান ও যাত্রার মাধ্য দিয়ে। কবিগান, যাত্রা, লোকগাথা, পাঁচালি, আখড়াই, টপ্পা প্রভৃতি ছিল মধ্যযুগ ও উনিশ শতকের সন্ধিক্ষণের বাংলা কাব্যের অমূল্য সম্পদ। বিশেষত ভাগীরথী অঞ্চলে এসব কবিতার অসামান্য প্রভাব ছিল এবং কলকাতার ধনিক-বণিকরা ছিলেন এসবের প্রধান সমঝদার। এ সময়ের শ্রেষ্ঠ কবি নিধিরাম গুপ্তের (নিধুবাবু) প্রণয়-কবিতার সঙ্গে আধুনিক গীতিকাব্যের একটা আন্তর সাদৃশ্য রয়েছে। তাছাড়া যাত্রা, পাঁচালি ও কবিগানের সঙ্গেও পরবর্তীকালের গীতিকাব্যের একটা সম্বন্ধ রয়েছে। এসব গান কেবল লোকমনোরঞ্জনের জন্যই রচিত ও পরিবেশিত হতো, তাই সাহিত্য হিসেবে এগুলি উঁচু মানের নয়। তবে এগুলিকে অনেকটা মার্জিত করেন গোঁজলা গুঁই ও অন্যরা। এক সময় তরজা-পাঁচালি-প্রিয় শহরবাসীদের মধ্যে কবিগানের সমাদর বাড়ে। আর এ পর্বের উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিরা হলেন ভোলা ময়রা, এন্টনি ফিরিঙ্গি, ঠাকুর সিংহ প্রমুখ।


আধুনিক গীতিকবিতা এ ধারার জনক বিহারীলাল চক্রবর্তী (১৮৩৫-১৮৯৪) সারদামঙ্গল (১৮৭৯) কাব্যের জন্য বিখ্যাত। তাঁর বঙ্গসুন্দরী (১৮৭০) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য এজন্য যে, এ্রতেই প্রথম রোম্যান্টিকতার বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। বিহারীলালের কাব্যের ভাষা সহজ ও স্বতঃস্ফূর্ত, কিন্তু ভাবের প্রগাঢ়তা এতে ক্ষুণ্ণ হয়নি। রবীন্দ্রনাথ তাঁর রচনাদ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হন। এ সময়ের অন্যান্য কবির মধ্যে সুরেন্দ্রনাথ মজুমদার (১৮৩৮-১৮৭৮) মহিলা কাব্য লিখে যশস্বী হন। দীনেশচরণ বসু প্রাঞ্জল ও সুমিষ্ট গীতিকবিতার জন্য খ্যাত। যোগীন্দ্রনাথ বসু স্বদেশপ্রীতিমূলক কাব্য রচনা করেন। দেবেন্দ্রনাথ সেনের কবিতায় ছিল ভাবুকতার উচ্ছ্বাস; তাঁর ভাষা সরল ও সুললিত এবং রচনার একটা প্রধান অংশ ফুল সম্পর্কীয়। অক্ষয়কুমার বড়ালের (১৮৬০-১৯১৯) কাব্য স্বকীয় বৈশিষ্ট্যমন্ডিত। তাঁর বিখ্যাত কাব্য এষা। রজনীকান্ত সেন (১৮৬৫-১৯১০) ছিলেন সরল ও সরস গীতিকবিতা এবং ব্যঙ্গকবিতা রচনায় সিদ্ধহস্ত। গোবিন্দদাস (১৮৫৪-১৯১৮) এ যুগের একজন প্রসিদ্ধ স্বভাবকবি। গিরীন্দ্রমোহিনী দাস (১৮৫৭-১৯২৪) ভাবগূঢ় গীতিকবিতা রচনা করেন। কামিনী রায় (১৮৬৪-১৯৩৩) ছিলেন উনিশ শতকের শ্রেষ্ঠ মহিলা কবি; তাঁর কবিতায় আন্তরিকতা ও বিষাদের সুর ধ্বনিত। মধুসূদনের ভ্রাতুষ্পুত্রী মানকুমারী বসুর কবিতায় ভগবদ্ভক্তি ও করুণরস পরিস্ফুট। এছাড়া এ যুগে আরও বহু কবি কাব্য-সাধনায় খ্যাতি অর্জন করেন, যেমন: আনন্দচন্দ্র মিত্র, গোবিন্দচন্দ্র রায়, বরদাচরণ মিত্র, নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায় (১৮৬৩-১৯১৩) প্রমুখ।


এ যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি ছিলেন কায়কোবাদ। হেমচন্দ্র-নবীনচন্দ্রের কাব্যধারায় মহাশ্মশান মহাকাব্য রচনা করে তিনি বিখ্যাত হন। মুসলমানদের তৎকালীন দুরবস্থা কবিকে বেদনার্ত করেছে, তাই তিনি তাদের সমৃদ্ধ অতীত অবলম্বনে কাব্য রচনা করেন। মহাশ্মশান পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধের ঘটনা নিয়ে রচিত ৮৭০ পৃষ্ঠার বিপুলায়তন কাব্যগ্রন্থ। এখানে কবি ভারতের হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়ের একটি চরম সংকটপূর্ণ অবস্থা আবেগপূর্ণ ভাষায় বর্ণনা করেন। গীতিকাব্য রচনায়ও কায়কোবাদের কৃতিত্ব রয়েছে; অশ্রুমালা তাঁর একটি বিখ্যাত গীতিকাব্য।


আধুনিক নাট্যসাহিত্য বাংলায় আধুনিক নাট্যসাহিত্য সৃষ্টি হয় পাশ্চাত্যের প্রভাবে। প্রথমে কেবল ধনিকসমাজের চিত্তবিনোদনের জন্যই নাটক রচিত ও অভিনীত হতো। তখন রামনারায়ণ তর্করত্নের (১৮২২-১৮৮৬) কুলীন-কুলসবর্বস্ব জাতীয় কৌতুকনাট্য বাংলার রঙ্গমঞ্চকে মুখরিত করত। পরে আবির্ভাব ঘটে আধুনিক নাট্যকার মধুসূদন দত্তের। বাংলা কাব্যে আধুনিকতার দ্বারোদ্ঘাটনের মতো বাংলা নাটকেও তিনি আধুনিকতাকে প্রতিষ্ঠিত করেন। বেলগাছিয়া থিয়েটারে মঞ্চস্থ রত্নাবলী নাটকে নাট্যগুণগত দুর্বলতা ও বাংলা ভাষায় নাটকের অভাব অনুভব করে তিনি নাটক লিখতে শুরু করেন। মহাভারতের শর্মিষ্ঠা-দেবযানী-যযাতির কাহিনী অবলম্বনে তিনি প্রথম রচনা করেন শর্মিষ্ঠা (১৮৫৯) নাটক। তাঁর দ্বিতীয় নাটক পদ্মাবতী রচিত হয় এর অব্যবহিত পরেই (১৮৬০)। এতে গ্রীক পুরাণের কাহিনীকে তিনি দেশীয় ধারায় রূপদান করেন। পদ্মাবতী নাটক নানা কারণে উল্লেখলযোগ্য; শর্মিষ্ঠার তুলনায় এটি নাট্যগুণে অনেক সমৃদ্ধ এবং অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রথম প্রয়োগও হয় এ নাটকে।


