************
-             মধ্যাহ্নের গরমে আর হাঁটা যাচ্ছে না । বুকের ভেতর তৃষ্ণার পারদ উত্তুঙ্গে । হাতের জলের বোতল কবেই শেষ হয়ে গেছে । আশেপাশে কোন জল বিক্রেতাও দেখা যাচ্ছে না যে জল নেয়া যাবে ।ছোট মেয়েটার গ্রীষ্মের ছুটি প্রায় শেষের দিকে । দেখতে দেখতে দুই মাস পার হয়ে গেলো !

               মেয়েটার আব্দারে সেন্ট্রাল পার্কে বেড়াতে আসা । মেয়েটার মুখও গরমে লাল হয়ে গেছে । সারা সকাল কেটেছে পার্কের ছোট্ট চিড়িয়াখানায় । সীল মাছের নাচ দেখে সেকী আনন্দ মেয়েটির । মেয়ের আলোকিত মুখের দিকে তাকাতে বেশ লাগে রবি শর্মার । হয়তো সব বাবারই লাগে ।


              এমন সময়ে সেখানে এসে দাঁড়ালো একটি বর্ণীল রিক্সা । রিক্সার ড্রাইভার একজন সাদা যুবক । হয়তো কোন কলেজের ছাত্র । সামারের বন্ধে কিছু হাতখরচের টাকা রোজগারে নেমেছে । কাছে এসেই অনুনয় করে বললে, - তোমাদের খুউব কাহিল দেখাচ্ছে -ঊঠবে নাকি আমার পঙ্খীরাজে ? ছেলেটির চেহারার দিকে তাকিয়ে মায়া হলো রবি শর্মার ।


             মেয়েকে নিয়ে উঠে পড়লো বর্ণময় এই রিক্সায় । দেশে থাকতে সে সহজে রিক্সায় চড়তো না, কেমন যেন অপরাধবোধ হতো । লিকলিকে চেহারার হাড়গিলে মানুষগুলোর টেনে নিয়ে যাওয়া রিক্সায় কিছুতেই উঠতে মন সায় দিতো না । এত্তো বছর পরে উত্তর আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরের এই বিখ্যাত সেন্ট্রাল পার্কে রিক্সায় চড়তে চড়তে মনে হল - বাহ - বেশ লাগছে তো !


           পার্কের ভিতরে বেশ কিছুক্ষণ ঘুরে ছেলেটি রিক্সা নিয়ে চলে এলো হ্রদের কাছে । ফুলে ফুলে ছেয়ে আছে এই হ্রদের পাড় । হ্রদের এদিক থেকে নিউইয়র্ক এর ম্যানহাটন শহরের সৌন্দর্য্য দেখার মতই । পার্কের কাছে এসেই ছেলেটি থেমে মুখটা মুছলো - ঘেমে একসা হয়ে গেছে । কাছে জল বিক্রেতার কাছ থেকে রবি শর্মা তিনটে বরফে ডোবা জলের বোতল কিনে নিল - ছেলেটির হাতেও দিল একটি । ছেলেটির মুখ আলোকিত হয়ে গেলো । দেখে রবি'র আবারো মন ভরে গেলো ।


               ছেলেটিকে ভাড়া মিটিয়ে দিতে দিতে আলাপ শুরু করল রবি । ছেলেটির নাম রবার্তো । ছেলেটির জন্ম  আমেরিকার উপশহর - পুয়ের্তেরিকোতে । এখানে নিউইয়র্ক এর একটি বিখ্যাত কলেজে মেডিকেলের ৩য় বর্ষের ছাত্র । সারা সামার সে একটা শিফট রিক্সা চালিয়ে যা আয় করেছে তার অধিকাংশ খরচ হবে তার কলেজের টিউশন ফি দিতেই ।


                 অকস্মাৎ রবি শর্মাকে অবাক করে দিয়ে রবার্তো রিক্সার হ্যাণ্ডেলে ঝোলানো ব্যাগ হতে বের করে আনলো একটি বাঁশের বাঁশী । তারপর সে বললে - তুমি নিশ্চয়ই চেনো এই বাদ্যযন্ত্রটি  !  হ্যাঁ- চিনি বৈকি - ছোট্টবেলায় কত বাজিয়েছি ! বলতে বলতে রবির মনে পড়ে গেলো সেই ছোট্টবেলার কথা -- বাবা কিনে দিতেন চড়কমেলা থেকে । সে কত হাজার বছর যেনো আগে ! আজ বাবা কোথায় - কোথার সেই বাঁশের বাঁশী !


                   রবার্তো ততক্ষণে বাজাতে শুরু করেছে বাঁশী রিক্সায় বসে - আর রবি শর্মা  মেয়েকে নিয়ে বসে পড়েছে পার্কের বেঞ্চিতে ।
রবার্তো একমনে বাজিয়ে চলেছে - পুরনো একটি জাজ সুর -
-----------------------------------
THE SWINGIN' SHEPHERD BLUES
-----------------------------------
Along the mountain pass
There is a patch of grass
Where the swingin' shepherd plays a tune
His sheep never stray
Dancin' all day
Until they see the palin' yellow moon
And then he leads his flock
And homeward they all rock
To the tune of the swingin' shepherd blues
---------------
                  রবি শর্মা যেন হারিয়ে গেছে সে কোন সুরের অতলে । অনেকক্ষণ পরে বাঁশীর সুর বন্ধ হতেই চোখ খুলে দেখে -- তার নিজের ও ছেলেটির চোখ বেয়ে জলের ধারা --  আশেপাশে অনেক পর্যটক ওকে ঘিরে ধরেছে -- আর একনাগাড়ে হাততালি দিয়ে চলেছে  ।  রবি শর্মা ছেলেটির হাতে একটি একশ ডলারের নোট গুঁজে দিয়ে মেয়েকে নিয়ে সরে পড়লো । রবি জানে - ছেলেটি অবাক হয়ে তার হাতের একশ ডলারের নোটের দিকে তাকিয়ে আছে -- কিন্তু ছেলেটি জানে না - সে রবিকে কী অমূল্য মধুর কিছু এনে দিয়েছে এতক্ষণ - -তার হারানো শৈশব ! এই পাওয়ার কাছে একশ ডলারের নোটতো কিছুই না । রবি শর্মা তার ফিরে পাওয়া শৈশব বুকে করে পায়ে পায়ে বাড়ীর দিকে হাঁটতে লাগলো । কানে বেজে চলেছে সেই বাঁশীর সুর --।


                                 ---০---