প্রথমেই সবার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি কারন আজকের এ লেখা মৌলিক কোন লেখা নয় এ লেখা বিভিন্ন লেখকের লেখা থেকে , ওয়াকেপেডিয়া ও বিভিন্ন ওয়েব পেইজের লেখা থেকে সংগ্রহ করে উপস্থাপন করলাম । ভুল ত্রুটি নিয়ে আলোচনা করলে খুশী হবো ।


কবি
কবি শব্দটি 'কু' ক্রিয়ামূলের বংশে প্রসূত একটি শব্দ। 'কু' অর্থ' অ-সাধারণ (নবরূপে উত্তীর্ণ) কারী।  এতেই বোঝা যায় কবি সেই মানুষ যিনি সাধারণ অভিজ্ঞতা বা অনুভূতি অথবা প্রচলিত শব্দকে নতুন রূপে উত্তীর্ণ করতে সক্ষম। ইংরেজী শব্দ 'পয়েট' (poet), ল্যাটিন ভাষার প্রথম শব্দরূপ বিশেষ্যবাচক পুংলিঙ্গ 'পয়েটা, পয়েটে' ('poeta, poetae') (আক্ষরিক অর্থ 'কবি, কবি এর') থেকে সংকলিত হয়েছে। ফরাসি কবি আর্থার রিমবোঁদ "কবি" শব্দের লিখিতভাবে সারাংশ প্রদান করেছেন তা হুবুহু তুলে  ধরা হল -
“ একজন কবি দর্শনীয় মাধ্যম হিসেবে নিজেকে অন্যের চোখে ফুঁটিয়ে তোলেন। তিনি একটি দীর্ঘ, সীমাহীন এবং পদ্ধতিবিহীন, অনিয়ন্ত্রিত অবস্থায় সকলের দৃষ্টিগ্রাহ্যতার বাইরে অবতীর্ণ হয়ে কবিতা রচনা করেন। সকল স্তরের ভালবাসা, দুঃখ-বেদনা, উন্মত্ততা-উন্মাদনার মাঝে নিজেকে খুঁজে পান তিনি। তিনি সকল ধরণের বিষবাষ্পকে নিঃশেষ করতে পারেন। সেই সাথে পারেন এগুলোর সারাংশকে কবিতা আকারে সংরক্ষণ করতে। অকথ্য দৈহিক ও মানসিক যন্ত্রণাকে সাথে নিয়ে তিনি অকুণ্ঠ বিশ্বাসবোধ রচনা করে যখন, যেমন, যেখানে খুশী অগ্রসর হন। একজন অতি মানবীয় শক্তিমত্তার সাহায্যে তিনি সকল মানুষের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হিসেবে বিবেচিত হন। একজন বড় ধরণের অকর্মণ্য ব্যক্তি থেকে শুরু করে কুখ্যাত অপরাধী, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ অভিসম্পাতগ্রস্ত ব্যক্তি, এমনকি সর্বশ্রেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক হিসেবেও তিনি অভিহিত হতে পারেন! যদি তিনি অজানা, অজ্ঞাত থেকে যান কিংবা যদি তিনি বিকৃত, উন্মত্ত, বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়েন - তারপরও শেষ পর্যন্ত তিনি নিজের দৃষ্টিভঙ্গীর মাধ্যমে সেগুলো দেখতে পাবেন। তাই, কি হয়েছে যদি তিনি উৎফুল্লে ভেসে অ-শ্রুত, নামবিহীন অজানা বিষয়াদি ধ্বংস করেনঃ অন্যান্য আদিভৌতিক কর্মীরা তখন ফিরে আসবে এবং তারা পুনরায় সমান্তরালভাবে রচনা শুরু করবে যা পূর্বেই নিপতিত হয়েছিল! ”
অবশ্য, এটি পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অনেক কবিকূলের মধ্যে একজন কবি যিনি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গী প্রকাশ করেছেন মাত্র।  পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মনীষিরা কবি পরিচয় দিয়েছেন তাদের নিজস্ব অনুভুতি দিয়ে , যেমন -
প্রেমের পরশে প্রত্যেকেই কবি হয়ে ওঠে --প্লেটো
কবিরা সমাজদেহের চক্ষু বাগানের মুক্ত পাখি এবং সত্যের দর্পন ---আল্লামা ইকবাল
"তুমি আমায় ভালবাসো তাইতো আমি কবি
আমার এ রূপ সে যে তোমার ভালবাসার ছবি ।"-----কাজী নজরুল ইসলাম
অন্য মানুষের চেয়ে কবিদের তফাৎ কি জান ?  বিধাতার নিজের হাতে তৈরি শৈশব কবিদের মন থেকে কিছুতেই ঘোচে না । কোনদিন তাদের চোখ বুড়ো হয় না ,মন বুড়ো হয় না ।তাই চিরদিন তারা ছোটদের সমবয়সী হয়ে থাকে ।- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
একজন কবির ঐশ্বর্য তার কবিতা সম্ভার --এডমন্ড স্পেনসার
কবিরা হচ্ছে বুলবুলি পাখির মত যে অন্ধকারে বসেও তার মিষ্টি মধুর কলতানে চারিদিকে মুখরিত করে তোলে ।- শেলী
জীবনানন্দ দাস তাঁর ‘কবিতার কথা’ প্রবন্ধের শুরুতেই "কবি" সম্পর্কে স্বীয় ধ্যান-ধারণার
কথা তুলে ধরেছেন এভাবে-
   " সকলেই কবি নয়। কেউ কেউ কবি ;  কেননা তাদের হৃদয়ে কল্পনার এবং কল্পনার ভিতরে চিন্তা ও অভিজ্ঞতার সারবত্তা রয়েছে, এবং তাদের পশ্চাতে অনেক বিগত শতাব্দী ধরে এবং তাদের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক জগতের নব নব কাব্যবিকীরণ তাদের সাহায্য করেছে। কিন্তু সকলকে সাহায্য করতে পারে না ; যাদের হৃদয়ে কল্পনা ও কল্পনার ভিতরে অভিজ্ঞতা ও চিন্তার সারবত্তা রয়েছে তারাই সাহায্যপ্রাপ্ত হয় ; নানারকম চরাচরের সম্পর্কে এসে তারা কবিতা সৃষ্টি করবার অবসর পায়।  "
পাবলো নেরুদা বলেছিলেন, কোনো কবিকে এ ধরনের প্রশ্ন করা অনেকটা কোনো মহিলাকে তার বয়স জিজ্ঞেস করার মতো।
কবি সেই ব্যক্তি বা সাহিত্যিক, যিনি কবিত্ব শক্তির অধিকারী এবং কবিতা রচনা করেন। একজন কবি তাঁর রচিত ও সৃষ্ট মৌলিক কবিতাকে লিখিত বা অলিখিত উভয়ভাবেই প্রকাশ করতে পারেন। একটি নির্দিষ্ট প্রেক্ষাপট, ঘটনাকে রূপকধর্মী ও নান্দনিকতা সহযোগে কবিতা রচিত হয়। কবিতায় সাধারণত বহুবিধ অর্থ বা ভাবপ্রকাশ ঘটানোর পাশাপাশি বিভিন্ন ধারায় বিভাজন ঘটানো হয়। কার্যত যিনি কবিতা লিখেন, তিনিই কবি।
কবিরা সামাজিক জীব ও বটে । সাধারণের সঙ্গে তারাও একই সমাজে বাস করেন। একই রাষ্ট্রের উৎপাদিত শস্যাদি খেয়ে জীবন বাঁচায়। সাধারণের সঙ্গে একই স্কুলে-কলেজে তারাও লেখাপড়া চালিয়ে যান; কিন্তু এদের মধ্যে কারও ওপর জ্বিন আছড় করে কবিতার।
যদিও রূপকার্থে অনেক চমকপ্রদ বাক্য তৈরি করা যায়; কিন্তু এটার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার দিকে নজর দেয়া যাক। জ্যোতির্বিজ্ঞানী কার্ল সাগানের মতে মানব মস্তিষ্কের প্রধানতম কর্টেক্সগুলো হচ্ছে সেরিব্রল কর্টেক্স এবং আর কমপ্লেক্স।
ডারউইনের ন্যাচারাল সিলেকশনের পথে যে যোগ্যতার প্রশ্ন দেখা দেয় সেটা হচ্ছে টিকে থাকার যোগ্যতা। সব ধরনের প্রাণীর জন্যই পৃথিবী প্রতিকূল। সেসব প্রতিকূলতাকে সরাসরি অথবা কৌশলে বশ অথবা পরিহার করতে পারাকে যোগ্যতা বলে। টিকে থাকার প্রশ্নে প্রাণী চরিত্রে যে শিকার মনোবৃত্তির বিকাশ, শিকারসংক্রান্ত চিন্তা বলয়ের অধীনে মস্তিষ্কের যে প্রকৃত অংশের বিকাশ তাকে বিজ্ঞান বলছে রয়্যাল কমপ্লেক্স বা আর কমপ্লেক্স।
ইতোমধ্যে মানুষ খাদ্য, বাসস্থান, বন্যা, দুর্ভিক্ষ, ভূমিকম্প কিংবা অগ্ন্যুৎপাতের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখোমুখি হয়েছে। ইত্যাদি কারণে যাযাবর বৃত্তির যে প্রক্রিয়া তাকে গ্রহণ করতে হল।তার অবসর সময়চেতনা প্রকৃতির সঙ্গে তার ভাব-অভাব অথবা বিপরীত লিঙ্গের প্রতি দুর্বোধ্য টান ইত্যাদির চিন্তাসমগ্রের বিকাশের ক্রমপথে মস্তিষ্কের অন্য প্রধান যে কর্টেক্সের আবির্ভাব বিজ্ঞান তার নাম রাখে সেরিব্রল কর্টেক্স। যে কারণে মানুষ গান শোনে, কবিতা পড়ে অথবা লেখে, প্রেম করে, শ্রদ্ধাবোধে জড়িত হয়, তার চোখে সহমর্মিতার অশ্রু গড়ায়।
সামন্তীয় যুগে কবিকুলের স্থান ছিল রাজসভা। রচনা করতেন মহাকাব্য, পুঁথি, মর্সিয়া। এসব গীত হতো জনতার মাঝখানে, মুখে মুখে। কিন্তু বেশিরভাগ সামন্তীয় শাসকই ছিল দখলদার, দস্যু, অত্যাচারী প্রকৃতির। এদের মধ্যে ঘটেছে আর কমপ্লেক্সের চরমতম বিকাশ।