মধুসূদনের একেই কি বলে সভ্যতা এবং বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ (১৮৬০) সমকালীন বাংলা সাহিত্যের দুখানি শ্রেষ্ঠ প্রহসন। এ দুটির অনন্যতা শুধু রচনাভঙ্গির জন্যই নয়, সমাজচেতনার বিশিষ্টতা ও ব্যাপকতার জন্যও। সংলাপ রচনায় চলিত ভাষাও গ্রাম্য ভাষার সার্থক ব্যবহার এবং ইংরেজি-ফারসিমিশ্রিত সংলাপে তিনি চরিত্রগুলিকে চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন। তবে মধুসূদনের শ্রেষ্ঠ নাটক কৃষ্ণকুমারী (১৮৬১) বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম সার্থক ট্র্যাজেডি। প্রাচ্য নাট্যরীতি অগ্রাহ্য করে পাশ্চাত্য অলঙ্কারের নির্দেশ অনুযায়ী কবি কৃষ্ণকুমারীকে বিয়োগান্ত করেন। এ নাটকে স্বাদেশিকতার সুর বেজেছে। নাটকের ঘটনাসংস্থান, চরিত্রচিত্রণ ও সংলাপ রচনায় নাট্যকারের নৈপুণ্য প্রকাশ পেয়েছে।


মধুসূদনের অব্যবহিত পরেই নাট্যক্ষেত্রে অবতীর্ণ হন দীনবন্ধু মিত্র। প্রধানত এই দুজনের সাধনার ফলেই বাংলা নাটক প্রাথমিক পর্বের বিভিন্ন রকম দুর্বলতা ও অসঙ্গতি কাটিয়ে ওঠে। তাই বাংলা নাট্যসাহিত্যের ইতিহাসে মধুসূদন ও দীনবন্ধু অনন্য। দীনবন্ধুর শ্রেষ্ঠ নাটক নীলদর্পণ (১৮৬০)। এর ঐতিহাসিক মূল্য অপরিসীম। ইংরেজ নীলকররা অতিরিক্ত মুনাফার লোভে কীভাবে বাংলার কৃষকদের ওপর অত্যাচার চালিয়েছিল, তার মর্মন্তুদ চিত্র অঙ্কিত হয়েছে এই নাটকে। সেকালের সমাজজীবনে এই নাটকটি গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল। নীলচাষ বন্ধে নীলদর্পণের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। সমাজসচেতনতা দীনবন্ধু মিত্রের নাটকের বিশিষ্টতা।


অন্যান্য নাট্যকার মধুসূদন-দীনবন্ধুর পরে বাংলা নাটকে যাঁরা বিশেষ অবদান রাখেন তাঁরা হলেন মনোমোহন বসু (১৮৩১-১৯১২), গিরিশচন্দ্র ঘোষ (১৮৪৪-১৯১২), রাজকৃষ্ণ রায় (১৮৪৯-১৮৯৪), জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৪৯-১৯২৫), দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, গোলাম হোসেন প্রমুখ। মনোমোহন বসুর খ্যাতি অপেরা বা গীতাভিনয় রচনায়। তিনি পৌরাণিক উপাখ্যান অবলম্বনে সঙ্গীতপ্রধান দৃশ্যকাব্য রচনা করেন। এছাড়া তিনি কয়েকটি সামাজিক নাটকও লিখেছেন। রাজকৃষ্ণ রায় ছত্রিশটির মতো ছোট-বড় নাটক রচনা করেন; কিন্তু তাঁর প্রধান কৃতিত্ব মনোমোহন বসুর নাট্যধারাকে পরবর্তী নাট্যকার গিরিশচন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত করা। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী জ্যোতিরিন্দ্রনাথ বাংলা নাট্যসাহিত্যে বিশেষ অবদান রাখেন। তাঁর প্রধান চেষ্টা ছিল ফরাসি ও সংস্কৃত-মারাঠি ভাষার নাটক বাংলায় অনুবাদ করে বাংলা নাটককে সমৃদ্ধ করা। তাই তিনি কোনো বিশিষ্ট ধারা সৃষ্টি করতে না পারলেও তাঁর অনুবাদমূলক নাটকগুলি উল্লেখযোগ্য। তাঁর ইতিহাসাশ্রিত নাটকগুলিও উল্লেখ করার মতো।


প্রথম মুসলমান নাট্যকার গোলাম হোসেনের নাটক হাড়জ্বালানী মুদ্রিত হয় ১৮৬৪ সালে। এটি পূর্ণাঙ্গ নাটক নয়, নাট্যরীতিতে সংলাপের মাধ্যমে অঙ্কিত কয়েকটি সমাজচিত্র। মুসলমান রচিত গদ্য পুস্তকের প্রথম নিদর্শন হিসেবেই প্রধানত এর মূল্যায়ন করা হয়। প্রায় একই সময়ে রচিত আজিমদ্দীর কড়ির মাথায় বুড়োর বিয়ে একটি প্রহসন (২য় সংস্করণ ১৮৬৮)। গদ্যপদ্য মিশ্রিত ভাষায় রচিত প্রহসনটির তেমন কোনো বিশেষত্ব নেই। বাংলার খ্যাতিমান এবং প্রতিষ্ঠিত গদ্যশিল্পী মীর মশাররফ হোসেন একাধিক নাটক রচনা করেন। তাঁর প্রথম নাটক বসন্তকুমারী (১৮৭৩) সংস্কৃত নাটকের আঙ্গিকে রচিত। এ নাটকের সংলাপে কথ্য ভঙ্গির প্রয়োগ চরিত্রগুলিকে বাস্তবানুগ করেছে। তাঁর দ্বিতীয় নাটক জমিদারদর্পণে (১৮৭৩) সে সময়ের জমিদারদের অত্যাচারের কাহিনী চিত্রিত হয়েছে।


এ সময়ে বঙ্গদেশে যে নাট্যান্দোলন ঘটে, নানা কারণে তার শীর্ষে স্থান দেওয়া হয় গিরিশচন্দ্র ঘোষকে। তিনি ছিলেন তখনকার সর্বাপেক্ষা খ্যাতিমান নাট্যব্যক্তিত্ব। অসাধারণ অভিনয় ও নাট্য-পরিচালনার মাধ্যমে তিনি বাংলা নাটকে একটা ঐতিহ্য সৃষ্টি করেন। একের পর এক নাটক পরিবেশনের মাধ্যমে তিনি রঙ্গমঞ্চে প্রাণ সঞ্চার করেন। তিনি এ সত্য আবিষ্কার করেন যে, নাটক শুধু পাঠের জন্য নয়, বরং মঞ্চে অভিনীত হলেই তার সত্য প্রকাশিত হয়। গিরিশ ঘোষ সামাজিক, ঐতিহাসিক এবং পৌরাণিক বিষয় নিয়ে অনেক নাটক রচনা করেন। রঙ্গমঞ্চের প্রয়োজনেই তিনি বাংলা উপন্যাস ও আখ্যানকাব্যের নাট্যরূপ দিতে শুরু করেন। তিনি অনেক মৌলিক নাটকও রচনা করেন।


আধুনিক বাংলা নাটক যাত্রার ঢঙ পরিহার করেছিল, কিন্তু মনোমোহন বসু ও রাজকৃষ্ণ রায়ের চেষ্টায় তা আবার নাটকে স্থান লাভ করে এবং গিরিশচন্দ্র ঘোষ তা নিজের নাটকে গুরুত্বের সঙ্গে ব্যবহার করেন। তিনি প্রাচীন যাত্রারীতির সঙ্গে ইউরোপীয় নাটকের বহিরঙ্গের সমন্বয় ঘটাতে চেয়েছিলেন। তাঁর সে প্রচেষ্টা সফল না হলেও বাংলা নাটকে এক নতুনত্বের সৃষ্টি করে, যা তখনকার দর্শকচিত্ত আকর্ষণে সমর্থ হয়। গিরিশচন্দ্র পৌরাণিক নাটকের জন্যই সবচেয়ে বেশি খ্যাতি অর্জন করেন। তাঁর নাটকের সংখ্যাও সবচেয়ে বেশি এবং সমকালে ও পরবর্তী জনমানসে প্রভাব বিস্তারের দিক থেকে সেগুলি গুরুত্বপূর্ণ। গিরিশ ঘোষের সামাজিক নাটকে সমকালীন কলকাতার মধ্যবিত্ত জীবনের ছবি অঙ্কিত হয়েছে।


