লিমেরিক ও  পঞ্চপদী ছড়া


লিমেরিক সাধারণত হালকা বা মজার কোনো বিষয় নিয়ে লেখা হয়। অথবা আপাত গম্ভীর কোনো ঘটনা কৌতুক সহকারে পরিবেশিত হয় লিমেরিকে। মোদ্দাকথা লিমেরিক হল এক ধরনের রম্য কবিতা যার মাধ্যমে সমাজের ,ব্যক্তিজীবন , রাষ্ট্রের কিংবা সমগ্র বিশ্বের যে কোন অসঙ্গতির কথা অথবা যে কোন অসংগলগ্ন ভাবনা অতি সংক্ষেপে প্রকাশ করা হয় ।
পদ্যের এই ধরনের উৎপত্তি আঠারো শতকের প্রারম্ভে ইংল্যান্ডে, তবে এর মূল উৎপত্তি স্থল আয়ারল্যান্ডের লিমেরিক শহরে ।  লিমেরিক বা আইরিশ ক্ষুদ্র গান ( ditties ) এর অস্তিত্ব  ইংল্যান্ড ও  আয়ারল্যান্ডের প্রাচীন সাহিত্যে পাওয়া যায় , অ্যারিস্টোফেনিসের নাটক তার প্রমাণ ।
প্রাচীনকাল থেকে লিমেরিক শহরে এক ধরনের ছড়া কবিতার প্রচলন ছিল যা ফরাসী সৈন্যদলের আইরিশ ব্রীগিডিয়াররা আনন্দ করে গানের মত গাইতো । গানের শেষে ধূয়ো দেয়ার মত let us come up limerick বলে শেষ করতো ।
মনের দুঃখ কষ্ট ভুলে থাকার জন্য তারা কোরাসের মত করে পাঁচ লাইনে লেখা এই গানগুলো গাইত , ঐ অঞ্চলের কোন এক অজানা কবির হাতেই এ ধরনের ছড়া নির্ভর গানের প্রচলন ঘটে।
পরে সৈন্যদের মুখে মুখে এই ধরনের ছড়া নির্ভর গান বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে , আর লিমেরিক ছড়া নামে পরিচিতি লাভ করে ।
উনিশ শতকে এই ধারাটি জনপ্রিয় করে তুলেন এডওয়ার্ড লেয়ার ( Edward Lear ) ,যদিও তিনি এই শব্দটির ব্যবহার করেন নি ।  সর্ববৃহৎ এবং সবচেয়ে তথ্যসমৃদ্ধ কবিতা ও শ্লোক সংকলনের সম্পাদক গার্শন লেগম্যান মনে করেন লোক সাহিত্য হিসেবে সত্যিকারের পঞ্চপদী ছড়া সবসময় অশ্লীল। এছাড়া আর্নল্ড বেনেট ও জর্জ বার্নার্ড শও বলেন পঞ্চপদী ছড়াসমূহ খুব অল্পই মাঝারি মানের উপরে যেতে পেরেছে। লোক সাহিত্যের দৃষ্টিকোণ থেকে, এই ধারাটি বরাবরই সীমা লঙ্ঘন করে থাকে, অর্থাৎ নিষিদ্ধ বিষয়সমূহের নিয়ম লঙ্ঘন করাই এর কাজ। লেয়ার ছিলেন এই ধারার সৃজনশীল ব্যতিক্রম, যিনি অতিরিক্ত সীমা লঙ্ঘন না করে ব্যঙ্গ করতেন। এডওয়ার্ড লেয়ার ইংল্যান্ড ও আয়ারল্যান্ডের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচলিত পাঁচলাইনের ছড়া গুলোকে সংগ্রহ করে  ১৮৪৬খৃষ্টাব্দে বই আকারে প্রকাশ করেন , তিনি ২১২ টি লিমেরিক রচনা করেন , তার লেখা উল্লেখযোগ্য বই হল  A Book of Nonsence , Nonsence book, The Owl and pussy cat , The Complete Nonsense Of Edward Lear
