খাওয়ার ঘরে দাঁড়িয়ে থাকতাম চার পায়ে।
সকাল সকাল গিন্নিমা বেশ সুন্দর করে
লুচি তরকারি সাজিয়ে দিতেন, থালায় বাটিতে।
বাবাই ও ববুন প্রাতরাশ সেরে স্কুলে যাবে,
ওরা দুই ভাই আসতো, চেয়ারে নয় -
একদম আমার উপরে চেপে বসতো।
কষ্ট হলেও, সয়ে নিতাম ওদের কচি মুখদুটো দেখে।
ওরা অবোধ, কি আর বোঝে, কতটুকুইবা জানে।
খেত আর মারামারি করতো, যাকে বলে খাদ্য যুদ্ধ।
আমার সারা গায়ে এঁঠো তরকারি জল থুতু,-
কখনো কখনো গায়ের চাদরটা ও নিচে ছড়িয়ে পড়ত।


বিড় বিড় করতে করতে গিন্নিমা আসতেন,
একরাশ বিরক্তি বুকে নিয়ে।
প্রথমে চাদরটাকে ছুঁড়ে ফেলতেন কলতলায়।
হাতে পায়ে গায়ের জোরে গরগর করতে করতে,
এদিক ওদিক সরিয়ে নিতেন আমায়, নিজের সুবিধায়।
তারপর একটা সাদা ছেঁড়া ভেজা কাপড় নিয়ে
সমস্ত বিরক্তি আর রাগ উগরে দিতেন আমার উপর।


দশটা বাজার কিছুক্ষণ আগেই, এই ভেজা চাদরটা
আবার পাতিয়ে দিতেন আমার উপর।
সাহেব অফিসে যাবেন, ভাত ডাল তরকারি মাছ।
আরো কত কি....
খাওয়ার সাজাতে দেরি হলে, সাহেব কখনো কখনো
দুই পা তুলে দিতেন আমার উপর,
স্মার্টফোন হাতে জিরিয়ে নিতেন ক্ষনিক।
"নিবেদিতা- বলি কি হলোটা কি? আর কতক্ষণ?"
সজোরে বাম হাতে দু তিনটে ঘুঁসি পড়তো আমার বুকে।


সেদিন গিন্নিমা বুঝতে পারলেন আমি বুড়ো হয়ে গেছি-
ওল্ড ফ্যাশান, চলবে না,- সামনেই জন্মদিনের পার্টি।
"বলছি শোনো না, ওটাকে স্টোররুমে ঢুকিয়ে দাও।
চাল-ডালের বস্তা রাখার জন্যই ঠিকঠাক ওটা।"
দুই কুইন্টাল তিরিশ কেজি বড্ড বেশি ছিল আমার উপর।


সহ্য করতে পারলাম না! একটা পা গেল ভেঙে,-
থাকলাম না আর কোনো কাজের, পড়েছিলাম আট দিন,
বোধহয় সাহেবের দয়া হল,- একটা ভ্যান ডেকে
এক ছুতরের কাছে পাঠিয়েছিলেন আমায়।
"শঙ্কর,- একটু ভালো করে সারিয়ে দিস,
ভাবছি নিমপুরের বাগানবাড়িতে রাখবো এটাকে।"


পা-টাতে দশ-বারোটা পেরেক মেরেছিল শঙ্কর,
কিন্তু তাতেও আমার দাঁড়ানোর সামর্থ্য হয়নি,
অগত্যা একটা নতুন পা লাগাতে হল। অর্জুন কাঠের।


এখন আমি বাগানবাড়িতে, নিমপুরের বাগানবাড়িতে।
গোলাপ অঙ্কিত চাদরে গা-ঢেকে চার পায়ে দাঁড়িয়ে থাকি।
ওরা কারা যেন আসে, কি যেন নাম ওদের...
না- ঠিক মনে পড়ছে না।
ওরা তো একে অন্যকে 'সালা' বলে ডাকে।
মদ খায় বোতল ভেঙে চলে যায়। আমার উপর!
ছিঁড়ে চাদর- ফুটো হয় চামড়া,
আমার তো রক্ত ঝরে না, আমার ঝরেনা অশ্রু...