বাংলায় যথার্থ ঐতিহাসিক নাটক রচনার ধারা প্রবর্তন করেন দ্বিজেন্দ্রলাল রায়। তিনি সামাজিক ও পরিহাসমূলক নাটক রচনায়ও দক্ষতা দেখিয়েছেন। এর মূলে ছিল তাঁর ইউরোপ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা এবং ইউরোপীয় নাট্যসাহিত্যের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয়। দ্বিজেন্দ্রলাল পৌরাণিক নাটকে আধুনিক মনোভাব নিয়ে আসতে চেয়েছিলেন। দ্বিজেন্দ্রলালের শ্রেষ্ঠ কীর্তি তাঁর ঐতিহাসিক নাটকগুলি। এগুলিতে ইতিহাসের সত্যতা প্রায়ই রক্ষিত হয়েছে। তাঁর মেবার পতন নাটকে জাতীয়তাবাদের ওপরে মানবমৈত্রীর আদর্শ স্থাপিত হয়েছে; আবার মুগল-জীবনের চিত্র অঙ্কিত হয়েছে তাঁর নূরজাহান (১৯০৮) এবং সাজাহান (১৯০৯) নাটকে। দ্বিজেন্দ্রলালের শ্রেষ্ঠ নাটক সাজাহান। এতে সাজাহান চরিত্রে পিতৃত্ব ও সম্রাটত্বের মধ্যে যে তীব্র অন্তর্দ্বন্দ্বের চিত্র তিনি এঁকেছেন তা বাংলা সাহিত্যে দুর্লভ। মঞ্চসাফল্যের দিক থেকেও সাজাহান বাংলা নাট্যমঞ্চের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত অপ্রতিদ্বন্দ্বী।


এ সময়ের আরও একজন উল্লেখযোগ্য নাট্যকার হলেন ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ (১৮৬৩-১৯২৭)। তিনি প্রায় অর্ধশত নাটক রচনা করে সমকালীন রঙ্গমঞ্চের চাহিদা মেটান। উন্নত নাট্যকলার অভাব সত্ত্বেও তাঁর নাটক যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন করে। তাঁর নাটকের বিষয়বস্ত্ত ঐতিহাসিক, প্রণয়মূলক ও পৌরাণিক। আরবি-পারসিক লঘুরস ও রোমাঞ্চকর উপাখ্যান অবলম্বনে তিনি যেসব নাটক রচনা করেন, সেসব আনন্দ উপভোগের অকৃত্রিমতায় উত্তরকালেও ছিল প্রীতিপদ। যেমন, তাঁর অন্যতম বিখ্যাত রচনা আলিবাবা (১৮৯৭) সর্বসময়ের জন্য সমাদৃত বিনোদনমূলক একটি গীতিনাট্য। ক্ষীরোদপ্রসাদের কয়েকটি ঐতিহাসিক নাটক মঞ্চে যথেষ্ট সাফল্য লাভ করেছে।


১৮৬০-৭০ দশকে ইংরেজ রাজশক্তি ফরায়েজী, ওহাবী প্রভৃতি ধর্মীয় ও রাজনৈতিক আন্দোলন কঠোরভাবে দমন করলে পরবর্তী ২০-২৫ বছর বঙ্গদেশে অনুরূপ আন্দোলন আর দেখা যায় নি। এক সময় খ্রিস্টধর্ম মুসলমানদের ধর্ম ও সংস্কৃতির ওপর আঘাত হানে। শতাব্দী শেষে এর প্রতিকারে অবতীর্ণ হন মুনশি মেহেরুল্ললাহ (১৮৬১-১৯০৭) এবং তাঁর শিষ্য মুনশি মোহাম্মদ জমিরউদ্দীন (১৮৭০-১৯৩০)। আর এঁদেরই আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে সে যুগের মুসলমান বাঙালিকে সাহিত্যিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে স্বজাতি-অভিমুখী করে তোলে একটি বিশেষ দল ‘সুধাকর’, যার প্রধান ছিলেন মৌলবি মেয়রাজউদ্দীন আহম্মদ, পন্ডিত রেয়াজুদ্দীন আহমদ মাশহাদী, মুনশি শেখ আবদুর রহিম (১৮৫৯-১৯৩১) এবং মুনশি মোহাম্মদ রেয়াজুদ্দীন আহমদ। এঁরা ইসলামি ঐতিহ্য এবং জাতীয় ইতিহাস সম্বন্ধে মুসলমানদের সচেতন করে তোলার জন্য মাতৃভাষা বাংলায় সাহিত্য সৃষ্টি করেন এবং সংবাদপত্রাদির মাধ্যমে ধর্ম ও কৃষ্টিমূলক বিষয়বস্ত্তর প্রচার-প্রসারের জন্য কিছু বইয়ের অনুবাদ প্রকাশ করে সাহিত্যক্ষেত্রে এক পৃথক ধারার সূত্রপাত করেন। তাঁদের প্রথম প্রকাশনা হচ্ছে এসলাম তত্ত্ব। পরে শেখ আবদুর রহিম ও মুনশি মোহাম্মদ রেয়াজুদ্দীন আহমদ সুধাকর নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করেন (১৮৮৯)। যদিও সুধাকর-দলের আগেও বাংলা সাহিত্য সৃষ্টির পথে মুসলমান বাঙালিদের কেউ কেউ অগ্রসর হয়েছিলেন, কিন্তু বাংলায় মুসলমানদের জাতীয় সাহিত্য সৃষ্টির প্রচেষ্টা এঁদের আগে আর কেউ করেননি; স্বজাতীয়তাবোধও এমনভাবে বাংলা সাহিত্যে ফুটে ওঠেনি। এক কথায় সুধাকর-দলই মুসলমানদের জাতীয় সাহিত্যের ভিত্তি রচনা করে। এঁদের রচিত সাহিত্যের মূল্য যেমনই হোক, পরিপ্রেক্ষিত বিচারে বাংলা সাহিত্যে তার গুরুত্ব অপরিসীম।


মুনশি মোহাম্মদ মেহেরুল্ললাহর সুপ্ত প্রতিভার জাগরণ ঘটে খ্রিস্টান ধর্মের সঙ্গে প্রবল সংঘর্ষের ফলে। তাঁর নয়টি গ্রন্থের মধ্যে সাহিত্যিক বিচারে মেহেরুল এসলাম উল্লেখ্য এ কারণে যে, পুথির আদর্শে লিখিত এর গোড়াতে রসুলে করিম (স.)-এর নাত (স্ত্ততি) আছে, যা পরবর্তী বহুকাল যাবৎ দরুদশরিফের মতো আবৃত্ত হতো। এর ভাষা অত্যন্ত সহজ ও লালিত্যময়। মুনশি মোহাম্মদ জমিরউদ্দীন প্রথমে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হয়ে পাদ্রি জন জমিরউদ্দীন নামে পরিচিত হন। পরে ধর্মবিষয়ক বাদানুবাদে পরাজিত হয়ে তিনি পুনরায় মেহেরুল্ললাহর নিকট ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং মুনশি জমিরউদ্দীন নাম নিয়ে ইসলাম প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন। মূলত ইসলাম প্রচার ও তার সেবাতেই তাঁর লেখনী সক্রিয় ছিল এবং এতেই তিনি খ্যাতি অর্জন করেন। শেখ আবদুর রহিম বাংলা ভাষার মাধ্যমে যেভাবে বাঙালি মুসলমানদের ঐতিহ্য সন্ধান এবং মানব সভ্যতায় ইসলামের অবদান তুলে ধরার চেষ্টা করেন, তেমনিভাবে আর কেউ করেননি। তাঁর প্রথম গ্রন্থ হজরত মহাম্মদের জীবনচরিত ও ধর্মনীতি (১৮৮৭) তাঁর শ্রেষ্ঠ কীর্তি। তিনি সুধাকর, মিহির, হাফেজ, মোসলেম প্রতিভা, মোসলেম হিতৈষী প্রভৃতি পত্রিকা সম্পাদনার সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। মোহাম্মদী পত্রিকায় তিনি যেসব প্রবন্ধ লেখেন তা থেকে সেকালের মুসলিম বাংলা সাহিত্য ও সাহিত্যিকদের সম্পর্কে একটা স্বচ্ছ ধারণা পাওয়া যায়। মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী ছিলেন একাধারে রাজনৈতিক কর্মী, সমাজসেবক, সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও সুবক্তা। তিনি প্রধানত ইতিহাসমূলক রচনার জন্যই খ্যাতি লাভ করেন। ভারতে মুসলমান সভ্যতা তাঁর শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকীর্তি। তিনি মিহির ও সুধাকরে লিখে সাহিত্যিক খ্যাতি অর্জন করেন এবং পরে সোলতান ও আমীর পত্রিকা সম্পাদনা ও প্রকাশ করেন। মুসলিম জাতির হূতগৌরব ফিরে পাওয়ার চিন্তাই ছিল তাঁর সাহিত্যসাধনার মূল প্রেরণা।