ইতিহাসের কুখ্যাত শাসক চেঙ্গিস খান। এ অশিক্ষিত পাশবিক শাসক যিনি সভ্যতার প্রভূত ক্ষতি করেছেন, তিনি শেষ জীবনে পাগল হয়ে ওঠেছিলেন অমরত্ব পাওয়ার আশায়।
তার অমাত্যরা অমরত্বের দাওয়াইসহ অনেক চিকিৎসককে নিয়ে আসতেন তার কাছে। তিনি তাদের তৈরি দাওয়াই তাদের খাওয়াতেন আর সঙ্গে সঙ্গে শিরশ্ছেদ করতেন। দেখতে চাইতেন মৃত্যুর পরও দাওয়াই গুণে তারা বেঁচে উঠেন কিনা। অবশেষে তিনি চৈনিক ঋষি, মহাস্থবির কবি চাংচুংকে তার দরবারে এনে অনেক লোভ দেখিয়ে জানতে চান অমর হওয়ার কোনো দাওয়াই সম্পর্কে তিনি জানেন কিনা। কেননা ততদিনে চাংচুংয়ের জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে পড়েছিল বিশ্বময়। তিনি সব প্রশ্নের জবাবে কোনো কথা না বলে শুধু চীনা কায়দায় তার বুড়া আঙুল দুটি দেখালেন। আর বললেন, অমর হওয়ার উপায় প্রেম, জীবে দয়া, তলোয়ার কিংবা রাজ্যজয় নয়।
  সত্যিই তো অবাক লাগে কত শত সহস্র রাজারানী গত হয়ে গেল, কবিতা বা কবি, হোমর বা লিওপার্দি, সেনেকা বা হাফিজ, রুমি, জামি বা খৈয়াম, হুইটম্যান বা জন ডানের কবিতা বেঁচে আছে নির্বিঘ্নে।
আরেক শাসক তৈমুর যখন পারস্য দখল করলেন। সিরাজ নগরীতে একদিন তিনি ডেকে পাঠালেন সেই সময়ের প্রখ্যাত কবি হাফিজকে। তৈমুর কবিকে জিজ্ঞেস করলেন : কী লিখ শায়েরী? শোনাওতো একটা।
হাফিজ পড়লেন
আমার সিরাজ-বধূয়া যদি গো
দিল পরে মোর হাত বুলায়
পা’র তলে তার লুটিয়ে দেব গো
সমরখন্দ আর বুখারায়।।
তৈমুর ক্ষেপে গিয়ে বলেন, বহু বছর যুদ্ধ করে, শতশত সৈন্যর প্রাণের বিনিময়ে আমি সমরখন্দ দখল করেছি আর আপনি কিনা সিরাজের একটা মেয়ের জন্য তা বিলিয়ে দিতে চাইছেন?
হাফিজ নিজের ছেঁড়া পোশাকের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বলেন, জাহাপনা দেখতেই পাচ্ছেন এ অমিতব্যয়িতার জন্যই তো আজ আমার এ দুর্দশা।
আর সম্রাট বাবরতো একজন প্রকৃত কবি। যেখানেই তিনি যেতেন সেই এলাকার কবিদের খুঁজে বের করতেন। তার প্রচুর কালজয়ী বয়েত এখনও মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন দেশে নিয়মিত উচ্চারিত হয়। এ কবিতা প্রেমের জন্য তাকে বহুবার রাজ্য হারাতে হয়েছিল। শাসনকার্য ছিল তার জন্য অভিশাপ।
একজন কবি প্রকৃত অর্থে স ষ্টা, স্বনির্মিতির। যখন একটি কবিতা সৃষ্টিকর্ম চলে তখন কবি একজন অসহায় আর দ্বিধাদ্বন্দ্বে অস্থির পোয়াতি মহিলার মতো। তার সৃজনশীল স্বেচ্ছাচারিতা তার জীবনেও প্রতিফলিত হয়। এ স্বেচ্ছাচারিতার জন্য তাকে অনেক দুঃখ ভোগ করতে হয়। যদিও এ স্বেচ্ছাচারিতাই তাকে মৌলিক ও আলাদা করে তোলে।
সে চায় একইসঙ্গে প্রেম ও বিরহ, যুদ্ধ ও শান্তি। কারণ কে না জানে যে যত বেশি প্রেমিক সে তত বেশি বিদ্রোহী। যে কবি সে সম্পূর্ণ হৃদয়পন্থী উদ্বাস্তু। এজন্য মায়াকোভস্কির ও এসনিনের কাছে জীবনের চেয়ে মৃত্যু অধিক কাম্য।
এজন্য পূর্ব ইউরোপের কবি হেরবেট, মিউশকে ভিনদেশে পাড়ি জমাতে হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নে স্তালিন জমানায় বিদ্রোহী কবি-সাহিত্যিকদের বলা হতো শুঁয়াপোকা। এদের কপালে থাকত নির্বাসন। বলা হতো রাশিয়ার বাইরে থাকলেই এরা আপনা আপনি শুকিয়ে মরে যাবে। কিন্তু ইভান বুনিন, যোশেফ ব্রদস্কি, সলোঝিনিৎসিন, ইয়েভতুশেঙ্কু বিস্তার করেছেন অনেক ডালপালা।
পোলিশ কবি চেশোয়াভ মিউশ যিনি কবিতায় একসময় বলেছিলেন কাকে বলে কবিতা যদি তা না বাঁচায় দেশ কিংবা মানুষকে, তাকেই আবার বলতে হয় কোনো দেশকে ভালোবেসোনা দেশগুলো চট করে উধাও হয়ে যায়।
কবিকে অবশ্যই খুঁজে নিতে হবে এমন কোনো প্রতিবেশ যেখানে তার কবিতা পড়ে আনন্দ পাওয়ার যথেষ্ট অবকাশ থাকে। যেখানে সে নিরাপদে প্রসব করতে পারে তার সন্তানাদি। পূরণ করতে পারে সন্তানগুলোর দাবি।
এ কারণে রিলকের ত্যাগ মহৎ। মহৎ ও নৈতিক র্যাঁবোর অভিমান। কবিতা আত্মা সত্য আর মানবিকতার রক্তিম সংস্করণ। কবির জীবন কবিতার ওপর বিশাল প্রভাব রাখে।
ব্যক্তিগত জীবনে একজন অসৎ কবি সৎ ও মহৎ কবিতা লিখতে পারেন বলে মনে হয় না। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, কবিকে পাবে না খুঁজে তার কবিতায়। ভিন্ন অর্থে এটা আংশিক সত্য হলেও সামগ্রিক অর্থে মিথ্যা। কবিকে খুঁজে পাওয়ার একমাত্র জায়গা হচ্ছে তার কবিতা। যে কারণে জনসাধারণ একজন কবির সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে যদি অন্ধত্ব ও প্রচার তাকে ধ্বংস না করে।
কবি, সাহিত্যিক ও শিল্পীদের ত্যাগ প্রসঙ্গে মার্কিন লেখক ক্যাথরিনা এন পোর্টার বলেন, সেও তো সভ্যতার অন্যতম দাবিদারদের একজন, কেন সে মধ্যবিত্ত মানসিকতাকে লালন করবে। কেন সে একগাদা জাগতিক সন্তানাদির পিতামাতা হয়ে নিজের সময়কে প্রথাগতভাবে হত্যা করবে।
বিশুদ্ধ কবিতার সন্ধানে আত্মাকে জাগিয়ে রাখতে রিলকে জার্মানির গ্রামে নানাবাড়িতে শিশুসন্তানকে রেখে সস্ত্রীক পাড়ি জমিয়েছিলেন প্যারিতে। যেখানে তিনি রদার ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে কাজ শুরু করেছিলেন। তার ‘তরুণ কবিকে চিঠি’ বইটি যে কোনো মর্মসন্ধানী কবির জন্য গুরত্বপূর্ণ।
আদি এবং এ যন্ত্রযুগেও কবিই সভ্যতার রক্ষী বাহিনীর একমাত্র গরিলাযোদ্ধা। সব অমানবিক অত্যাচার ও দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে সেই একমাত্র সোচ্চার। কবিতাকে যারা নিষিদ্ধ করতে চেয়েছিল তারাই বলতে গেলে আজ নিষিদ্ধ। কিন্তু কবিতা বেঁচে আছে যেন কিছুই হয়নি এ রকম ভাব করে।
যিনি কবি, তার থাকবে সর্ব আঙ্গিককে গ্রহণ করার ক্ষমতা। সবসময়ের জন্য তার দ্বার থাকবে উন্মুক্ত। কেননা তার অভিজ্ঞতা মিশে যাবে রক্তে। তাকে পান করতে হবে গোটা বিশ্বটাকেই।
প্রত্যেক কবির হৃদয়ের উৎসার বিশ্বহৃদয়ের ভেতর। তাকে জানতে হবে পৃথিবীর কোন কবি কী রেখে গেছেন তার জন্য। এরপর আছে গ্রহণ আর বর্জন।
এজরাপাউন্ড বলেন, কোন কবি কত পরিশ্রমী ও আন্তরিক তার প্রমাণ তার আঙ্গিক গত চেতনায়। পাঠ ও অভিজ্ঞতার জন্য যেমন তার তৎপরতার দরকার, তেমনি তার দরকার অলস সময়ের।
অলস মস্তিষ্ক শুধু শয়তানের আড্ডাখানা নয় কবিতারও প্রজনন ক্ষেত্র। কবিতা লিখতে গিয়ে অনেকেরই সম্মান, অর্থ, প্রতিপত্তি সব ভেসে যায়। হায়, চাকরি বাঁচানো ও জীবিকা চিন্তায় যারা অস্থির এ পথ তাদের নয়।
কবি ইতোমধ্যে দু’চোখ কালো কাপড়ে বেঁধে সম্পূর্ণ অজানার উদ্দেশে পর্বতশিখর থেকে লাফ দেয়া একজন। তিনি জানেন না কোথায় তিনি পাতিত হবেন। লাফ দেয়া আর ভূপাতিত হওয়ার মধ্যবর্তী সময়টাই কবি জীবন।
প্রচার ও যশোলাভের অতিরিক্ত ইচ্ছা তাকে ভুল পথে নিয়ে যায়। কবিতা লেখা ও কবিতা খোঁজা ছাড়া এ সম্পর্কিত অন্য কোনো বিষয় যেমন যত্রতত্র কবিতা ছাপার প্রতিযোগিতা, ইতিহাসে স্থান পাওয়ার জন্য ইঁদুর দৌড় অস্তিত্বের সঙ্কটের কষ্টকর উপলব্ধিতে নিজেকে জাহির করার উদগ্র প্রয়াস তাকে হাস্যকর করে তুলতে পারে। প্রকৃত কবি ইতিহাসে স্থান চান না, তিনি ইতিহাস তৈরি করেন।
মহামানব ও বৈজ্ঞানিকদের মতো কবিও সভ্যতার জন্য অপরিহার্য। সে ক্ষেত্রে কবি নিজেও একজন পৃথিবীর অভিভাবক। পুরস্কারের সঙ্গে তার সম্পর্ক নির্লিপ্ততার।