যদিও তিনি এগুলোর নাম লিমেরিক দেননি লিমেরিক নামকরন আরও পরে তার উত্তরসূরী Lyuis Kerroll,Vendi Koup যখন পাঁচলাইনের ছড়া লেখেন তখন তারা এদেরকে লিমেরিক নাম দিয়েই লেখেন ।
লিমেরিক পাঁচ লাইনের কবিতা/ছড়া যার প্রথম, দ্বিতীয় ও পঞ্চম লাইনে অন্ত্যমিল থাকবে । তৃতীয় ও চতুর্থ লাইন দুটিতে থাকবে অন্ত্যমিল। প্রথম, দ্বিতীয় ও পঞ্চম লাইন গুলোতে আট থেকে নয়টি শব্দাংশ (syllable) থাকবে। তৃতীয় ও চতুর্থ লাইনে শব্দাংশ সংখ্যা চার থেকে পাঁচ। লিমেরিকের স্ট্যান্ডার্ড ফর্ম হল পাঁচটি লাইনের একটি স্তবক, যার মধ্যে প্রথম, দ্বিতীয় এবং পঞ্চমটি একে অপরের সাথে ছড়া এবং প্রত্যেকের তিন ফুট তিনটি অক্ষর রয়েছে; এবং সংক্ষিপ্ত তৃতীয় এবং চতুর্থ লাইনগুলিও একে অপরের সাথে ছড়াছড়ি করে ।
প্রথম লাইনটি ঐতিহ্যগতভাবে একজন ব্যক্তি এবং একটি স্থানকে পরিচয় করিয়ে দেয়, যেখানে স্থানটি প্রথম লাইনের শেষে উপস্থিত হয় এবং দ্বিতীয় এবং পঞ্চম লাইনের জন্য ছড়া পরিকল্পনা প্রতিষ্ঠা করে। প্রারম্ভিক লিমেরিক্সে, শেষ লাইনটি প্রায়শই প্রথম লাইনের পুনরাবৃত্তি ছিল, যদিও এটি আর প্রথাগত নয়।
পাঁচটি লাইন, যেখানে প্রথম দুইটি ও শেষ ও তৃতীয় সঙ্গে ছন্দ রোমান্স নিয়ে গঠিত। কোনো ছোট গল্প হিসাবে, প্রথম অক্ষর দিয়ে পরিচিত হল: লেখক তার নাম নির্দেশ করে এবং আদি শহর নায়ক কল। পরবর্তী তিন লাইন এই মানুষের জীবনের একটি অদ্ভুত কেস সম্পর্কে বলতে হবে, এবং পঞ্চম মধ্যে এই ইভেন্টে সমাজের প্রতিক্রিয়া দেখায়। ক্যানোনিকাল লিমেরিক প্রথম এবং শেষ লাইন একই ভাবে শেষ হবে।
লিমেরিক ছোট কবিতা – পাঁচ লাইনের ছড়া। গভীর ভাব নেই, তত্ত্ব নেই, উপদেশ নেই, কবিকল্পনা নেই, অলঙ্কারের ঝনৎকার নেই, অনেক আধুনিক কবিতার মতন না-বোঝার কাব্যরস নেই – এমনকি তেমন ভাবে দেখতে গেলে কোনও মানেও নেই। অথচ ছন্দ আছে, মিল আছে, নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আছে আর তার সাথে আছে এক ছেলেমানুষি মজা । সাধারণত লিমেরিক পাঁচ লাইনের ছড়া – মিলের বিন্যাস ক ক খ খ ক – তৃতীয় ও চতুর্থ লাইন অন্য লাইনগুলোর থেকে ছোট । অতএব এই ভাবধারা ও মিলবন্যাসের বাইরে লেখা পাঁচ লাইনের কবিতাকে লিমেরিক না বলে  পঞ্চপদী ছড়া বলাই উত্তম ।