আরো কয়েকজন বিশিষ্ট মুসলমান লেখক হচ্ছেন: দীন মোহাম্মদ গঙ্গোপাধ্যায় (১৮৫৩-১৯১৬), মুনশি আবদুল লতিফ (১৮৭০-১৯৩৬), শেখ আব্দুল জববার (১৮৮১-১৯১৮), এয়াকুব আলী চৌধুরী (১৮৮৮-১৯৪০), কাজী আকরম হোসেন (১৮৯৬-১৯৬৩) প্রমুখ। বিভাগপূর্ব বাংলার একজন কংগ্রেসভক্ত জাতীয়তাবাদী নেতা হয়েও ইসলাম ও মুসলমানদের সেবায় সাহিত্যচর্চা করে আবদুল লতিফ খ্যাতি অর্জন করেন। ইসলামের ইতিহাস (১৯২৪) গ্রন্থটি রচনা করে সুবিখ্যাত হলেও কাজী আকরম হোসেন সাহিত্যের অন্যান্য ক্ষেত্রেও যথেষ্ট অবদান রাখেন। এয়াকুব আলী চৌধুরীর মতো পন্ডিত সাহিত্যিক ওই সময়ে বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে কমই ছিল। তাঁর দার্শনিক চিন্তাশীলতার প্রকৃষ্ট উদাহরণ মানব মুকুট। এ গ্রন্থে নবী মুহাম্মাদ (সঃ)-এর জীবনী ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তাঁর ভাষা হয়ে উঠেছে অপূর্ব ধ্বনিব্যঞ্জনাময়।


রবীন্দ্রপর্ব বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। রবীন্দ্রনাথ বাংলা সাহিত্যের সকল ক্ষেত্রেই অনন্যসাধারণ অবদান রেখেছেন। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে তিনিই বিশ্বসাহিত্যের মর্যাদায় ভূষিত করেন। তাঁর পরিচয় যদিও ‘বিশ্বকবি’ হিসেবেই, তথাপি এ কথা অনস্বীকার্য যে, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে আজ পর্যন্ত শ্রেষ্ঠ গদ্য লেখকের কৃতিত্ব তাঁরই। তাঁর সৃষ্টিকাল উনিশ শতকের শেষভাগ থেকে আমৃত্যু (৭ আগস্ট ১৯৪১) বিস্তৃত। বিশ শতকের একটা বড় অংশ জুড়ে তিনি ছিলেন বাংলা সাহিত্যের একচ্ছত্র অধিপতি।


রবীন্দ্রনাথের ভাবানুভূতি ও শিল্পচেতনা বিবর্তনধর্মী। সৃজনশীলতা, নব নব ভাবকল্পনা ও রূপচেতনার দ্বারা তিনি একটি স্বতন্ত্র ধারার সৃষ্টি করেন। তিনি অভূতপূর্ব শিল্পসমৃদ্ধ ও নতুন রূপাঙ্গিকের কাব্য, নাটক, উপন্যাস, ছোটগ্রল্প, প্রবন্ধ এবং দুহাজারেরও অধিক গান রচনা করেছেন। তবে এগুলিই সাহিত্যের ইতিহাসে তাঁকে মূল্যায়িত করার জন্য যথেষ্ট নয়। সাহিত্য, সমাজ, ধর্ম ও রাজনীতিবিষয়ক তাঁর বিবিধ প্রবন্ধ, সামাজিক ও ধর্মীয় বিশ্লেষক হিসেবে তাঁর অবদান, বিভিন্ন রচনার স্বকৃত ইংরেজি অনুবাদ সব মিলিয়ে প্রাচুর্যে ও বৈচিত্র্যে রবীন্দ্রনাথ একটি পূর্ণ প্রতিষ্ঠানস্বরূপ। তাঁর রচনা পৃথিবীর প্রধান প্রধান ভাষায় অনূদিত হয়েছে। কবি হিসেবে তিনি বিশ্বজোড়া খ্যাতি অর্জন করেন গীতাঞ্জলি কাব্যের জন্য নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির মাধ্যমে। রবীন্দ্রযুগ বাংলা সাহিত্যের সমৃদ্ধির সেরা যুগ। এ পর্বের সাহিত্যের প্রধান বিশেষত্ব কাব্য-সাহিত্যের নতুন ভাব-ভঙ্গি ও আদর্শ, কথা-সাহিত্যের অসামান্য বিকাশ ও উন্নতি, নাট্যসাহিত্যে আধুনিক ব্যক্তিচৈতন্য, সমাজবোধ ও অধ্যাত্মবোধের প্রকাশ, পাশ্চাত্য সাহিত্যের আদর্শ স্বীকরণ, চলিত ভাষার প্রভাব, সাময়িকপত্রের প্রকাশ ও তার মাধ্যমে সাহিত্যের দ্রুত উন্নতি এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বাংলার পঠন-পাঠন ও বাংলায় পাঠ্যপুস্তক রচনার প্রসার।


এ পর্বের দুজন উল্লেখযোগ্য সাহিত্যিক হচ্ছেন জগদীশচন্দ্র বসু (১৮৫৮-১৯৩৭) ও রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী (১৮৬৪-১৯১৯)। বাংলার খ্যাতনামা বৈজ্ঞানিক জগদীশচন্দ্র Response of the living and the non-living নামে যে গ্রন্থটি লিখে বিশ্বজোড়া খ্যাতি অর্জন করেন, তারই বাংলা রূপ তাঁর অব্যক্ত গ্রন্থ। জড় জগতের মধ্যে যে চেতন সত্তার আবিষ্কার তিনি করেছিলেন, তার বর্ণনায় জগদীশচন্দ্রের কবিদৃষ্টির পরিচয় পাওয়া যায়। রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর ছিল সর্ববিষয়ে অনুসন্ধিৎসু মন। তবে বিজ্ঞানবিষয়ক রচনায়ই তিনি বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। বেদ, মহাভারত ও মহাজনচরিতকথাসহ বাংলার মেয়েলি ছড়া পর্যন্ত সকল বিষয়েই তাঁর মনীষার পরিচয় পাওয়া যায়।


