.                       -: ভালো থাকা :-


       "ভালো থাকিস ভাই", "ভালো থাকবেন" অথবা "ভালো থেকো" -- এই কথা তো সবাই বলি। দেখা হলে, অথবা অনেকদিন দেখা না হওয়ায় ফোনে কথা হলে; সামনাসামনি বা দূর থেকে, কথা হওয়ার শেষে এই কথা প্রায় সবাই বলি। শুধু বলি না, মনে মনে এটাই কামনাও করি। প্রিয়জন, কাছের মানুষ অথবা সদ্য পরিচিত কেউ হলেও, সবাই ভালো থাকুক-- সেটাই তো প্রার্থনা করি সবাই। সবাই তো ভালো থাকতেই চেষ্টা করি। সমস্ত দিন-রাত, মাস-বছর, শৈশব-যৌবন, সমস্ত জীবন ধরে --- সারাক্ষন তো ভালো থাকারই লড়াই চলছে জগৎ জুড়ে। ভালো থাকার বিরামহীন, ক্লান্তি-শ্রান্তিহীন প্রচেষ্টা।


       আসলে আমরা কেউ একেবারে ভালো নেই। সর্বসুখে নিশ্চিন্তে নেই। থাকিনা। ছিলাম একসময়ে ঠিকই, তবে গোটা জীবনের তুলনায় সেটা খুবই অল্প সময়ের জন্য। নিশ্চিন্তে, নির্ভাবনায় ঘুমিয়ে বা আধো-জাগরণে পরম সুখে ছিলাম মায়ের গর্ভে। যেই না সেখান থেকে ভূমিষ্ঠ হয়ে জগৎ সংসারে এসে পড়লাম, সঙ্গে সঙ্গে দাই বা ডাক্তার-নার্সের চড়-চাপড়-থাবড়া, গরম জলের ছ্যাঁকা ইত্যাদি দিয়ে শুরু হয়েছে অত্যাচার। সেই যে চিল-চিৎকার করলাম, হাত-পা ছুঁড়তে শুরু করলাম, তার আর বিরাম হয়না জীবন ভর। তারপর থেকে আর সেইরকম ভালো থাকা নেই। তার পর থেকে না খেলেই খিদে পায়, খিদে মেটাতে ভালো না লাগলেও অন্যের কথা মত চলতে হয়। সে ছোটবেলায় মা-বাবা-গুরুজনেরই হোক বা বড় বেলায় Boss বা হুজুরের। সেই আদেশ মেনে চলায় সবটা ভালো লাগা থাকে কি? যখনই আমরা নিজের মত করে ভালো থাকতে চাই, তখনই তো বাধা আসে। সেই বাধা নানা রূপে, নানারকম ভাষ্যে। ছোটবেলায় যেই একটু মনের সুখে খেলছি, অমনি ধূলো মাখামাখির বিরুদ্ধে গুরুজনের শাসন। তখনই যে শিশু-আমি আর মনে মনে ভালো থাকলাম না, সেটা কি তারা ভাবলো? আচ্ছা, আমি নিজে বড় হয়ে নিজেই কি সেটা ভাবি আর? সেই ছোট্ট বয়সের খারাপ লাগার অনুভূতি বড় হলে বুঝি চাপা পড়ে যায়? একটু বড় হয়ে যখন পড়ার সময় জানলা দিয়ে হটাৎ দমকা হাওয়া আসত, সেই হাওয়ার সাথে সাথে জানলার বাইরের গোলাপ, লেবু অথবা জবা গাছের পাতা ও ফুল গুলো, অথবা উঠানের কোনো এক কোনে গজিয়ে ওঠা একমুঠো ঘাসের ডগায় ছোটো ছোটো ফুল গুলো বা ঘাসের ডগায় বসে থাকা ফড়িংটা যখন অদ্ভুত সুন্দর ভাবে দুলতে থাকত, তখন সেটা দেখতেই তো খুব খুব ভালো লাগত। মন দিয়ে সেদিকেই তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছা হতো সারাক্ষন। কিন্তু পারতাম কি? বাবা-মার কড়া নজর আবার বইয়ের দিকে দৃষ্টি ফেরাতে বাধ্য করত। কারন, ওঁরাও চাইতেন বড় হয়ে আমি যেন ওঁদের থেকে ভালো থাকি। কিন্তু ঠিক ওই সময়টায়, ওই হটাৎ দমকা হাওয়া শুরু হওয়ার সময়টায় যে ভালো থাকা হলো না আমার? জানলার বাইরের মাঠ, গাছ, পাখি দেখলে কেউ বড় হয়ে খারাপ থাকে??