তাদের অবিচল কাঠামোটি বাদ দিয়ে, যখন লিমেরিকের বিষয় আসে তখন প্রচুর অবকাশ থাকে। একটি মজার লিমেরিক লেখার জন্য এই ছয়টি লেখার টিপস অনুসরণ করুন:
একটি গল্প বল । আপনি যখন অন্য লিমেরিক গুলি পড়েন, আপনি লক্ষ্য করবেন যে তাদের একটি মূল চরিত্র, প্লট এবং রেজোলিউশন সহ সম্পূর্ণ একটি আখ্যানমূলক চাপ রয়েছে। আপনি যখন লিমেরিক লেখেন তখন খুব ছোট গল্পের মতো এটির কাছে যান।
    আপনার বিষয় দিয়ে শুরু করুন । আপনার প্রথম লাইনে আপনার মূল চরিত্রটি প্রবর্তন করা উচিত এবং আপনি যদি সেটিকে অন্তর্ভুক্ত করে থাকেন তবে একটি সেটিংস স্থাপন করা উচিত। অনুশীলন চালানোর জন্য, নিজের নাম দিয়ে শুরু করুন, এর সাথে ছড়া শব্দগুলি লিখে ফেলুন এবং দেখুন কী মজাদার লিমেরিক নিয়ে আপনি সামনে আসতে পারেন।
    এটি অযৌক্তিক করুন । লিমেরিকস বোঝার জন্য অযৌক্তিক এবং নির্বোধ। আপনি আপনার প্রধান চরিত্রটি পরিচয় করিয়ে দেওয়ার পরে, রসিকতাটি ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য এগুলি একটি অযৌক্তিক দৃশ্যে রাখুন।
    একটি মোড় দিয়ে শেষ । লিমেরিকের শেষ লাইনটি একটি রসিকতার পাঞ্চ লাইনের মতো। প্লট মোচড় দিয়ে আপনার লিমেরিক গুলি শেষ করুন।
    কাঠামো থেকে বিপথগামী না । আকাশটি যখন সুনামের বিষয় নিয়ে আসে তখন সীমা থাকে তবে আপনাকে আএবিবিএ ছড়া স্কিম এবং অ্যানাপেস্টিক ছন্দ ধরণটি অনুসরণ করতে হবে। আপনার যদি ছড়া শব্দগুলি খুঁজে পেতে সাহায্যের প্রয়োজন হয় তবে ধারণাগুলির সাথে আপনাকে সহায়তা করার জন্য একটি ছড়া অভিধানটি উল্লেখ করুন।
    আপনার লিমারিকটি জোরে জোরে পড়ুন । লিমেরিক গুলি মজাদার লেখার মতো এবং জোরে জোরে পড়তে মজাদার। আপনার লেখার সাথে সাথে এগুলি উচ্চস্বরে পড়া আপনাকে নিশ্চিত করতে সাহায্য করে যে আপনার সঠিক তাল রয়েছে। তারপরে, আপনি যখন কাজটি শেষ করেন, তখন হাসিখুশি লোকদের সামনে এটি পড়ুন।
লিমেরিকগুলি মজা - তারা সাধারণত একটি মোচড় এবং সম্ভবত একটি নীরব উপাদান একটি বিট আছে। এবং সব থেকে সেরা, তারা আপনি হতে পারে কিভাবে চতুর এবং সৃজনশীল প্রকাশ করতে একটি দুর্দান্ত উপায় হতে পারে!
একটি লিমেরিক একটি নির্দিষ্ট ছন্দ আছে যে এটি অনন্য করে তোলে। প্রতি লাইন প্রতি মিটার, বা বীট সংখ্যা ( জোর দেওয়া সিলাবল ), ৩,৩,২,২,৩,৩ উদাহরণস্বরূপ, দ্বিতীয় লাইনের মধ্যে, তিনটি জোরের পয়েন্টগুলি নিদ্রিত, তিন, এবং রাতে