রবীন্দ্রযুগের সবচেয়ে জনপ্রিয় সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৭৬-১৯৩৮)। কথাসাহিত্যিক হিসেবে তিনি ছিলেন অসাধারণ। তাঁর সামাজিক উপন্যাসের জনপ্রিয়তা সে যুগের মতো এ যুগেও এমনভাবে বহমান যে, ভারতীয় প্রায় সব ভাষায় সেগুলি অনূদিত, এমনকি চলচ্চিত্র ও মঞ্চনাটকেও রূপান্তরিত হয়েছে। তাঁর রচনায় বাঙালির নিত্যদিনের সুখদুঃখময় জীবনযাত্রা, বাংলার পল্লিলসমাজ এবং সর্বোপরি বাংলার নারীচরিত্র অপরূপ মাধুর্যে ফুটে উঠেছে। সমাজের অন্যায়, অবিচার ও দুর্বলতা তিনি তীক্ষ্ণ ও যুক্তিপূর্ণ ভাষায় পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন। ভাষায় আবেগ সঞ্চারে এবং বাংলা গদ্যের ক্রমবিকাশে শরৎচন্দ্রের অবদান নজিরবিহীন। সামাজিক সংস্কার ও নীতিবোধের প্রশ্নকেই তিনি তাঁর উপন্যাসের উপজীব্যরূপে তুলে ধরেছেন।


প্রমথ চৌধুরী (১৮৬৮-১৯৪৬) রবীন্দ্রনাথের বয়ঃকনিষ্ঠ হয়েও গদ্য রচনারীতিতে তাঁকে প্রভাবিত করেন। তাঁর প্রবন্ধ এবং ভাষাভঙ্গি পরবর্তী একটি গোষ্ঠীর ওপর বিশেষ ক্রিয়াশীল ছিল। তাই রবীন্দ্রযুগের লেখক হয়েও বাংলা গদ্যের একটা স্বতন্ত্র ধারা প্রতিষ্ঠার দাবিদার হিসেবে প্রমথ চৌধুরী বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে বিশেষভাবে খ্যাত। বাংলায় কথ্যরীতি তাঁরই হাতে সাহিত্যিক স্বীকৃতি লাভ করে এবং রবীন্দ্রনাথের সমর্থন ও চর্চায় তা সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলায় ফরাসি ছোটগল্পের আঙ্গিকরীতিকে তিনিই প্রথম পরিচিত করেন।


প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় (১৮৭৩-১৯৩২) অনেকগুলি উপন্যাস লিখলেও তাঁর আসল পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর শতাধিক ছোটগল্পে। তাঁর ছোটগল্পের আঙ্গিকনৈপুণ্য উল্লেখ করার মতো। গল্পের শেষে একটি আকস্মিক চমক তাঁর রচনাকে বিশিষ্টতা দান করেছে। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৭১-১৯৫১) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য বাংলা গদ্যের কথ্যরীতির অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক হিসেবে। তাঁর এ রীতির পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর আত্মজীবনীমূলক রচনায় এবং শিল্পের সৌন্দর্যতত্ত্বের বর্ণনায়। এ পর্বের আরও উল্লেখযোগ্যরা হলেন নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত, উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়, কেদারনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় (হাস্যরসিক), খগেন্দ্রনাথ মিত্র, জগদীশচন্দ্র গুপ্ত, জলধর সেন, সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়, নিরুপমা দেবী, প্রভাবতী দেবী, সীতা দেবী, শান্তা দেবী, হেমেন্দ্রকুমার রায় প্রমুখ।


রবীন্দ্রবলয়ে বাংলা কবিতা অর্ধশতাব্দীরও অধিককাল যাবৎ রবীন্দ্রযুগের কবিগণ রবীন্দ্রনাথের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। তবে কয়েকজন কবি এ প্রভাব অতিক্রম করে স্বাতন্ত্র্য সৃষ্টিতে সফল হয়েছেন। এমন চারজন প্রধান কবি হলেন সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত (১৮৮২-১৯২২), মোহিতলাল মজুমদার (১৮৮৮-১৯৫২), কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) এবং জসীমউদ্দীন (১৯০২-১৯৭৬)। সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত নতুন নতুন ছন্দ নির্মাণের ক্ষেত্রে অসাধারণ পারদর্শিতা দেখিয়েছেন; তাই তাঁকে বলা হয় ‘ছন্দের জাদুকর’। শব্দের চমৎকার ব্যবহার এবং ধ্বনির অনুরণন দিয়ে তিনি এক মায়াজাল বিস্তার করতেন। সত্যেন্দ্রনাথ কবিতার অনুবাদের ক্ষেত্রেও প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন।


গীতি-কবিতার লক্ষণ ও বৈশিষ্ট্য :


গীতিকবিতায়  নিম্নোক্ত চার ধরনের লক্ষণ অনুধাবন করা যায়-


(১) গীতি-কবিতা কবির একান্ত ব্যক্তিগত কথা, তাঁর এই নিজস্ব উপলব্ধির সঙ্গে সাধারণভাবে ধর্ম বা তত্ত্ব দর্শনের বিশেষ কোনো সম্পর্ক থাকবে না, এটাই স্বাভাবিক।


(২) কবির ব্যক্তিগত অনুভূতির তীব্রতার জন্যই এতে এমন এক নিবিড় আত্মময়তা থাকে যা অনুভূতিশীল চিত্তকে প্রবলভাবে স্পর্শ করে। কবি ও পাঠকের এই রসসংযোগেই গীতি-কবিতার সৌন্দর্য ফুটে ওঠে।  


(৩) কবির অনুভূতি ও উপলব্ধি ব্যক্তিগত হওয়া সত্ত্বেও গীতি-কবিতার এক শাশ্বত ও সর্বজনীন আবেদন থাকে—সম্ভবত এই কারণে যে, আন্তরিক অনুভূতির মধ্যে এমন এক নিত্যতা এবং আবেদন আছে যে অনুভূতিশীল সকল মানুষকেই তা আন্দোলিত করতে পারে।


(৪) আবেগ সংযত ও সংহত হয়ে যখন গাঢ়ত্ব লাভ করে, সেই অবস্থাতেই গীতি-কবিতা লেখা হয়। সুতরাং এর প্রকাশ হয় সাবলীল, ব্যঞ্জনাময় ও সংহত—নিটোল মুক্তা সম্ভব এক একটি শুক্তির মতো। আকারে সংক্ষিপ্ত অথচ অনুভূতিতে প্রগাঢ়—এটাই গীতি-কবিতার প্রকৃত বৈশিষ্ট্য।


উদাহরণ : বৈষ্ণব পদাবলী হল—প্রাচীন গীতি-কবিতার প্রাণ। এই পদের মূল উপজীব্য বিষয় রাধা ও কৃষ্ণের প্রেম। যখন রাধা কৃষ্ণের দর্শন বা স্পর্শসুখে আনন্দিতা তখন দেখা হয়েছে রূপোল্লাস, পূর্বরাগ, অভিসার, প্রকৃত পর্যায়ের পদ। আবার যখন কৃষ্ণের বিরহে রাধা কাতর কৃপিত তখন লেখা হয়েছে মায়, মাথুর, আক্ষেপানুরাগ পর্যায়ের পদ। কিন্তু রাধা কৃষ্মকে অবলম্বন করে এ পদ রচিত হলেও, যে আর্তি এবং আন্তরিকতা ফুটে উঠেছে, তাতে মনে হয় কবি নিজের জীবন দিয়ে এই আনন্দ ও বেদনা অনুভব না করলে কেবল ধর্মীয় সংবেদন সৃষ্টির জন্য এমন পদ রচনা করতে পারতেন না। প্রসঙ্গক্রমে মাথুর পর্যায়ে বিদ্যাপতির এই পদখানি বিশ্লেষণ করলে বক্তব্যের সারবত্তা খুঁজে পাওয়া যাবে—


এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর।


এ ভরা বাদর মাহ ভাদর


শূন্য মন্দির মোর।.......