বাংলা ভাষার সত্তর দশকের কবি রণজিৎ দাস এক সাক্ষাৎকারে জবান দেন ‘পুরস্কার আর কবির সম্পর্ক অনেকটা বুটজুতা আর গোলাপ ফুলের সম্পর্কের মতো বেঢপ। সে ব্যস্ত নিরীক্ষায়। জীবনানন্দ যার সার্থক উদাহরণ। অমিয় চক্রবর্তী কবিজীবনকে বলেছিলেন বেদনার যুগ। তিনি ক্ষেত্রে কবির নাম দেয়া যায় বেদনার সন্তান।
মৃত্যুশয্যায় জীবনানন্দকে যখন প্যাথিড্রিন দেয়া হচ্ছিল তখন আচমকা তিনি বলেছিলেন ‘আমি কোটি কোটি প্যাথিড্রিন নিয়েছি’। এ উদ্ভট অসংলগ্ন চিৎকার থেকে বেরিয়ে আসে কবিজীবনের আদি সত্য।
কবি নিজের মদে নিজেই মাতাল। যে কোনো ভালো নেশাখোরের সঙ্গে তার এত মিল কেন তিনি জানেন না। পৃথিবীকে যিনি ঘর বলে মেনেছেন তাকে চারদেয়ালের ঘরে বেঁধে রাখা যায় না। যিনি হোমারের বংশধর, সতত সঞ্চারমান। তিনি তো সেই আত্ম-উন্মাদ বিশ্বহৃদয়েরই অংশ।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কবিতার শরীরে সূক্ষ্ম পরিবর্তন আসে। এটা মৌলিক কবিরা দ্রুত বুঝতে পারেন বলে মনে হয়। বিশেষ করে আঙ্গিক ও ভাষায়। যে কারণে একটার পর একটা মুভমেন্ট তৈরি হয়। যদিও আরোপিত কোনো কিছু স্থায়িত্ব পায় না।
চিলির বিজ্ঞানী কবি নিকানর পাররা লিখেছিলেন ‘লিখ যা তোমার খুশি/কেবল তা যেন শাদা কাগজের চাইতে উৎকৃষ্ট হয়।’ শাদা কাগজের চেয়ে উৎকৃষ্ট হতে গেলেই তো তাকে কবিতা হতে হবে।
মনে হয় তিনি কবির অসীম স্বাধীনতার কথাই বলতে চেয়েছেন। একাডেমিক ভীতির ভেতর যেহেতু কোনো সৃজনশীলতা সম্ভব নয়, তাই তিনি সাদা কাগজ থেকেই শুরু করতে বলেন। নিকানর পাররার নিজের কবিতাগুলোই এর প্রকৃত উদাহরণ।
রবীন্দ্রনাথও প্রথমদিকে কবিতার পরিবর্তন বুঝতে পারেননি। শেষের দিকে তিনি নিজেই এ ধাঁচে লিখতে শুরু করেন, ‘নাগিনীরা চারদিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিঃশ্বাস।’ এ কবিতাটি আধুনিক কবিতার উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
সত্যিকার অর্থেই কবিতা এক মেটাফিজিক্যাল থট। অভিজ্ঞতা এবং স্মৃতি একজন কবির ভেতর রসায়ন হয়ে শব্দ জাদুবাক্যে পরিণত হওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করতে থাকে।
জিএম কোয়েতজি ‘ফো’ নামের উপন্যাসে তা চমৎকার দেখিয়েছেন। উপন্যাসের চরিত্রের সঙ্গে লেখকের যে আর্ন্তনীতিক সম্পর্ক তা যে কোনো স্রষ্টার সঙ্গে সৃষ্টির সম্পর্ককে নির্দেশ করে। একইসঙ্গে এ সম্পর্ক আনন্দ ও কষ্টের। বিষাদ ও একাকিত্বের।
জনরুচির গালে এক থাপ্পড় মেরেছিলেন মায়াকভস্কি। মনে হয় যারা কবিতায় দুর্বোধ্যতার কথা বলেন, মাল-মশলা নিয়ে চিন্তা করেন আর কবিতা না পড়ার হুমকি দেন কিংবা খুব বিনীত চাতুর্যের সঙ্গে বলেন তিনিও একদা কবিতা পড়তেন, তিনিও কবিতার পাঠক।
পাঠকেরও অন্তত কবিতাপাঠ মুহূর্তের সততার দরকার। তারও দরকার কবিতার সূক্ষ্ম পরিবর্তনের সঙ্গে নিজের রুচিরও পরিবর্তন সাধন করা।
তিনি যদি এ সময়ের কবির কাছে নজরুলীয় বা রাবিন্দ্রীক কবিতা চান তবে তিনি অশিক্ষিত পাঠক। অতীতে জীবিত, বর্তমানে মৃত। অশিক্ষিত পাঠকের বাহবা আর মুনাফাখোর প্রকাশকদের খুশি করতে গিয়ে বহু কবি নষ্ট হয়ে গেছেন। ডামাডোলে হারিয়ে ফেলেছেন নিজেদের।
কবিতার গণপাঠক কল্পনাতীত। কবিকেও নিজের কবিতা সম্পর্কে কঠোর হতে হয়। স্বরচিত অনেক কবিতা থেকে দাঁতের ডাক্তারের মতো অনেক শব্দ লাইন তাকে উপড়ে ফেলতে হয়।
ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর তিনি কবিতাটি সম্পর্কে হবেন অধিক যত্নবান, অধিক নির্মম, অধিক সন্দেহপরায়ণ। পাঠকের তোয়াক্কা করার সময় তার নেই। কারণ কবিতার যারা পাঠক তারাও কবি। একজন কবির মতোই তারাও সম্ভবত: ছন্নছাড়া মায়াবী ফকির।


উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ একবার কবিদের কাজ সম্বন্ধে বিবৃত করেছিলেন যে,
“ গানের বিষয়বস্তুকে আনন্দের সাথে তুলে ধরা
বাইরে নির্গত হয়ে আমার আত্মাকে ঐদিন পরিশোধিত করবে
যা কখনো ভুলে যাবার মতো বিষয় নয় এবং এখানে লিপিবদ্ধ থাকবে। (দ্য প্রিলুড বুক ওয়ান) ”


ম্যারিয়েন মুরে কর্তৃক কবিদের কাজ সম্পর্কে বলেছেন যে,
“ তারা প্রকৃতই সুন্দর পরিবেশ সৃষ্টি করেন। (পয়েট্রি) ”


অন্যান্য অনেক কবি যেমনঃ 'এইনিডে' ভার্জিল এবং 'প্যারাডাইজ লস্টে' জন মিল্টন বর্ণনা করেছেন যে, 'গ্রীক পুরাণে বর্ণিত কাব্য ও সঙ্গীতাদির দেবীরা তাদের আবেগিক কর্মকাণ্ড প্রয়োগের মাধ্যমে কবিদের কাজে সহায়তা করেন'।
কবির বেদনা-বিদ্ধ হৃদয়ই কবিতার জন্ম-ভূমি। অর্থাৎ, সময়-বিশেষে কোন একটি বিশেষ সূত্রকে অবলম্বন করে কবির আনন্দ-বেদনা যখন প্রকাশের পথ পায়, তখনই কবিতার জন্ম। কবি বেদনাকে আস্বাদ্যমান রস-মূর্তি দান করেন। ব্যক্তিগত বেদনার বিষপুষ্প থেকে কবি যখন কল্পনার সাহায্যে আনন্দমধু আস্বাদন করতে পারেন, তখন বেদনা পর্যন্ত রূপান্তরিত ও সুন্দর হয়ে উঠে। বেদনার যিনি ভোক্তা, তাঁকে এটি দ্রষ্টা না হতে পারলে তাঁর দ্বারা কাব্য-সৃষ্টি সম্ভব নয়। কবির বেদনা-অনুভূতির এ রূপান্তর-ক্রিয়া সম্বন্ধে ক্রোচে তাঁর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন এভাবে -
“ Poetic idealisation is not a frivolous embellishment, but a profound penetration in virtue of which we pass from troublous emotion to the serenity of contemplation. ”


বাইরের জগতের রূপ-রস-গন্ধ-স্পর্শ-শব্দ বা আপন মনের ভাবনা-বেদনা কল্পনাকে যে-লেখক অনুভূতি-স্নিগ্ধ ছন্দোবদ্ধ তনু-শ্রী দান করতে পারেন, তাকেই আমরা কবি নামে বিশেষিত করি।


অনেকে বলেন যে, যিনি জগতের একখানি যথাযথ স্বাভাবিক চিত্রপট এঁকে দিতে পারেন, তিনিই যথার্থ কবি। অর্থাৎ, কবি জগতের ভালো-মন্দের যথাযথ চিত্র অঙ্কন করবেন।
কবিতা একটি সাহিত্য রীতি মাধ্যমে সৌন্দর্য বা শৈল্পিক অনুভূতি এক অভিব্যক্তি হিসেবে প্রশংসা শব্দ শ্লোক বা গদ্য । সময়ের সাথে কবিতার কেন্দ্রীয় থিমগুলি পরিবর্তিত হয়েছে; প্রাচীনকালে, কবিতাটির লক্ষ্য ছিল যুদ্ধে যোদ্ধাদের পরাস্ততা এবং দক্ষতা বর্ণনা করা। মধ্যযুগে থাকাকালীন রোমান্টিক কবিতা আরও বেশি প্রাসঙ্গিকতা অর্জন করেছিল। বর্তমানে, রোমান্টিক কবিতা এখনও টেবিলে রয়েছে, তবে অন্যান্য অনুপ্রেরণামূলক বিষয়গুলি মানবাধিকার এবং পরিবেশের মতো প্রকাশ পেয়েছে। এটি স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত করে যে সাহিত্য সেই সময়ের সাথে খাপ খায় যাঁরা এই জাতীয় শিল্পকে নিজেরাই প্রকাশ করার জন্য ব্যবহার করেন।