অনুক্রম (সাধারণত) ৮,৮,৫,৫,৮, কিন্তু এই কিছু বৈচিত্র আছে। উপরে লিমেরিকের মধ্যে, প্রকৃতপক্ষে তৃতীয় এবং চতুর্থ লাইনের মধ্যে ৬ টি অক্ষর রয়েছে ।
  একটি লিমেরিকের ছন্দ এনাপেষ্টিক, যার অর্থ দুটি আনস্ট্রেসড সিলেবল অনুসরণ করা হয় তৃতীয় চাপযুক্ত উচ্চারণ সহ  । প্রথম, দ্বিতীয় এবং চূড়ান্ত লাইনের প্রত্যেকটিতে তিনটি এনাপেষ্ট থাকে — দ দম দ দ দম দ দম। তৃতীয় এবং চতুর্থ লাইনের দুটি অ্যানাপেস্ট রয়েছে — দা দম দা দম।


লিমেরিক ছড়ার সংজ্ঞা ও গঠন প্রক্রিয়া নিয়ে বাঙালী দুই জন কবির দুটি লিমেরিক ছড়া উল্লেখ করার লোভ সামলাতে পারলাম না -
১.
পাঁচ লাইনে ভাবের বিন্যাস, নিয়মটা মেনে ঠিক
প্রথম, দ্বিতীয় ও পঞ্চম ছন্দে হয় আন্তরিক
তৃতীয় চতুর্থ লাইন দুটো
ছন্দেমিলে হয় কিঞ্চিৎ ছোট
একটা ভাবের দীপ্ত প্রকাশ, এইতো লিমেরিক।
( কবি - অজানা )
২.
পাঁচ লাইনের ছড়া নাম লিমেরিক
এক-দুই-পাঁচে মিল হতে হবে ঠিক
তিন চার ছোট লাইন
মিল হবে লেখে আইন
ছড়া বলে হেসোনাকো করে ফিক ফিক।    
( কবি- Dr Sanat Kumar Banerjee )


বাংলায় সঠিক ও সহজভাবে লিমেরিক ছ্ড়া লেখা ও বোঝার জন্য এখানে এডওয়ার্ড লেয়ার ( Edward Lear )  এর দুটি লিমেরিক অনুবাদ সহ উপস্থাপন করলাম
১.  Edward Lear
There was an Old Person of Dean,
Who dined on one pea and one bean;
    For he said, "More than that
    Would make me too fat,"
That cautious Old Person of Dean.
দাঁতনবাসী এই বুড়োটার নামটি প্রতুল জানা,
ডিনার খেত একখানা বিন একটা মটর দানা।
    স্বল্পাহারের কারণটা তার সোজা,
   "এর বেশিতে জমবে মেদের বোঝা;"
স্বাস্থ্যচেতন এই বুড়োটার বেশি আহার মানা।
২.  Edward Lear
There was an Old Man with a beard,
Who said, 'It is just as I feared!--
         Two Owls and a Hen,
         Four Larks and a Wren,
Have all built their nests in my beard!'
দাড়ি-বুড়ো বলল কেশে কেশে,
'আশঙ্কাটা সত্যি হল শেষে!--
  চারটে শালিক, যুগল পেঁচা,
  একলা মোরগ, হাঁড়িচাঁচা
দাড়ির মধ্যে বাঁধল বাসা এসে!'


বাঙ্গালী কবিদের লেখা লিমেরিক :


১. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা একটি লিমেরিক-


মন উড়ু উড়ু, চোখ ঢুলু ঢুলু, ম্লান মুখখানি কাঁদুনিক--
আলুথালু ভাষা, ভাব এলোমেলো, ছন্দটা নিরবাঁধুনিক।
       পাঠকেরা বলে, 'এ তো নয় সোজা,
       বুঝি কি বুঝি নে যায় না সে বোঝা।'
কবি বলে, 'তার কারণ, আমার কবিতার ছাঁদ আধুনিক।'


২ . বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামও লিমেরিক লিখেছেন-


ওরে ছড়াদার, ওরে দ্যাট পাল্লাদার, মস্তবড় ‘ম্যাড’
চেহারাটা ‘মানকি লাইক’ দেখতে ভারী ‘ক্যাড’।
‘মানকি লড়বে বাবর কা সাথ
ইয়ে বড় তাজ্জব বাত!
জানে না ও ছোট্ট হলেও হামভি ‘লায়ন-ল্যাড’।


৩. সুকুমার রায় এর লেখা লিমেরিক -


নিয়ে দুটো খেজুরের রসে ভরা ঠিল্লা
নানাজান এসেছিল আন্দরকিল্লা
মাস্তান কটা জুটে
সব খেলো লুটে-পুটে
খালি হাতে নানা তাই চলেছে কুমিল্লা।


৪. সত্যজিৎ রায়ের লেখা দুটি লিমেরিক -

বুঝে দেখ জটায়ুর কলমের জোর,
ঘুরে গেছে রহস্য কাহিনীর মোড়।
থোর বড়ি খাড়া
লিখে তাড়া তাড়া,
এইবারে লিখেছেন খাড়া বড়ি থোর।

চোরের ভয়ে রামনারায়ণ খোট্টা
ঘুমোয় ব'সে বন্ধ ক'রে দোরটা,
এই সুযোগে দুই ইঁদুরে
দিব্বি খেল পেটটি পুরে
ঝোলানো তার সাধের হ্যাট আর কোটটা।