এখানে বর্ষার যেন বিরহের একটা নিবিড় সম্বন্ধ স্থাপিত হয়েছে। রাধা আক্ষেপ করে বলছে, তার দুঃখের সীমা নেই, কারণ ভাদ্র মাসের এই ভরা বাদলেও কিনা তার গৃহ শূন্য। এ ধারণা ও বক্তব্য শাশ্বত ও চিরন্তন। কারণ সে যুগের কবি যেমন বলেছিলেন–বর্ষা এলেই প্রবাসী কান্তের জন্য মন উচাটন করে ওঠে। এ যুগের শ্রেষ্ঠ কবিও বলেই—“এমন দিনে তারে বলা যায়/এমন ঘনঘোর পরিধায়।” সেই বলবার মানুষটি ঘরে না থাকলে রবীন্দ্রনাথের নায়িকারও মনে হয়—


ঝরো ঝরো ঝরো ভাদর বাদর বিরহ কাতর শর্বরী,


ফিরিছে এ কোন অসীম রোদন কানন কানন মমরী॥


যাইহোক গীতি-কবিতার লক্ষণগুলি বিদ্যাপতির পদের মধ্যে কীরূপ বর্তমান তা এমনভাবে নির্দেশ করা যেতে পারে।


(১) মূলত বিদ্যাপতির এ পদটি ব্যক্তিগত আবেগে মহিত। আসলে এ আবেগ রাধার হলেও কবির মনের কথা সেখানে গোপন থাকেনি। বিদ্যাপতি ব্যক্তিগতভাবে রাধার অনুভূতি কখনো কখনো প্রকাশ করেছেন, তা সত্ত্বেও পদটির মধ্য দিয়ে রাধার যে কাতরোক্তি প্রকাশ পেয়েছে তা গীতিকবিতার ব্যক্তিগত লক্ষণের বহিঃপ্রকাশ মাত্র।


(২) আত্মতন্ময়তা গীতিকবিতার যে দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য—তা এই পদের মধ্যে রাধার অহং প্রকাশের মধ্য দিয়ে ব্যক্ত হয়েছে। একার্থে এখানে রাধা ও কবি একাত্মতা অর্জন করেছেন সেই কারণে এ কবিতায় পরোক্ষে যে আত্মময়তা ফুটে উঠেছে তা গীতি-কবিতার ক্ষেত্রেই সুপ্রযুক্ত।


(৩) শাশ্বত ও সার্বজনীনতা—‘এ সখী হামারি' কবিতার আবেদনের মধ্যেই প্রমাণিত এমন একটি অনুভূতি যুক্ত কবিতা শাশ্বত চিরন্তন না হয়ে পারে না। আজকের পাঠক হয় বৈশ্ববমন, অথবা ধন তার কাছে সাহিত্যরস আস্বাদনের কোনো শর্তই নয়, অথচ এই পদের আস্বাদন তিনি সহজেই করতে পারেন। অর্থাৎ কালের বিচারে প্রমাণিত হয়ে গিয়েছে এ পদের আবেদন কালোত্তীর্ণ এবং ধন নিরপেক্ষ।


(৪) সংহত প্রকাশভঙ্গির জন্যই বিদ্যাপতি খ্যাতিমান ছিলেন। তাছাড়া বৈষ্ণুব পদাবলী অতি স্বল্প পরিসরে বক্তব্য বিশদ করা সম্ভব ছিল না। অনুভূতির যে রসঘন প্রকাশ এখানে ঘটেছে তা আদর্শ স্বরূপ।


পরিশেষে, বলতে হয় কেবলমাত্র প্রাচীন বৈষ্ণুবপদ বা শক্তিপদ গীতিকবিতা পদমর্যাদায় বিভূষিত নয়। সময়ের বিশাল দূরত্ব অতিক্রম করে সাম্প্রতিককালে স্বীকৃত কবির কলম থেকে গীতিকবিতার ফল্গু স্রোত নিত্য বহমান যার অবয়ব নির্মিত—গীতিকবিতার প্রচার চারটি শর্ত সহযোগে ব্যক্তিগত লক্ষণ, আত্মময়তা, শাশ্বত ও সর্বজনীন আবেদন এবং ব্যঞ্জনাময় সংহতি। সময়, কাল, যুগ, পরিবেশ, প্রতিবেশ অতিক্রম করে গীতিকবিতা যে এমনভাবে নব সৃষ্টির উন্মাদনায় এগিয়ে চলেছে এখানেই তার বিশেষত্ব।



নিন্মে গীতিকবিতার বৈশিষ্ট্য সমূহ আলোচনা করা হলো -

১ - ভাবগত বৈশিষ্ট্য :


গীতিকবিতা নির্জন এককের গান। একলা কবির ব্যক্তি অনুভূতির চিত্রলিপি গীতিকবিতা। কবি নিজেকে উন্মুক্ত করে দেন এখানে। হৃদয়ের উৎসমুখ থেকে বাণী নিঃসৃত হয়। কবির হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা, জ্বালা-যন্ত্রণা, হতাশা-আক্রোশ, অভিমান - অভিযোগ, ক্ষোভ-ঘৃণা, চাওয়া-পাওয়া না পাওয়া- সবকিছু শব্দের অক্ষরে ছন্দোবদ্ধ হয় গীতিকবিতায়।  


২ - অঙ্গিকগত বৈশিষ্ট্য :


গীতিকবিতা হবে সংহত, সংযত। অল্প একটুর মধ্যে বৃহতের ইশারা ধ্বনিত হবে। কবিতা হবে সংগীতধর্মী। প্রাচীনকালে Lyre বা বীনাজাতীয় বাদ্যযন্ত্র যেমন Lyric এর সঙ্গী ছিল। তেমনি আজও গীতিকবিতার অন্তরে একটা সুর ধ্বনিত হয়। আখ্যানকাব্য বা মহাকাব্যের মতো বৃহদায়তন তো নয়ই, এমনকী আদি-মধ্য-অন্ত্য বিশিষ্ট হবে না।

অন্য ভাবে বললে উপরোক্ত গীতিকবিতার বৈশিষ্ট্য সমূহ ছাড়াও আরো কিছু বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়।

১ - কবির হৃদয়ের একান্ত ব্যক্তিগত ভাব আবেগের প্রকাশ হলো গীতিকবিতা।

২ - গীতিকবিতার একক আত্মমগ্ন অনুভবের তীব্রতা, সংবেদনশীল ভাষা ও সুরের অন্তর্লীন স্পর্শ পাঠক চিত্তকে অভিভূত করে। অর্থাৎ কবি ও পাঠকের নিবিড় রস সংযোগই গীতিকবিতার প্রধান আকর্ষণ।

৩ - কবির ব্যক্তিগত অনুভূতি ও সংবেদনের মন্ময়তা সত্ত্বেও গীতি কবিতার এক সর্বজনীন আবেদন ও মূল্য থাকে।

8 - গীতিকবিতা যতটা আবেগ অনুভূতি মূলক, সাধারণ ভাবে ততটা চিন্তা মূলক নয়।
  
৫ - সংহত ও সংক্ষিপ্ত অবয়ব বিন্যাসে সার্থক গীতিকবিতা শব্দ-ছন্দ-সুর-তান-ব্যঞ্জনায় এক সুসমন্বিত শিল্পরূপ। প্রেম, প্রকৃতি, স্বদেশ প্রীতি, ধর্মীয় বা ভক্তিমূলক ইত্যাদি নানা বিষয় নিয়েই গীতিকবিতা রচিত হতে পারে।


৬. এছাড়া সাবলীল গতি, সংগীত, মুখরতা, নিটোল স্বল্পাকৃতির অবয়ব, গভীর অনুভূতি আবেগ ব্যাকুলতা প্রভৃতি গীতিকবিতার অন্যতম লক্ষণ।


সব মিলিয়ে বলা যায়—সার্থক গীতি কবিতা সৃষ্টির ক্ষেত্রে চারটি বৈশিষ্ট্যের প্রতি বিশেষভাবে নজর দিতে হয়।  


(ক) ব্যক্তিগত লক্ষণ : সাধারণতঃ কোনও তত্ত্ব বা দর্শন প্রকাশ না করে এই কবিতা কবির ব্যক্তিগত কিছু অনুভূতিই প্রকাশ করবে।  