        সারা জীবন ধরে আমরা এমন কত কত ভালোলাগা এবং  ভালো থাকাকে বিসর্জন দিতে থাকি, পরে আরও ভালো থাকার জন্যে। খেলতে ভালো লাগে এমন কেউ বেশিক্ষন খেলতে পারেনা, পড়তে হবে বলে। আবার পড়তে ভালোবসে এমন কেউ বেশি পড়তে পারেনা সংসারের ভার নিতে হবে বলে। কেউ আঁকতে ভালোবাসে, কিন্তু আর্ট কলেজে ভর্তি না হয়ে নিশ্চিত ভালো চাকরি পাওয়ার কলেজে ভর্তি হতে হয়, ভবিষ্যতে একটু ভালো থাকার নিশ্চয়তার কারনে। কেউ একদম ছোট্ট থেকে নাচ শিখতে শিখতে, সাথে পড়তে পড়তে শিক্ষা-জীবনের চূড়ান্ত অধ্যায়ে এসে যে কোনো একটা বেছে নিতে হয়। এই সব কিছুর পিছনের কারনই তো সেই আরো ভালো থাকা! ভালো ভাবে, সুখে বাঁচার অমোঘ আকর্ষণ।


       এমন ভাবেই প্রথম জীবনে কত কত ভালো লাগাকে ত্যাগ করে, এমন কত ভালোবাসা কে ছাড়তে ছাড়তে আমরা এগিয়ে চলি জীবনের পরবর্তী অধ্যায়ে ভালো থাকার জন্য। যারা এমন অনেক ত্যাগ, অনেক পরিশ্রম করে চাকরি বা ব্যবসা, যেকোন উপায়েই নিজের পায়ে দাঁড়ায়, স্বাবলম্বী হয় অথবা অন্যের স্বাবলম্বী হওয়ার লড়াইয়ে সাথী হয়ে, তার পাশে থেকে, একসাথে যুঝতে যুঝতে মিলিত ভাবে ভালো থাকার পর্যায়ে পৌঁছায়, সেখানে পৌঁছেও তারা যেমন ভালো থাকার স্বপ্ন দেখেছিলো, তেমনি করেই কি ভালো থাকে? "তোমায়-আমায় হেঁসে-খেলে কাটিয়ে দেবো দোঁহে"- গাইতে গাইতে গানের মত করেই কি কাটিয়ে দেওয়া হয় জীবনটা? সাফল্যের ব্যস্ততা, কাজের পরিধির মধ্যের টানাটানি, কর্তব্যের দৌড়ঝাঁপ, ভালোবাসার টানাপোড়েন -- এই সব কিছু, ওই ভালো থাকার সময় থেকে একটু একটু করে কেটে নিতে নিতে কতটুকু শেষ পর্যন্ত পড়ে থাকে? সফল জীবনের এই সীমাহীন ব্যস্ততার মধ্যে দিয়েই কেটে যায় জীবনের ভালোথাকার দিনগুলি। রবি ঠাকুরের গল্পের জেল ফেরৎ কাবুলিওয়ালার মতোই একদিন হটাৎ খেয়াল হয়, 'খোঁকি'রা হটাৎ সত্যিই বড় হয়ে গেছে। কত দ্রুত অনেক গুলো মূল্যবান শরৎ-শীত-বসন্ত পার হয়ে গেছে। সেই কাবুলিওয়ালার মত তখন সম্বিৎ ফেরে। জীবনের জন্য ছুটতে ছুটতে হটাৎ ঝটকা লাগে। তখন আয়নায় নিজের মুখ দেখেও চমকে উঠি! খেয়াল হয় ১০-২০ বছর আগেও তো মুখটা, চাহনিটা, শরীরটা এমন ছিলো না। সব কিছু কতটা বদলে গেছে। এবার মনে হয় সত্যিই নিশ্চিন্তে ভালো থাকার সময় হয়েছে। ....সত্যিই হয়েছে কি? বুকের ভিতর কে যেন বলতে থাকে, "এতগুলো বছর যে এই সুজলা-সুফলা সুন্দর পৃথিবীতে কাটালে, তার কতটুকু রূপ-রস-গন্ধ উপভোগ করতে পারলে? বিপুলা জগতের কতটুকু দেখে উঠতে পারলে? প্রতিদিন সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের সময়ের আকাশের যে রঙের খেলা, ক'দিন সেই অনিন্দ্যসুন্দর আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হারিয়ে যেতে পারলে? হটাৎ বৃষ্টির সময়ে ক'দিন দৌড়ে ছাদে বা উঠানে গিয়ে দুহাত ছড়িয়ে বৃষ্টিতে ভেজার অবকাশ পেলে? কতগুলো কালবৈশাখীর ঝড়ের বিকেল বা সন্ধ্যায় ঝরে পড়া আম কুড়ালে? জীবনে কটা রাত শুধু প্রেমের কবিতা পড়ে কাটালে? ক'টা পূর্ণিমার রাতে আবছা আলোয় ভেসে যাওয়া মায়াবী পৃথিবীর রূপ দেখলে? এই এতদিনের জীবনে নিজের জন্য কতটুকু সময়, শুধু নিজের জন্য ক'টা মুহুর্ত পেলে?" ---- তখন আয়না থেকে চোখ সরে যায় পাশের জানালার দিকে। আকাশে সাদা মেঘেদের ভিড় মন দিয়ে দেখতে ইচ্ছা হয়। পাঁচিলের ওপর দিয়ে থমকে থমকে ছুটে চলা কাঠবেড়ালিটার দিকে চোখ যায়। কত সুন্দর ভাবে লোমশ লেজ উঁচিয়ে পেয়ারা খায়, সত্যিই আগে মন দিয়ে কোনোদিন দেখা হয়নি তো! নিজের প্রিয়জন, পরিজনদের দিকে মন দিয়ে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মনে হয়, একসাথে থেকেও একে অপরকে মন দিয়ে দেখা হয়নি অনেকদিন। জীবনের জন্য ছুটতে ছুটতে, নাকি জীবন থেকেই দূরে ছুটতে ছুটতে, ভালো থাকার নেশায় ঘুরতে ঘুরতে হটাৎ ঘোর কাটে একদিন। ততদিনে আমাদের সৌরজগৎ, মহাশূন্যে মিলিয়ন, বিলিয়ন, ট্রিলিয়ন মাইল পথ পেরিয়ে এসেছে, যে পথে আর কখনো কোনোদিন ফিরে যাবে না।


