***************
         কবি বিষ্ণু দে আপন ন্যায়িক বিশ্বাস ও সামাজিক দায়বদ্ধতার প্রেক্ষিতে নিজের কবিতা ও লেখায় যে আপন এক ধারা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলেন তাতে কোন সন্দেহ নেই । এ সম্পর্কে সাহিত্য সমালোচক বীরেন মুখার্জি’র মতামত প্রণিধান যোগ্য; তিনি বলেন, “বিষ্ণু দের স্বদেশপ্রেম একদিকে ঐতিহ্যবাহী অন্যদিকে ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে সংগ্রামী। যা একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক চেতনার সঙ্গে আদর্শিক ভিত্তিতে জনগণতন্ত্রবাদী। তিনি ইতিহাসচেতনার পথে বিশ্বযুদ্ধ,সাম্রাজ্যবাদী শক্তির কূটকৌশল, ঔপনিবেশিক শাসন ও বৈশ্ব্যতান্ত্রিক দোদুল্যমান ভারতীয় মধ্যবিত্তের ভূমিকাবিষয়ক বোধ ও অভিজ্ঞতার আলোকে সমাজতান্ত্রিক আদর্শে স্থিত হয়েছেন। ফলে তিনি কবিতায় তুলে ধরতে সচেষ্ট থেকেছেন ফ্যাসিস্ট শক্তির নিষ্ঠুর আগ্রাসনের বিরুদ্ধে শান্তিবাদী মানুষের প্রবল প্রতিবাদ। শ্রেণীশোষণ ও ঔপনিবেশিক দাসত্ব থেকে মুক্তির উপায় আশা করেছেন।
৭ নভেম্বর কবিতায় কবি উচ্চারণ করেন;


‘সেই তিক্ত বঞ্চনার,বাণিজ্যলক্ষ্মীর রক্তাতুর
সাম্রাজ্যের অভিসার ধূলিস্মাৎ প্রাণের বিপ্লবে।
স্বাধিকারে মুক্তি আজ,ন্যায়যুক্তি-প্রতিষ্ঠ জীবন’।


      ‘নাগরিক বৈদগ্ধের বিপরীতে তিনি এঁকেছেন সুস্থ জীবনের ছবি। তার প্রগতিচেতনার মূলে বিকশিত হয় সাধারণ মানুষের জয়গান ও সমাজচেতনার নিবিড় ধারাপাত যা সন্দীপের চর কবিতায় প্রাণস্রোতস্বিনী নদীর প্রতীকে উপস্থাপন করেন। তিনি কবিতার খাল কেটে দেশ-বিদেশের জলস্রোতের মিশ্রণে মানবমৈত্রীর বোধ রচনা করেন। সাম্যের সংগীত সত্য করতে গিয়ে কট্টর মার্কসবাদীদের সঙ্গে আদর্শিক সংঘাতে জড়িয়ে পড়লেও তিনি শ্রেণীচেতনার আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি’।
বৈকালিক কবিতায় কবি লিখেন;
‘ফিরে যাই সাথে লয়ে মৃত্যুহীন প্রাণ
দূর থেকে ভেসে আসে ভাঙাসুরে বেকসুর গান
তবু চলে বুঝি বীর নয়,শুধু
লাখো কৃষাণ
ধূসর আকাশে দুর্মর শিরে
ওড়ে নিশান
বহু বঞ্চনা বহু অনাচারে
অমর প্রাণ
বীরদল চলে হাজারো মজুর
লাখো কৃষাণ’।


      ‘তাঁর কবিতায় স্তবক পরম্পরায় আপাত-সম্পর্কহীন বিন্যাস ও বিমূর্ততা আধুনিক কবিতার এক অনিবার্য শিল্পফসল হিসেবে চিহ্নিত। তার প্রথম দিকের কবিতা সন্দীপের চর এবং উর্বশী ও আর্টেমিস গ্রন্থের কবিতায় ফরাসি প্রতীকবাদ আশ্রিত প্রবণতা বিশেষভাবে লক্ষণীয়। যা টিএস এলিয়টের কবিতার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। ইংরেজি সাহিত্যের সঙ্গে ফরাসি প্রতীকবাদের সম্পর্কের যোগসূত্র স্থাপন করেছিলেন আর্থার সায়মন্স। দ্য সিম্বলিস্ট মুভমেন্ট ইন লিটারেচার গ্রন্থে সায়মন্স মালার্মে প্রচলিত শব্দের কাম্য বিকল্প এবং মূল অর্থ থেকে দূরে সরে যাওয়া শব্দরাশির উপর্যুপরি বিন্যাস-এর কথা বলেন। কবিতার প্রতিপাদ্য ও অর্থ খুঁজতে থাকা পাঠকের হতবুদ্ধি হয়ে পড়ার কারণ হিসেবে তিনি এ দুটি প্রবণতার উল্লেখ করেন। বিষ্ণু দের উর্বশী ও আর্টেমিস-এ পরম্পরাহীন স্তবক বিন্যাস যে মালার্মে এবং এলিয়টের পংক্তি বিন্যাস প্রভাবিত এ কথা বলা অসঙ্গত হয় না। তবে মার্কসীয় দর্শন গ্রহণের পর তিনি ধীরে ধীরে স্বাদেশিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে কাব্যসৌধ নির্মাণ করেন। কবি বিষ্ণু দের কাব্যাদর্শ থেকে বামপন্থী রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মীরা গভীর প্রেরণা ও সমর্থন লাভ করেছেন বলেও ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়। বিদেশী সাহিত্যের বিপুল পাঠে বিষ্ণু দের মানসলোক পরিশীলিত। ফলে এলিয়ট ও এজরা পাউন্ডের কাব্যচিত্রকল্প ও বাক্যবিন্যাসের সংহতিও তার কাব্যজগতে ব্যাপক প্রভাবসঞ্চারী। কবিতায় তার দর্শন এবং শব্দ ব্যবহারে এক ধরনের ঋজুতা ও দৃঢ়তা দীক্ষিত পাঠককে টানে”।

       কবি বিষ্ণু দে’র একটি ছোট্ট কবিতা আমার খুউব প্রিয়, কবিতাটির নাম ‘সে কবে’ । এই কবিতায়ও এক অতীত স্মৃতির বিনম্র বেদনাকে অতি নিপুণতার সাথে উপস্থাপন করা হয়েছে । কবিতাটি আসরে আগ্রহী পাঠকদের জন্যে তুলে দিলাম;

কবি বিষ্ণু দে’র কবিতা
সে কবে

সে কবে গেয়েছি আমি তোমার কীর্তনে
কৃতার্থ দোহার ।
পদাবলী ধুয়ে গেছে অনেক শ্রাবণে ;
স্মৃতি আছে তার ।
রৌদ্র-জলে সেই-স্মৃতি মরে না, আয়ু যে
দুরন্ত লোহার ।
শুধু লেগে আছে মনে ব্যথার স্নায়ুতে
মরচের বাহার  ।
                                                                                                  (চলবে)