"কে কবি— কবে কে মোরে? ঘটকালি করি,
শবদে শবদে বিয়া দেয় যেই জন,
সেই কি সে যম-দমী? তার শিরোপরি
শোভে কি অক্ষয় শোভা যশের রতন?
সেই কবি মোর মতে, কল্পনা সুন্দরী
যার মনঃ-কমলেতে পাতেন আসন,
অস্তগামি-ভানু-প্রভা-সদৃশ বিতরি
ভাবের সংসারে তার সুবর্ণ-কিরণ।" (মাইকেল মধুসূদন দত্ত)
কবিতা
    কবিতা এমন একটি মত প্রকাশের পদ্ধতি যা প্রাচীন কাল থেকেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে অনেক সাহিত্য গবেষকদের মতে সাহিত্যের আদিমতম শাখা হচ্ছে কবিতা। এ কথার সমর্থনে বেশ জোরালো যুক্তিও রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে মেসোপটেমিয়ার [বর্তমানে ইরাক] মহাকাব্য “গিল্গামেশ” [প্রায় ২১০০ খ্রিষ্টপূর্ব] সাহিত্য জগতের সবচেয়ে প্রাচীনতম নিদর্শন। এ তাছাড়া ‘বৈদিক সংস্কৃত’ ভাষায় রচিত প্রাচীনতম হিন্দু ধর্মগ্রন্থ “বেদ” [১৭০০-১২০০ খ্রিষ্টপূর্ব] এবং হোমারের “অডিসি” [৮০০-৬৭৫ খ্রিষ্টপূর্ব] গ্রন্থ দুটি কাব্যিক ধারায়ই লিখিত।
‘কবিতা’ শব্দটির ইংরেজি হচ্ছে ‘poetry’ যেটি গ্রিক শব্দ ‘poiesis’ থেকে এসেছে যার অর্থ ‘নির্মাণ’ অথবা ‘তৈরি করা’। এটি শিল্পের একটি অন্যতম মূল্যবান শাখা যেখানে ভাষার নান্দনিক বৈশিষ্টের ব্যবহার লক্ষণীয়। এর পাশাপাশি কবিতায় ধারণাগত এবং শব্দার্থিক বিষয়বস্তুর অনবদ্য উপস্থিতি রয়েছে। এরিস্টটলের “পোয়েটিকস” গ্রন্থেও কবিতার সংজ্ঞা নিরূপণের প্রাথমিক প্রচেষ্টা লক্ষণীয়। প্রকৃত অর্থে কবিতা হচ্ছে সৃষ্টিশীলতা ও নান্দনিকতার এক অপূর্ব সংমিশ্রণ যেখানে মানুষের আভ্যন্তরীণ আবেগ এবং অনুভূতির সাথে পার্থিব বাস্তবতা মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।
কবিতার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ এর বক্তব্য হচ্ছে
কবিতা, কাব্য বা পদ্য হচ্ছে শব্দ প্রয়োগের ছান্দসিক কিংবা অনিবার্য ভাবার্থের বাক্য বিন্যাস--- যা একজন কবির আবেগ-অনুভূতি, উপলব্ধি ও চিন্তা করার সংক্ষিপ্ত রুপ এবং তা অত্যাবশ্যকীয়ভাবে উপমা-উৎপ্রেক্ষা-চিত্রকল্পের সাহায্যে আন্দোলিত সৃষ্টির উদাহরণ। পৃথিবী নামক গ্রহের তাবৎ বিষয়কে পুজি করে কবিতা ফলত সুমধুর শ্রুতিযোগ্যতা যুক্ত করে। কাঠামোর বিচারে কবিতা নানা রকম। যুগে যুগে কবিরা কবিতার বৈশিষ্ট্য ও কাঠামোতে পরিবর্তন এনেছেন। কবিতা শিল্পের মহত্তম শাখা পরিগণিত হয়েছে ।
কবিতা (গ্রিক: "ποίησις," poiesis, "নির্মাণ" অথবা "তৈরি করা"; ইংরেজি: Poetry) শিল্পের একটি শাখা যেখানে ভাষার নান্দনিক গুণাবলির ব্যবহারের পাশাপাশি ধারণাগত এবং শব্দার্থিক বিষয়বস্তু ব্যবহার করা হয়।[স্পষ্টকরণ প্রয়োজন] কবিতার রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস, এবং কবিতাকে সংজ্ঞায়িত করার প্রাথমিক প্রচেষ্টা, যেমন এরিস্টটলের পোয়েটিকস, অলঙ্কারশাস্ত্র, নাটক, সংগীত এবং হাস্যরসাত্ম বক্তব্যের বিভিন্ন ব্যবহারসমূহের উপর দৃষ্টিপাত করে। কবিতা সাহিত্যের আদিমতম শাখা।
কবিতা একটি সাহিত্য রীতি মাধ্যমে সৌন্দর্য বা শৈল্পিক অনুভূতি এক অভিব্যক্তি হিসেবে প্রশংসা শব্দ শ্লোক বা গদ্য । সময়ের সাথে কবিতার কেন্দ্রীয় থিমগুলি পরিবর্তিত হয়েছে; প্রাচীনকালে, কবিতাটির লক্ষ্য ছিল যুদ্ধে যোদ্ধাদের পরাস্ততা এবং দক্ষতা বর্ণনা করা। মধ্যযুগে থাকাকালীন রোমান্টিক কবিতা আরও বেশি প্রাসঙ্গিকতা অর্জন করেছিল। বর্তমানে, রোমান্টিক কবিতা এখনও টেবিলে রয়েছে, তবে অন্যান্য অনুপ্রেরণামূলক বিষয়গুলি মানবাধিকার এবং পরিবেশের মতো প্রকাশ পেয়েছে। এটি স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত করে যে সাহিত্য সেই সময়ের সাথে খাপ খায় যাঁরা এই জাতীয় শিল্পকে নিজেরাই প্রকাশ করার জন্য ব্যবহার করেন।
সাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা হল কবিতা। পৃথিবীর সব দেশে সব ভাষাতেই কবিতা লেখা হয়। এক কথায় কবিতার কোনো সংজ্ঞা দেওয়া যায় না। কয়েকটি বাক্যে কবিতার বৈশিষ্ট্য সব প্রকাশ করা যায়না । জগতের অধরা মাধুরী কবিতার মধ্যে খানিক প্রকাশ পায়। শ্রেষ্ঠ কবিতা তার বাচ্যার্থ ও লক্ষ্যণার্থকে অতিক্রম করে ব্যঞ্জনার্থে উন্নীত হয় এবং রসময়তা সষ্টি করে। কিন্তু কাব্য রস অপার্থিব । কবিতা অলৌকিক। কবিতা লোকোত্তর আনন্দ দান করে।
সাধারণ ভাবে কবিতা হল কবির উপলব্ধিজাত এক বিশেষ শিল্পভাবনা। কবিতা হল এক ধরনের সৃষ্টি । কবির মনে বা জগতে – যা আগে ভাবের মধ্যে ছিল,বস্তু হিসেবে ছিল না, কবি তাকেই রচনা প্রতিভার গুণে কবিতা হিসেবে নতুন রূপ দেন। কবিতা হল কবির সৌন্দর্য্যভাবনার বহিঃপ্রকাশ বা কবির বাস্তবতাবোধের উন্মোচন ঘটায়। পাশা পাশি কবিতা হল কবি মনে স্থিত ভাব ও ভা্লোবাসার জাগরণ। কবিতা হল এক ধরনের সদর্থক জীবনভাবনা – যা মানুষকে সতত প্রেরণা দেয়। কবিতা মানুষকে ভালবাসতে শেখায়, প্রতিবাদী হতে সাহায্য করে। কবিতা মানুষকে নির্মল আনন্দ দান করে।কবিতা কবির শিক্ষা, সংস্কৃতি, চেতনার পরিচয় প্রদান করে।কবিতা পাঠে মন-প্রাণ সমৃদ্ধ হয়।কবিতা রচনা করলে প্রজননের স্বাদ পাওয়া যায়।


এক বিশেষ মুহূর্তে কবিতা রচিত হয়। অন্য কোনো সময়ে জোর করে কবিতা লেখা যায় না। মনের অস্থিরতাতেও কবিতা লেখা যায় না। শব্দ এবং অর্থের যথার্থ মিলনের ফলেই কবিতার জন্ম হয়। কবি মধুসূদন বলেছিলেন – ‘কে কবি, কবে কে মোরে শব্দে শব্দে বিয়া দেয় যেই জন’। প্রাচীন কালে আচার্য ভামহ বলেছিলেন- ‘শব্দার্থৌ সহিতৌ কাব্যম্’। অর্থাৎ শব্দ ও অর্থের সমন্বয়ে কাব্য বা কবিতা গড়ে ওথে। আচার্য বামন বলেছিলেন- ‘কাব্যং গ্রাহ্যং অলংকারাৎ’। অর্থাৎ কাব্য বা কবিতা গ্রাহ্য হয় অলঙ্কারের দ্বারা। অলঙ্কার দুই প্রকার- শব্দালঙ্কার এবং অর্থালঙ্কার ।শব্দালঙ্কার কবিতাকে শব্দধ্বনিগত সৌন্দর্য দান করে আর অর্থালংকার কবিতাকে অর্থগত সৌন্দর্য দান করে। কবিতা ছন্দবদ্ধ রচনা। নিরূপিত ছন্দে রচিত না হয়েও কবিতার মধ্যে এক ধরনের ছান্দিক সৌন্দর্য প্রকাশ পায়।