(খ) আত্মময়তা : ব্যক্তিগত অনুভূতির তীব্রতার জন্যই এমন এক আত্মময়তা ফুটে ওঠে যা সংবেদনশীল পাঠকের মনকে স্পর্শ করবেই।  


(গ) শাশ্বত ও সার্বজনীন আবেদন : যতই ব্যক্তিগত আকৃতি হোক এবং তাতে আত্মময়তা যতই তীব্র হোক, প্রকৃত গীতিকবিতার মধ্যে এক শ্বাশত ও সর্বজনীন আবেদন থাকবেই।  


(ঘ) ব্যঞ্জনাময় সংহতি : গীতিকবিতার ভাষা ব্যঞ্জনাময় হবেই কিন্তু তার সংযমত্ত হবে লক্ষণীয়। অনুভূতির এই সংহত প্রকাশ ভাবকে আরও গাঢ় করে তোলে।


দৃষ্টাত্ত : সমগ্র বিশ্ব কাব্য সাহিত্যের অঙ্গন জুড়ে গীতিকবিতার অবাধ পদচারণা। বিষয়ানুক্রমিকভাবে গীতিকবিতাকে যে কয়টি ভাগে ভাগ করা হয় তার প্রত্যেকটি বিভাগে বিশ্বের নানা ভাষায় রচিত গীতি কবিতার ভুরি ভুরি নিদর্শন মেলে। যেমন—


(১) প্রেমমূলক: মূলত ‘প্রেমই গীতিকবিতার মুখ্য উপজীব্য। দান্তে-পেত্রার্ক-স্পেনসার শেক্সপিয়র থেকে একালের বিভিন্ন কবির মধ্যে প্রেমমূলক গীতি কবিতার রচনার বিশেষ প্রবণতা অনুভূতি হয়। কারণ, মানবিক অনুভূতি সমূহের মধ্যে ‘প্রেমই সর্বাপেক্ষা প্রবল ও বিচিত্র গতি। বৈষ্ণব পদাবলীর প্রেমের আধ্যাত্ম ব্যঞ্জনা, কবি গানের প্রেমের স্থূল ইতর প্রকাশ, আর আধুনিক বাংলা গীতি কবিতার রূপ-বিহ্বলতা ও রহস্যময়তা, সব মিলে প্রেম বিষয়ক গীতিকবিতার যে ঐশ্বর্য তা’ প্রকৃতই অনবদ্য। জন ডানের ‘The Extasie’, রবার্ট ব্রাউনিয়ের ‘The Last Ride Together', গোবিন্দ চন্দ্র দাসের ‘রমণীয় মন’, দেবেন্দ্রনাথ সেনের—‘দাও দাও একটি চুম্বন’, রবীন্দ্রনাথের—‘গুপ্ত প্রেম’, জীবনানন্দ দাশের—‘বনলতা সেন,' এই শ্রেণিভুক্ত অসংখ্য কবিকীর্তির কয়েকটি প্রোজ্জ্বল নিদর্শন।


(২) দেশপ্রেম বিষয়ক : স্বদেশ প্রেম তথা দেশাত্মবোধ কবি মানসে উদ্দীপনা সঞ্চার করে এবং তা থেকে জন্ম হয় স্বদেশ প্রীতি বিষয় কবিতা ও গান। মাতৃভূমির প্রতি অনুরাগ ও শ্রদ্ধা, দেশের অতীত বীরগাথার প্রতি আকর্ষণ বিদেশি শাসকদের সম্পর্কে ঘৃণা ও ক্ষোভ জাতীয় ঐক্যের মন্ত্র ইত্যাদি এইসব কবিতা ও গানের প্রধান বিষয় বা ভাব বস্তু। যেমন— মধুসূদনের ‘বঙ্গভূমির প্রতি রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের—'স্বাধীনতা সঙ্গীত’, বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বন্দেমাতরম্’, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'চল রে চল্ সবে ভারত সন্তান’, দ্বিজেন্দ্রলালের— ‘আমার দেশ’, অক্ষয় কুমার বড়ালের 'বঙ্গভূমি', অতুলপ্রসাদের ‘ভারত লক্ষ্মী’। সরলাদেবী চৌধুরাণীর ‘নমো হিন্দুস্থান', রবীন্দ্রনাথের 'ভারততীর্থ' ছাড়াও চারণ কবি মুকুন্দ দাস রচিত স্বদেশ প্রেমের কবিতাগুলি এই শ্রেণির উল্লেখযোগ্য রচনা।


(৩) প্রকৃতি-প্রেম বিষয়ক : নিসর্গ প্রকৃতির রূপ-রস-স্পর্শ বর্ণ ঘ্রাণের নিবিড়, ভাবনিষ্ঠ চিত্রণ মানব ও প্রকৃতির দূরত্বকে অতিক্রম করার ব্যাকুলতা, প্রকৃতির রহস্য ও সৌন্দর্য্যোপভোগের বাসনা, প্রকৃতিতে নীতি ও তত্ত্বের আরোপ ইত্যাদি বিষয়গুলি পাশ্চাত্য তথা বাংলা প্রকৃতি প্রেম বিষয়ক গীতিকবিতা গুলিতে নিত্যনূতন ব্যঞ্জনায় প্রকাশিত হয়েছে। যেমন—ওয়ার্ডসওয়ার্থের— 'Lucy'-কে নিয়ে লেখা হৃদয়স্পর্শী লিরিক গুচ্ছ, শেলীর “To a skylark' কিংবা 'Ode to the west wind-এর মতো রূপক ও দর্শনভাবনা ঋদ্ধ স্তোত্র কবিতা যুগল, কিসের 'Ode to a Nightingale' ও 'To Autumn'. আর বাংলাতে— বিহারীলালের 'নিসর্গ সন্দর্শন', রবীন্দ্রনাথের ‘বর্ষামঙ্গল, ও ‘বসুন্ধরা’, মোহিতলাল মজুমদারের ‘কালবৈশাখী’, প্রভৃতি আরও অনেক রচনা প্রকৃতি বিষয়ক কবিতা এই সমৃদ্ধ ও রসঘন ধারার প্রতিনিধিত্ব করে। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে বিদ্যাপতির ‘এ সখি আমারি দুঃখের নাহি ওর’ কবিতাটি। হৃদয়ের সঠিক অবস্থা চিত্রিত করার জন্যই চার পাশে প্রমত্ত আনন্দের চিত্র কবি এঁকেছেন—ঘন ঘন বজ্রপাতের শব্দে আনন্দে নেচে উঠেছে ময়ূর, ধারাপাতের আনন্দে গেয়ে উঠেছে দাদুরী, ডাকছে ডাহুকি। এ সমস্ত দেখে রাধার বুক যেন ফেটে যাচ্ছে। বিদ্যাপতি দেখেছেন ঘোর যামিনীর তিমির অন্ধকারে দুর্যোগ কালো মেঘের ওপর বিদ্যুতের পঙক্তি অস্থির হয়ে ছুটোছুটি করছে। হতে পারে ঘন নৈরাশ্যের অন্ধকারের মধ্যে চকিত আশার দীপ্তিকেই কবি উপমিত করতে চেয়েছেন, কিন্তু কী অব্যর্থ চিত্রকল্প। সেই ছবি মনে করেই বোধ করি একালের বিশ্বকবি বলে উঠেছিলেন—


“তোমার শ্যামল শোভার বুকে বিদ্যুতেরই জ্বালা।”


আসলে, মধ্য যুগের কবি বিদ্যাপতি ধর্মের গণ্ডি পেরিয়ে রাধার সঙ্গে একাত্ম হয়ে গিয়েছেন, তাই এ কবিতায় তার অনুভূতি ও তার ব্যঞ্জনার মধ্যে রাধা কোনও ব্যবধান নয়, এক অলৌকিক সেতু। যে প্রকৃতিকে রাধা দেখেছে কৃষ্ণকে স্মরণ করতে গিয়ে কবির কাছে সেই কালো অন্ধকারাচ্ছন্ন প্রকৃতিই হয়ে গেছে কৃষ্ণ। আধুনিক কবির কাছে ধর্মের এই উপলক্ষ না থাকলেও যখন কবি গেয়ে ওঠেন—