          এই সময়ের সাথে ছুটতে ছুটতেই, জীবন থেকে সরতে সরতেই, নিজের থেকে হারাতে হারাতেই ভালো থাকতে হয়। সকলকে নিয়ে, সকলের জন্যে, এবং নিজের জন্য সময় খরচ করতে করতেই ভালো থাকার অনুভূতি অনুভূত হয়। হটাৎ আকাশের মেঘ, পাঁচিলের ওপরের কাঠবেড়ালি দেখে ভালো লাগলে সেটাই ভালো থাকা। জীবনের সব হিসাব মেলে না, মেলানো যায় না। সব হিসাব ঠিক থাকেও না। এই সব ঠিক-ভুল, মিল-গরমিল নিয়েই জীবন। তাতে চাওয়া, পাওয়া, না-পাওয়া, প্রেম, অ-প্রেম, হাঁসি, কান্না, কান্না-চাপা হাঁসি, উচ্ছাস, দীর্ঘশ্বাস, হাহাকার -- সব মিলে মিশে একাকার হয়ে থাকে। তার মধ্যে থেকেই জীবনের সার টুকুকে ছেঁকে তুলে নিয়ে মরমে মেখে নিই। অসীম সময়ের মধ্যে যে সামান্য আমার জন্যে বরাদ্দ, সেই সামান্য টুকুর থেকে একটুও বৃথা না যায় যেন। তাহলেই তো ভালো থাকা। সাদা-কালো মিশিয়ে, ফুলে-ফলে ভরা পল্লবিত বৃক্ষের মত শরীরে-মনে সবুজ হয়ে থাকাই তো ভালো থাকা। সেই গাছের গুঁড়ি জড়িয়ে কবি হুমায়ুন আজাদের ভাষায় যেন বলতে পারি--
"ভালো থেকো ফুল, মিষ্টি বকুল, ভালো থেকো।
ভালো থেকো ধান, ভাটিয়ালি গান, ভালো থেকো।
ভালো থেকো মেঘ, মিটিমিটি তারা।
ভালো থেকো পাখি, সবুজ পাতারা।
ভালো থেকো।
ভালো থেকো চর, ছোট কুড়ে ঘর, ভালো থেকো।
ভালো থেকো চিল, আকাশের নীল, ভালো থেকো।
ভালো থেকো পাতা, নিশির শিশির।
ভালো থেকো জল, নদীটির তীর।
ভালো থেকো গাছ, পুকুরের মাছ, ভালো থেকো।
ভালো থেকো কাক, কুহুকের ডাক, ভালো থেকো।
ভালো থেকো মাঠ, রাখালের বাশিঁ।
ভালো থেকো লাউ, কুমড়োর হাসি।
ভালো থেকো আম, ছায়া ঢাকা গ্রাম, ভালো থেকো।
ভালো থেকো ঘাস, ভোরের বাতাস, ভালো থেকো।
ভালো থেকো রোদ, মাঘের কোকিল,
ভালো থেকো বক, আড়িয়ল বিল,
ভালো থেকো নাও, মধুমতি গাও,ভালো থেকো।
ভালো থেকো মেলা, লাল ছেলেবেলা, ভালো থেকো।
ভালো থেকো, ভালো থেকো, ভালো থেকো।"


                       ------------◆-----------