কবিতা আমাদের চিন্তা-চেতনাকে জাগ্রত করে, প্রেরণা দেয়। কবিতা আমাদের সৃষ্টিশীল করে। কবিতা আমাদের জীবনকে ভালবাসতে শেখায়।কবিতা আমাদের আত্মসংস্কৃতিকে ও জাতীয় সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করে। কবিতা পাঠকের অন্তরঙ্গতা ও আন্তরিকতা দাবি করে।


সকল লেখাই আবার কবিতা হয়ে ওঠে না। এই প্রসঙ্গে কবি জীবনানন্দ বলেছেন- ‘সকলেই কবি নয় কেউ কেউ কবি’।অর্থাৎ কবিতা লিখলেই কবি হওয়া যায় না। কাব্যলক্ষ্মী যাঁকে কৃপা করেন তিনিই কবি হয়ে উঠতে পারেন । অমর কবিতা লিখে বিখ্যাত হয়েছেন বাল্মীকি, ব্যাসদেব , হোমার প্রমুখ কবি। পরবর্তী কালে কালিদাস, ভারবি, শেলী, কীটস, বায়রন, ইয়েটস, রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ দাশ প্রমুখ কবি উচ্চ মানের কবিতা লিখে জগতে বিখ্যাত হয়েছেন। আমরা এ প্রসঙ্গে কবি জীবনানন্দ দাশের লেখা ‘কবিতার কথা’ গ্রন্থ থেকে কয়েকটি উদ্ধৃতি ব্যবহার করতে পারি।
১। “কবিতা রসেরই ব্যাপার, কিন্তু এক ধরনের উৎকৃষ্ট চিত্তের বিশেষ সব  অভিঞ্জতা ও চেতনার জিনিস – শুদ্ধ কল্পনা বা একান্ত বুদ্ধির রস নয়”।
২। “হতে পারে কবিতা জীবনের নানারকম সমস্যার উদ্ঘাটন; কিন্তু উদ্ঘাটন দার্শনিকের মতো নয়, যা উদ্ঘাটিত হল তা যে কোন জঠর থেকেই হোক আসবে সৌন্দর্য রূপে …”
৩। “বিভিন্ন অভিজ্ঞ পাঠকের বিচার ও রুচির সঙ্গে যুক্ত থাকা দরকার কবির; কবিতার সম্পরকে পাঠক ও সমালোচকরা কীভাবে দায়িত্ব সম্পন্ন করছেন – এবং কীভাবে তা করা উচিত সেইসব চেতনার উপর কবির ভবিষ্যৎ কাব্য,আমার মনে হয় আরো স্পষ্টভাবেশুরাড়াবার সুযোগ পেতে পারে”।
৪।  “কবির পক্ষে সমাজকে বোঝা দরকার, কবিতার অস্থির ভিতরে থাকবে ইতিহাস চেতনা ও মরমে থাকবে পরিচ্ছন্ন কাল জ্ঞান” ।
কবিতা সাহিত্যের আদিমতম একটি শাখা। ধারণা করা হয়, যখন পৃথিবীর মানুষের কোনো অক্ষরজ্ঞান ছিল না, তখনো মানুষের মুখে কবিতা ছিল। কবিতা নানা সময়ে নানা রূপে এসেছে। কবিতার ভিন্ন ভিন্ন রূপগুলোই আজ কবিতার বিভিন্ন শাখায় পরিণত হয়েছে। এই কবিতা নিয়ে মানুষের আগ্রহের কমতি নেই। বলা হয়, প্রায় সবার হৃদয়ে একটি কবি সত্তা বাস করে। মানুষ তার মনের ভেতরের যেকোনো ভাব, চিন্তা-ভাবনা, আবেগ ও অনুভূতিগুলো যখন ছন্দোবদ্ধ আকারে প্রকাশ করে, তখনই সেটা হয়ে উঠে কবিতা। তবে এটি কবিতার কোনো সংজ্ঞা নয়। আজ পর্যন্ত কোনো কবি কবিতার কোনো সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা দিতে পারেননি। কবিতা নিয়ে পৃথিবীর বিখ্যাত কবিগণ কবিতার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে নিজ নিজ ভাবনা প্রকাশ করেছেন মাত্র। সেই ভাবনা থেকেই আমরা কবিতার সংজ্ঞা খোঁজে বের করার চেষ্টা করি।
বিশ্ববিখ্যাত গ্রিক কবি ও দার্শনিক অ্যারিস্টটল বলেছেন, ‘কবিতা দর্শনের চেয়ে বেশি, ইতিহাসের চেয়ে বড়।’ এখানে তিনি কবিতার মাধ্যমে মানুষের সুগভীর ভাবনার প্রকাশ ও এর বিশালতার কথাই বলেছেন। কবিতা নিয়ে তাঁর ভাবনার গ্রহণযোগ্যতা অনেক বেশি, কিন্তু কবিতার সংজ্ঞা হিসেবে বিবেচ্য নয়।
ঊনবিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান কবি পার্সি বিশি শেলি কবিতার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন, ‘কবিতা পরিতৃপ্তির বিষয়। কবিতা তখনই সার্থক হয়, যখন কবি মনের পরিতৃপ্তিতে পূর্ণতা আসে।’ তাঁর ভাষায় বোঝানো হচ্ছে, কবিতা হলো মানুষের পরিতৃপ্তির বিষয়। মানুষের মনের ভাব প্রকাশের শ্রেষ্ঠ মুহূর্তের বিবরণ হচ্ছে কবিতা। শেলির এই বক্তব্যের সঙ্গে অনেকেই সহমত প্রকাশ করেছেন এবং এটি বেশ গ্রহণযোগ্য। তবে কবিতার সংজ্ঞা হিসেবে পরিপূর্ণ নয়।
ইংরেজি সাহিত্যের অন্যতম রোমান্টিক কবি জন কীটস বলেছেন, ‘কবিতা মুগ্ধ করবে তার সূক্ষ্ম অপরিমেয়তায়, একটি মাত্র ঝংকারে নয়। পাঠকের মনে হবে এ যেন তারই সর্বোত্তম চিন্তা, যা ক্রমশ ভেসে উঠছে তার স্মৃতিতে।’ জন কীটস আরও বিস্তৃতভাবে কবিতা সম্পর্কে তাঁর ভাবনার প্রকাশ করেছেন। তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, শুধু ছন্দে ও অন্ত্যমিলে কোনো কিছু লিখলেই সেটা কবিতা হবে না। কবিতা পাঠকের হৃদয়ে দাগ কাটবে এবং নিজের ভাবনাগুলো কবিতায় খোঁজে পাবে।
কবিতা নিয়ে কীটসের এই বক্তব্য অর্থবহ হলেও গ্রহণযোগ্যতা তুলনামূলক কম। কবিতার এই সংজ্ঞাটি কিছুটা বিতর্কিত। তবে তাঁর ধারণাটি কবি সমাজে বেশ প্রচলিত। তাই অনেক কবি কীটসের সঙ্গে সুর মিলিয়ে বলে থাকেন, ছন্দ মিলিয়ে কোনো কিছু লিখলেই সেটা কবিতা হয় না।
নিজ নিজ ভাবনা থেকে এভাবে কবিতা নিয়ে পৃথিবী বিখ্যাত কবিগণ নানাভাবে কবিতার সংজ্ঞা দিয়েছেন। যেমন কবি মেকল বলছেন, ‘কবিতা বললে আমরা বুঝি সেই শিল্প, যা শব্দকে ব্যবহার করে এমনভাবে, যা কল্পনার রাজ্যে জাগিয়ে দেয় এক স্বপ্ন।’ কবি রবার্ট ফ্রস্ট বলেছেন, ‘কবিতা হলো ‘পারফরমেন্স ইন ওয়ার্ডস’। কবি কোলরিজ বলেছেন, ‘গদ্য মানে শব্দ সর্বোৎকৃষ্টভাবে সাজানো। আর পদ্য মানে সর্বোৎকৃষ্ট শব্দ সর্বোৎকৃষ্টভাবে সাজানো।’
কবি এডগার এলান বলেছেন, ‘কবিতা হলো সৌন্দর্যের ছন্দময় সৃষ্টি।’ কবি এলিয়ট বলেছেন, ‘কবিতা রচনা হলো রক্তকে কালিতে রূপান্তর করার যন্ত্রণা।’ কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থ বলেছেন, ‘কবিতা সব জ্ঞানের শ্বাস-প্রশ্বাস আর সূক্ষ্ম আত্মা।’ কবি কার্লাইল বলেছেন, ‘কবিতা হলো মিউজিক্যাল থট।’ কবিতা নিয়ে এই বিখ্যাত কবিদের ভাবনা খুব সুন্দর ও গ্রহণযোগ্যতা আছে। তবে কারও বক্তব্য কবিতার সংজ্ঞা হিসেবে আখ্যায়িত করা যায় না।
কবিতা নিয়ে আরও দুজন বিদেশি বিখ্যাত কবি চমৎকার দুটি সংজ্ঞা দিয়েছেন। কবি সেন্ট অগাস্টিন কবিতা সম্পর্কে তাঁর ভাবনা থেকে বলেছেন, ‘যদি জিজ্ঞাসা করা না হয়, আমি জানি। যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, আমি জানি না।’ এখানে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, কবিতা কি, সেটা আমরা জানি। যখন জিজ্ঞাসা করা হয়, তখন কবিতার সংজ্ঞা দেওয়া মুশকিল। মনে হবে, কবিতা একটা রহস্যময়, অজানা কিছু, যা আমরা জানি না।
আর কবি জনসন বলেছেন, ‘কবিতা হলো মেট্রিক্যাল কম্পোজিশন। আনন্দ ও সত্যকে মেলানোর শিল্প, যেখানে রিজনকে সাহায্য করার জন্যে ইমাজিনেশনের ডাক পড়ে।’ এখানে তাঁর বক্তব্যে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, কবিতা হচ্ছে এমনি এক শিল্প, যা দিয়ে আনন্দের সঙ্গে সত্যকে প্রকাশ করা হয়। আর সেটা প্রকাশ করার জন্য কল্পনার প্রয়োজন হয়। কবিতা বিষয়ক এই দুটি বক্তব্য থেকে কবিতার গভীরতা ও বিস্তৃতি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়, তবে কবিতার সংজ্ঞা হিসেবে স্পষ্ট নয়। অনেকেই আবার স্বীকার করেন, ‘পোয়েট্রি ইজ ইমিটিশন অব লাইফ, ক্রিটিসিজম অব লাইফ, মিরর অব লাইফ’। এটাও কবিতার পরিপূর্ণ সংজ্ঞা নয়, শুধু কবিতা সম্পর্কিত একটি ধারণা হিসেবে বিবেচ্য করা যায়।
বিদেশি বিখ্যাত কবিদের পাশাপাশি আমাদের বিখ্যাত বাঙালি কবিগণও কবিতার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে নিজেদের ধারণা প্রকাশ করেছেন। তাঁদের দেওয়া কবিতার ধারণা থেকেও আমরা কবিতার সংজ্ঞা সম্পর্কে জানতে পারব।