“এই শ্রাবণের বুকের ভেতর আগুন আছে।


সেই আগুনের কালোরূপ যে আমার চোখের পরে নাচে।।”


তখন একটি কৃষ্ণমূর্তি কি ঝলসে ওঠে না আমাদের মনের মধ্যে। এখানেই কবি বিদ্যাপতি কবিতার উপলক্ষকে অতিক্রম করে যান, সার্থক গীতি কবিতার স্বাদ সঞ্চারিত করতে পারেন তার মাথুর পর্যায়ের ধর্মীয় কবিতায়।


এবারে দেখা যাক সমালোচ্য বৈষ্ণব পদটি কেন সার্থক প্রাচীন গীতি কবিতার উদাহরণ? গীতি কবিতার বৈশিষ্ট্য বিচারে মোট চারটি প্রধান লক্ষণ পরিলক্ষিত হয়, যথা—ব্যক্তিগত লক্ষণ, আত্মময়তা, শাশ্বত ও সর্বজনীন আবেদন এবং ব্যঞ্জনাময় সংহতি। এক্ষেত্রে প্রথমে যদি ব্যক্তিগত লক্ষণের কথা ধরা হয়, তাহলে বলতে হবে—উক্ত বৈষ্ণব পদটি যতই ব্যক্তিগত আবেগে মথিত বলে মনে হোক, আসলে এ আবেগ কবির নয়, রাধার, সেকথা কবি নিজেই ব্যক্ত করেছেন। আসলে কোনও ধর্মীয় কবিতাই কবির ব্যক্তিগত আকুলতা হতে পারে না, বৈষ্ণব পদাবলীও তা নয়, বৈষ্ণব কবিতা একটি ধর্ম সম্প্রদায়ের কবিতা, একটি গোষ্ঠীর কবিতা, তবুও বলতে হয় বিদ্যাপতি কিন্তু চৈতন্যোত্তর যুগের কবির মতো গোষ্ঠীময়তায় ভুগতেন না, ব্যক্তিগত ভাবে রাধার অনুভূতি তিনি কখনো সখনো প্রকাশ করেছেন। তাই বয়ঃসন্ধির পদে তাঁর স্বাতন্ত্র্য যেমন আমরা দেখেছি তেমনি এই পদেও দেখি প্রেমের সঙ্গেই তিনি কামের কথাও বলেছেন—“কাম দারুণ/সঘনে খর শর হস্তিয়া।”


‘আত্মময়তা’ গীতি কবিতার দ্বিতীয় লক্ষণ, বৈষ্ণবকবিতায় রাধার অহং অথবা এই আত্মময়তা প্রকাশিত হয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বিশেষ ভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে–বর্ষার তুমুল বর্ষণের প্রেক্ষিতে রাধার বিরহ আকুলতার যে চিত্র কবি বর্ণনা করেছেন, আত্মময় অনুভূতি না থাকলে তা করা যায় না। রাধা এবং কবি একাত্ম না হলে এ অনুভূতি আসতেই পারে না, এবং সেই কারণে এ কবিতায় পরোক্ষ যে আত্মময়তা ফুটে উঠেছে তাকে অস্বীকার করলে কবিতাটির ওপর অবিচার করা হবে। ‘শাশ্বত ও সর্বজনীন আবেদন’ যে ‘এ সখী হামারি’ কবিতার মূলীভূত বিষয় সেকথা বাড়িয়ে বলার দরকার নেই। এমন একটি অনুভূতিগার কবিতা কেবল বৈষ্ণব রসজ্ঞই বুঝতে পারবেন এমন দাবী করা অসঙ্গত। আজকের পাঠকের ধর্ম সাহিত্য রস আস্বাদনের কোনো শর্তই নয়, অথচ এই পদের আস্বাদন তিনি সহজেই করতে পারেন। করতে পারেন যে, তার সব চেয়ে বড়ো প্রমাণ এতদিন পরেও ধর্ম নিরপেক্ষ ভাবে কবিতাটির তীব্র আকর্ষণ। কালের বিচারে প্রমাণিত হয়ে গিয়েছে যে এর আবেদন কালোত্তীর্ণ এবং ধর্ম নিরপেক্ষ।


সর্বশেষে বলা যায়, মূলত সংহত প্রকাশভঙ্গীর জন্যই বিদ্যাপতি খ্যাতিমান ছিলেন, তাছাড়া বৈষ্ণব পদের অতি স্বল্প পরিসরে বক্তব্য বিশদ করা সম্ভবও ছিল না, অনুভূতির যে রসঘন প্রকাশ এখানে ঘটেছে তা এখনো আমাদের আদর্শ স্বরূপ।


গীতিকবিতা কয় প্রকার ও কি কি :-


গীতিকবিতাকে যেই দিকদিয়ে শ্রেনীবিভাগ করা হোক না কেন তা নিন্মোক্ত গীতিকবিতার অন্তর্ভুক্ত হবে।


১ - ভাবকেন্দ্রিক গীতিকবিতা :-


নাম থেকেই বোঝা যায়, ভাবকেন্দ্রিক গীতিকবিতা (Subjective Poetry) হল সেই ধরনের গীতিকবিতা, যা কোনো ব্যক্তির নিজস্ব ভাবানুভুতিকে ভিত্তি করে প্রকাশিত হয়। অর্থাৎ বিষয়ের চেয়ে বিষয়ী যেখানে বড় বস্তুর চেয়ে বস্তুকে (বিষয়কে) আশ্রয় করে গড়ে ওঠা কোনো ব্যক্তিগত ভাবনাই যেখানে প্রধান হয়ে উঠে। এই ধরনের গীতিকবিতা হল :

i) আত্মচিন্তামূলক (Reflective) গীতিকবিতা।

ii) ভক্তিভাবমূলক (Devotional) গীতিকবিতা ।

iii) স্বদেশপ্রেমমূলক (Patriotic) গীতিকবিতা।

iv) প্রকৃতি বা নিসর্গকে আশ্রয় করে রচিত গীতিকবিতা।

v) প্রেমমূলক গীতিকবিতা।

vi) শোককাব্য (Elegy)।


২ - রূপকেন্দ্রিক গীতিকবিতা :-


কেবল ভাবকে ভিত্তি করে যেমন গীতিকবিতার শ্রেণীবিভাগ করা যায়, তেমনি রূপ বা Form কেও ভিত্তি করে এই বিভাগ করা যায়।

i) 'ওড' (Ode) কবিতা।

ii) সনেট কবিতা।


****************************************
  
তথ্যনর্দেশ.  সূত্র :


বঙ্কিম রচনাবলী’(২য় খণ্ড), সাহিত্য সংসদ, কলকাতা ৭০০ ০০৯, চতুর্দশ মুদ্রণ, ফাল্গুন ১৪০৯, পৃ ১৬৫


বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস (১ম খণ্ড) – সুকুমার সেন, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা – ৭০০ ০০৯, ষষ্ঠ সংস্করণ ১৯৭৮, পৃ ১৫১


ওয়েকিপিডিয়ি মুক্ত বিশ্ব কোষ


বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস - আনিসুজ্জামান , বাংলা একাডিমী


মধ্যযুগের বাঙলা গীতিকবিতা  মহাম্মদ আব্দুল হাই ও ডঃ আহমদ শরীফ সম্পদিত মওলা ব্রাদার্স


বাঙলার কাব্য - হুমায়ুন কবির বিশ্ব ,  সাহত্য কেন্দ্র


উনবিংশ শতকের গীতিকবিতা সংকলন - শ্র্রী শ্রী কুমার বন্দোপাধ্যায় ও অরুণকুমার মুখোপাধ্যায়, মডার্ণ বুক এজন্সি কলিকাতা