(বাবা দিবসে বাবার জন্য)


বাবার বক্ষে বিশালতার ছবি দেখেছিলাম;
ক্যানভাসে মায়ার তুলিতে আঁকা
ভালোবাসার নানান তেল ও জলের
হরেক রকম চিত্রকর্ম!
আমি মুগ্ধ হয়ে বার বার প্রদর্শনীর দীর্ঘ লাইন সাজিয়েছি।


ছেলে বেলায় স্কুলের প্রতিটি ক্লাশে প্রথম হওয়ার
খুশীর বন্যায় বাবার সাথে সাঁতরে বেড়াতাম;
বাবা তার সুগঠিত শক্ত হস্তে আমাকে আগলে রেখে
জীবন জোয়ারে সাঁতার কাঁটতে শিখিয়েছেন।
আমি এখন জানি কিভাবে হাল ধরতে হয়
সুখ-দুঃখের ঢেউ বিলাসে।


বাবা বিদেশ ছিলেন-
কঁচি হাতে লিখেছিলাম আনন্দের কথা;
বাবা জানতে চেয়েছিলেন, আমার চাওয়া-পাওয়ার কথ।
অকপটে বলেছিলাম,'শুধু একটি সাইকেল।'
বাবা, আমাকে আশা দেয়, ভালোবাসার পরম মমতায়।
'এই তো আমি বাড়ী এলে কিনে দেব লাল সাইকেল।'


আমি আশায় ছিলাম দীর্ঘ সময়,
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের স্বপ্নটা ধীরে ধীরে
বড় হতে থাকে, প্রত্যাশার মাত্রাটা ছাপিয়ে যায়
মনের অলিতে-গলিতে।
অবশেষে আসে সেই দিন, সেই ক্ষণ, সেই আনন্দ;
সদ্য নবম শ্রেণীতে ভর্তি হওয়া ছেলের স্কুলের দূরত্বের কথা ভেবে-
বাবা চারশত টাকা দিয়ে একটি সাইকেল কিনে-
ছেলের কপালে ভালোবাসার চিত্র অংকন করে দেয়।
আমার সীমাহীন আনন্দ বাবা মুগ্ধ হয়ে দেখেন।
আমি টুং টাং শব্দ করে ঘুরে বেড়াই
আমার চির চেনা পথে।
'এই তো আমার জীবনে বাবার শেষ্ঠ উপহার।'


কলেজ জীবনটা কেঁটেছে বড় অসচ্ছলতায়-
বাবার স্বল্প মাইনের বেতনে চলে যেত কোনরকম,
বাবা, কলেজের বেতন, হোস্টেল খরচের দায় মিটিয়ে
হাতে গুজে দিতেন একশ টাকার একটি নোট।
বাসে কলেজে আসা-যাওয়া, বাড়ি যাওয়া
সবই হতো এই একশত টাকায়,
বন্ধুরা বিকেল হলে যেত রেস্তোরায় চা-পুরি খেতে,
আমি তাকিয়ে দেখতাম, পকেটের দৈন্যদশার কথা ভেবে
মনে মনে খেতাম চা-পুরি-সিংগারা!
কখনো একা একা হেঁটে বেড়াতাম,
মগবাজারের রেল লাইন ধরে সোজা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের  ক্যাম্পাসে।


একুশের মাসব্যাপী বই মেলাতে যেতাম প্রতিদিন
বই খুটিয়ে খুটিয়ে দেখতাম,
মাসের কিঞ্চিত টাকা বাঁচিয়ে, হাতে সঞ্চিত অশ্ং দিয়ে
কিনতাম হাজার বছরের প্রিয় কবিতা বই
কবি সামসুর রাহমান, আসাদ চৌধুরী, নির্মলেন্দু গুণ
মহাদেব সাহা, হেলাল হাফিজ ও সৈয়দ শামসুল হকের
প্রিয় কবিতাগুলো আমাকে বেঁচে থাকার সাহস জোগাত।
এভাবে বাবার দেয়ার টাকায় তিলে তিলে গড়েছি
ছোট একটি লাইব্রেরী।


সেবার অসুখ হয়েছিল ভীষণ,
বিছানায় ছিলাম অনেকদিন,
মা, আমাকে আগলে রেখেছিলেন পরম মমতায়,
বাবাকে চোখের কোনে দেখেছিলাম দু'ফোটা চোখের জল!
এই প্রথম দেখলাম বাবার ভালোবাসার অশ্রু।


আজ দেশ ছেড়ে মা-বাবা ছেড়ে
বিদেশের মাটিতে আমি চাষ করে চলেছি
স্বপ্নের নানান ফসল;
বয়সের সীমারেখায় চলতে চলতে
মাঝে মাঝে অসুখ ভারী যন্ত্রণা করে,
ক্ষণিকের কস্টে মা-বাবাকে খুঁজে বেড়াই,
আবারও বাবার ভালোবাসার স্বাদ নিতে
খুব ইচ্ছে করে।


মা বলেন,
বাবা আমার কষ্টের কথা ভেবে
মাঝে মাঝে নীরবে ফেলে চোখের নোনা জল!


সিলভার স্প্রিং, ম্যারিল্যান্ড
০৬/১৬/২০১৩