কবি হুমায়ুন আজাদের মতে, ‘যা পুরোপুরি বুঝে উঠব না, বুকে ওষ্ঠে হৃৎপিণ্ডে রক্তে মেধায় সম্পূর্ণ পাব না, যা আমি অনুপস্থিত হয়ে যাওয়ার পরও, রহস্য রয়ে যাবে রক্তের কাছে, তার নাম কবিতা।’ তাঁর দেওয়া সংজ্ঞাটি বেশ জটিল এবং তিনি এর কোনো পরিপূর্ণ ব্যাখ্যা দেননি। তবে সুগভীর চিন্তা-ভাবনা ও উপলব্ধি করলে সহজেই বোধগম্য।
এবার আসা যাক বাঙালি কবিদের ভাবনায়। তাঁরা কবিতা নিয়ে কী বলেছেন জানা যাক। কবি সিকান্দার আবু জাফর বলেছেন, ‘আমি কবিতা লিখি অনায়াসে । যেমন সকলেরই ক্ষেত্রে জীবনের আশে-পাশে অসংখ্য সুলভ-দুর্লভ মুহূর্ত নানা রূপে অনাবৃত হয়েছে আমার সামনে। আমি কোনো কোনো সময় সেই সব মুহূর্তের স্বাক্ষর লিপিবদ্ধ করেছি সত্য-বিচ্যুতি না ঘটিয়ে। সেই আমার কবিতা।’ এটি খুব অর্থপূর্ণ একটি সংজ্ঞা এবং সহজেই বোধগম্য। এই আলোচনা থেকে বুঝতে পারি, আমার চোখের সামনে যা কিছু দেখি এবং অনুভব ও কল্পনা করে যা সৃষ্টি হয়, তাই কবিতা।
কবি বুদ্ধদেব বসু বলেছেন, ‘কবিতা বোঝার বিষয় নয়, এটাকে অনুভব করতে হয়। কারণ কবি সম্ভবত বুঝেসুঝে কবিতা লেখেন না, কেবল বিষয়কে সামনে রেখে তাকে অনুভব করেই কবিতার জন্ম হয়।’ কবিতা নিয়ে তিনি খুব সহজ একটি সংজ্ঞা দিয়েছেন। এখানে তিনি কবিতাকে খুব সহজ করে উপস্থাপন করেছেন। তাঁর সংজ্ঞায় বোঝা যায়, কবিতা জটিল কিছু নয়। মানুষের মনের আবেগ ও অনুভূতির কাব্যিক প্রকাশ হলো কবিতা।
কবি সৈয়দ শামসুল হকের মতে, ‘কবিতা হচ্ছে সর্বোত্তম ভাবের সর্বোত্তম শব্দের সর্বোত্তম প্রকাশ। সর্বোত্তম ভাবের সঙ্গে সর্বোত্তম শব্দের সংযোগই পারে সর্বোত্তম কবিতা সৃষ্টি করতে।’ এই সংজ্ঞাটি অর্থবহ ও গ্রহণযোগ্যতা আছে। পৃথিবীর কিছু বিখ্যাত কবিদের দেওয়া সংজ্ঞার সঙ্গে তাঁর এই সংজ্ঞার কিছু মিল পাওয়া যায়।
কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ কবিতার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন, ‘যে লেখাটি সমকালের স্মৃতি বা স্বপ্নকে তুলে আনতে সক্ষম এবং একই সঙ্গে সমকালকে অতিক্রমের যোগ্যতা রাখে, তাকেই বোধ হয় কবিতা বলা যেতে পারে।’ তিনি কিছুটা সংশয় নিয়ে কবিতার সংজ্ঞাটি দিয়েছেন। তবে তাঁর দেওয়া সংজ্ঞা বেশ স্বতন্ত্র ও অর্থবহ। তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, কবিতা সমকালকে তুলে ধরতে সক্ষম এবং ভবিষ্যতের ভাবনায় বিচরণ করতে পারে।
বিখ্যাত কবিদের দেওয়া কবিতার সংজ্ঞা থেকে আমরা কবিতার কোনো সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা খোঁজে বের করতে পারব না, কিন্তু উপলব্ধি করতে পারব। কবিতা আসলেই বোঝার মতো খুব বেশি কিছু নেই, কবিতা শুধুই উপলব্ধি করার বিষয়। কবিতা উপলব্ধি করতে পারলেই কবিতার জন্ম দেওয়া যায়। কবিদের নানা সংজ্ঞা থেকে আমরা উপলব্ধি করতে পারি, ‘কবিতা অনেকটাই আসমানি কিতাবের ন্যায় ঈশ্বর প্রদত্ত দান। যাহা কবির মননে আসে এবং সুগভীর চিন্তা ভাবনার পর সুসজ্জিত ও অলংকৃত শব্দ বিন্যাস এবং কাব্যিক ছন্দ বিন্যস্ত কিছু বাক্যের মাধ্যমে ভূমিষ্ঠ হয়।’ এটি অবশ্য আমার একান্তই নিজস্ব ধারণা, তবে এতে কারও ভিন্ন মতো থাকতেই পারে এবং এটাই স্বাভাবিক।
যারা কবিতা লিখেন, আমরা তাদের কবি বলি। আবার এটা নিয়েও বিতর্ক আছে, কারণ অনেকেই বলেন কবিতার মতন অন্ত্যমিলে কিছু লিখলেই সেটা কবিতা হয় না। তাই সবাইকে কবি বলা যাবে না। যারা কবিতা লিখেন, তাদের কাছে প্রশ্ন রাখা হলেও কবিতার কোনো সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা দিতে পারেন না। এর কারণ হচ্ছে কবিতাকে কোনো সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞায় বেঁধে রাখা যায় না। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রূপে কবিতা আমাদের সামনে এসেছে। ভবিষ্যতেও আরও নানা রূপে আমাদের সামনে আসবে। কবিতাকে কোনো নিয়মনীতি ও শৃঙ্খলায় আবদ্ধ করে রাখা যায়নি, যদিও কবিতা লেখায় অনেক নিয়মনীতি আছে। কবিতার বিভিন্ন রূপের জন্য বিভিন্ন নিয়মনীতি থাকবে কিন্তু কবিতা থাকবে চিরকাল উন্মুক্ত। কোনো সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞায় কবিতাকে কখনো আবদ্ধ করা যাবে না। বিখ্যাত কিছু মনিষীদের সজ্ঞা উদৃত করা হল -
১ “কবিতা হ'ল নর্থ শক্তিতে উত্থিত সাধারণ ভাষা। কবিতাকে ধারণাগুলি দ্বারা ঘৃণা করা হয়, নার্ভাস এবং আবেগের সাথে রক্তাক্ত, সবগুলি একসাথে শব্দটির সূক্ষ্ম, শক্ত চামড়া দ্বারা ধারণ করা হয়। " - পল অ্যাঙ্গেল, দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসের একটি নিবন্ধ থেকে।


২. "যে কবিতার অনুভূতি থেকে মহৎ আনন্দ এনে দেয় তিনি সত্যিকারের কবি, যদিও তিনি তাঁর জীবনে কখনও একটি লাইন রচনা করেন নি।" - দ্য ডেভিলস পুল থেকে জর্জ স্যান্ড।


৩. “কবিতা পার্টি লাইনের বহিঃপ্রকাশ নয়। এটি সেই রাতের সময়, বিছানায় শুয়ে আপনি কী ভাবছেন তা চিন্তা করে, ব্যক্তিগত বিশ্বকে জনসাধারণ করে তোলেন, এটাই কবি করেন ”" - অ্যালেন গিন্সবার্গ, জিনসবার্গ থেকে, একটি জীবনী।


৪. "কবি হওয়া শর্ত, পেশা নয়।" - রবার্ট গ্রাভস, 1946 হরিজনে একটি প্রশ্নাবলীর জবাবে।


৫. “কবিতা আবেগকে পরিমাপ করা হয়। আবেগ অবশ্যই প্রকৃতির দ্বারা আসতে হবে, তবে পরিমাপটি শিল্প দ্বারা অর্জন করা যেতে পারে। " - টমাস হার্ডি, ফ্লোরেন্স হার্ডির দ্বারা প্রাপ্ত থমাস হার্ডির পরবর্তী বছরগুলিতে উদ্ধৃত।


৬. “কবিতা হ'ল জমিনে বসবাসকারী সমুদ্রের প্রাণীদের জার্নাল, বাতাসে উড়তে চায়। কবিতা অজানা এবং অজ্ঞাতসারে বাধার দিকে গুলি করার জন্য সিলেবলগুলির সন্ধান। কবিতা হ'ল রেইনবো কীভাবে তৈরি হয় এবং কেন সে চলে যায় তা একটি ফ্যান্টম স্ক্রিপ্ট। - কার্ল স্যান্ডবার্গ, আটলান্টিক থেকে, 1923 মার্চ।


৭. "কবিতা সূক্ষ্ম বাড়া দিয়ে চমকে দেওয়া উচিত একাকীত্বের দ্বারা নয় - এটি পাঠককে তার নিজের সর্বোচ্চ চিন্তার শব্দ হিসাবে আঘাত করা উচিত এবং প্রায় একটি স্মরণ হিসাবে প্রদর্শিত হবে।" - জন কিটস, অন অ্যাক্সিমস এবং কবিতার চমক থেকে।


৮. "কবিতা বিশ্বের লুকানো সৌন্দর্য থেকে ওড়না তুলে দেয় এবং পরিচিত বস্তুকে এমন করে তোলে যেন তারা পরিচিত ছিল না।" - পার্সি বাইশে শেলি, অ্যা ডিফেন্স অফ পোয়েট্রি এবং অন্যান্য প্রবন্ধ থেকে।


৯. "এটি একটি পরীক্ষা [যা] আসল কবিতা বোঝার আগে যোগাযোগ করতে পারে” " - টি। এস এলিয়ট, "দান্তে" প্রবন্ধটি থেকে


১০. "কবিতাটি শক্তিশালী অনুভূতির স্বতঃস্ফূর্ত ওভারফ্লো হয়: এটি প্রশান্তির মধ্যে ফিরে পাওয়া সংবেদন থেকে উদ্ভূত হয়” " - উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ, "প্রিফেস টু লিরিক্যাল বল্ল্ডস"।


১১. "আমরা অন্যের সাথে ঝগড়া, বাকবিতণ্ডা, কিন্তু নিজের সাথে ঝগড়া, কবিতা।" - উইলিয়াম বাটলার ইয়েটস, পের অ্যামিকা সিলেন্টিয়া লুনা থেকে।


১২. "’ সুতরাং ’এমন একটি শব্দ যা কবি অবশ্যই জানেন না। - আন্ড্রে গিড, জার্নাল থেকে।


১৩. "আমি শব্দের কাব্যকে বিস্মৃতের ছন্দবদ্ধ সৃষ্টি হিসাবে সংজ্ঞায়িত করব।" - এডগার অ্যালান পো, "দ্য পোয়েটিক প্রিন্সিপাল" থেকে।


১৪. "কবিতা ... এমন একটি অনুভূতির প্রকাশ যা কবি বিশ্বাস করেন যে অভ্যন্তরীণ এবং ব্যক্তিগত যা পাঠক তার নিজের হিসাবে স্বীকৃতি দেয়।" - নিউইয়র্কের একটি ভাষণ থেকে সালভাতোর কাসিমোডো, দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসে উদ্ধৃত।


১৫. "একজন কবি সাহসী এতটাই স্পষ্ট এবং পরিষ্কার কিছু নেই ... তিনি সৌন্দর্য থেকে ওড়নাটি খুলে ফেলেন, তবে তা সরাবেন না। পুরোপুরি স্পষ্ট একজন কবি হ'ল একটি ক্ষুদ্র দৃষ্টিনন্দন বর্ণনাকারী ” - ই বি। হোয়াইট, ওয়ান ম্যানের মাংস থেকে।


১৬. "কবি অদৃশ্যতার পুরোহিত।" - ওপাস মরণোত্তর থেকে ওয়ালেস স্টিভেনস।


১৭. "একজন কবি ভুল ছাপ ব্যতীত সমস্ত কিছুই টিকে থাকতে পারে।" - অস্কার উইল্ড, কবিদের সন্তানদের কাছ থেকে।
“কাব্যরস আস্বাদনে পাঠকদের অত্যন্ত বেশি যত্নে পথ দেখিয়ে চলা স্বাস্থ্যকর নহে। নিজে নিজে সন্ধান করা ও আবিষ্কার করা সত্যকার আনন্দ।”
– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর