আবৃত্তি বর্তমানে এক জনপ্রিয় শিল্পের নাম।আবৃত্তির চর্চা গ্রাম থেকে শহরে,বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে,ইলেকট্রনিক সোসাল মিডিয়ার মাধ্যমে দিন দিন বেড়েই চলেছে।কবিতাকে লোকপ্রিয় করার ক্ষেত্রে আবৃত্তির অবদান অনঃস্বীকার্য।


আবৃত্তি শব্দের বুৎপত্তিগত অর্থ বারংবার পাঠ।সম্যকভাবে বা সর্বোতভাবে সাহিত্য বা কবিতা পাঠ বা উচ্চারণ করাই আবৃত্তি ।সহজভাবে বললে, কবিতার ভাব,ছন্দ,তাল,লয় ও শব্দের উচ্চারণ সঠিক রেখে শ্রুতিমধুর ভাবে কবিতাকে প্রকাশ করাকে আবৃত্তি বলে।আবৃত্তি এক শিল্প বা কলা।চৌষট্টি কলার মধ্যে অন্যতম একটি।বলা হয়,আবৃত্তি সর্ব শাস্ত্রানাং বোধাদপি গরিয়সী।


স্মরণাতীত কাল থেকে,বোধ করি কবিতা সৃষ্টির সময় থেকে আবৃত্তি সমাদৃত হয়ে আসছে।বৈদিক ঋষিরা বেদমন্ত্র আবৃত্তি করতেন।সে আবৃত্তিতে নির্দিষ্ট ছন্দ ছিল,স্বরের নির্দিষ্ট ওঠাপড়া ছিল। পবিত্র কোরআনেও তারতিল অর্থাৎ আবৃত্তির মতো থেমে থেমে কোরানকে পড়তে বলা হয়েছে । বাংলা ভাষায় আবৃত্তির নবতর প্রকাশ ঘটে বিশ শতকের গোড়ার দিকে।এতকাল বাংলায় আবৃত্তি বলতে যা বোঝানো হত,তা হল পাঁচালী,পুঁথি,ধর্মগ্রন্থ বা রূপকথা ইত্যাদির সুরেলা পাঠ।রবীন্দ্র কবিতার আবৃত্তি দিয়ে মূলত: আধুনিক আবৃত্তি চর্চার সূচনা।আর শিশির কুমার ভাদুড়ি ছিলেন আধুনিক আবৃত্তির প্রথম পথিকৃৎ।মধুসূদন দত্ত,গিরিশচন্দ্র ঘোষ আবৃত্তি পছন্দ করতেন।স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ বা নজরুলের আবৃত্তি আমরা সবাই শুনেছি।কাজী সব্যসাচী,শম্ভু মিত্র, অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আবৃত্তি ইতিহাস হয়ে আছে।আবৃত্তিকে জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে বেতার এবং দূরদর্শন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে।


হীরেন চট্টৌপাধ্যায়ের মতে আবৃত্তিতে উচ্চারণই আসল কথা।যেমন,বাংলা হরফে আমরা লিখি 'অতি" কিন্তু পড়ি 'ওতি'।আবার যদি লিখি 'আহ্বান" ঊচ্চারণ করতে হবে 'আওভান'।যখন লিখি 'দুঃসাহস' পড়তে হবে 'দুস্ সাহস'লেখা আছে 'স্বপন' পড়তে হবে  'স্বপোন'।তেমনই 'জনগন' উচ্চারণে হবে 'জনোগণ্','গণসংগীত' হবে 'গণোসংগীত'।আরেক গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি শব্দ 'বিক্রয়" 'অপ্রিয় ''অভিনেত্রী' প্রভৃতি; আমরা উচ্চারণ করব 'বিক্ ক্রয়','অপ্ প্রিয়',''অভিনেত্ ত্রী'।অনেকের কাছে ই কার আর ও কার বেশ ঝামেলার।ধরা যাক,লেখা আছে 'কোনদিনই' বা 'ঠিকঠিকই',এদের উচ্চারণে চোখ নয়,কানকে বেশি বিশ্বাস করতে হবে।পড়তে হবে 'কোনদিনি' বা 'ঠিকঠিকি'।


কবিতা পাঠ আর আবৃত্তি কিন্তু এক নয়।কবি কবিতা রচনা করেন।কেউ তা পাঠ করেন।আর আবৃত্তিকার তা পরিবেশন করেন।বলা যেতে পারে,তার সুচারু পরিবেশনায় আবৃত্তিকার কবিতায় প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেন। আবৃত্তিতে কন্ঠস্বর, বাচনভঙ্গি ও প্রকাশ ভঙ্গির সুচারু প্রয়োগ খুব জরুরী।শুধু আবৃত্তি করলেই হবে না,ছন্দের ব্যাপারটি বুঝে নিতে হবে।ভাব ও কলাকে ছন্দের মধ্যে জাগিয়ে তুলতে হবে।আবৃত্তি সুস্পষ্ট ও প্রমাদশূণ্য হতে হবে।কবিতা আবৃত্তির সময় অঙ্গভঙ্গি বাড়াবাড়ি বা উচ্চারণের অতি নাটকীয়তা বাঞ্ছনীয় নয়।তবে কি আবৃত্তি শিখতে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা পেতেই হয় ? মনে রাখতে হবে ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায় সে অর্থে কোন ক্লাসরুম প্রডাক্ট ছিলেন না।


অনেকে ভাবেন,গলার স্বর জোরালো হলে,কন্ঠস্বর ইচ্ছামত ওঠানো- নামানো গেলেই ভাল আবৃত্তিকার হওয়া যায় ।এসব গুণ থাকলে ভাল,তবে আবশ্যক নয়।সবার আগে দরকার কবিতাটিকে ভালোবাসা।কবিতাটিকে বোঝা।কবিতাটিকে ভালো করে নিজের মধ্যে ঢুকিয়ে নেওয়া।নইলে কবিতার যে পালস্ অর্থাৎ প্রাণই অধরা রয়ে যাবে।


স্মৃতি থেকে বলা আবৃত্তির আরেক প্রাথমিক শর্ত।কবিতাকে বারবার পড়তে হয় ।কবিতার সাথে বসবাস করতে হয়।কবিতার চিত্রকল্পগুলিকে মানসচক্ষে দেখতে হয় ।তখন আর কবিতাকে চেষ্টা করে মনে রাখার দরকার হয় না। তাছাড়া জোরে জোরে কবিতা পড়া অভ্যাস করলে কন্ঠস্বরের জড়তা দূর হয় এবং জিহ্বা সঞ্চালনে স্বচ্ছন্দ আসে।


এরপর,আবৃত্তিযোগ্য কবিতা বেছে নেওয়ার ব্যপারটি। যদিও প্রদীপ ঘোষ বলেছেন,যে কোন কবিতাই আবৃত্তিযোগ্য,তথাপি আপনি কোন সময়ে,কোন অনুষ্ঠানে কি ধরনের কবিতা পড়বেন,আপনার বাছাই করা কবিতার সঙ্গে চারপাশে যা ঘটছে তার যোগ আছে কিনা সেগুলি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ।কবিরা কবিতায় যে ছবি আঁকেন আবৃত্তিকারেরা যদি তাতে সার্থকভাবে রঙ্ দিতে পারেন তবেই তা মঞ্চসফল প্রযোজনা হতে পারে। উদাহরন হিসেবে বলব,আমাদের আসরের প্রিয় কবি আর্যতীর্থর  'বিকর্ণ' কবিতাটি, যেটি বর্তমানে খুবই প্রিয় সফল আবৃত্তিকারেদের কাছে।কবিতা পড়লে বোঝা যায়, কেবল ছন্দ,শব্দ গাম্ভীর্য দিয়ে মহাভারতের একখণ্ড ছবিই সেখানে ফুটে ওঠেনি,একটি সার্বজনীন বক্তব্য বা মেসেজ সেখানে উঠে এসেছে। আবার বয়স অনুযায়ী কবিতা বাছাই একটি জরুরী বিষয়।বড়রা যে কবিতা আবৃত্তি করবেন,বাচ্চারা নিশ্চয়ই তা করবেন না।


আবৃত্তি যখন এক মঞ্চ উপস্থাপনা,তা একক হতে পারে,বৃন্দ সহযোগী সহকারে হতে পারে। আবহ ব্যবহার করতে পারেন।আলোর সাহায্য নেওয়া যেতে পারে। যে মাইক্রোফোনটি ব্যবহার করছেন,তার ঠিক কোন জায়গায় দাঁড়ালে আপনার গলাটি ঠিকমতো পৌঁছুবে,মঞ্চে কিভাবে দাঁড়াবেন,হাত কোথায় রাখবেন,সাজ পোশাক কেমন হবে,কি ভাবে প্রবেশ করবেন,কিভাবে প্রস্থান করবেন সব খুঁটিনাটির দিকে  আপনাকে নজর রাখতে হবে।মনে রাখতে হবে এই টোটালিটিটা নিয়েই আবৃত্তির সাফল্য।


এখন আবৃত্তি করব কেন ? সবাই কি পেশাদার আবৃত্তিকার হব? তা নয়।আবৃত্তি চর্চা আমাদের কবিতাকে ভালোবাসতে শেখায়, আমাদের নান্দনিক আনন্দ দান করে,আমাদের বাচনভঙ্গি সুন্দর করে,আমাদের কথাকে সুন্দর করে মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়।আবৃত্তি আমাদের আত্মবিশ্বাস বাড়ায়। অনেক ডাক্তারের কাছে গেলে আমাদের মনে হয় না,যেন কথাতেই অর্ধেক রোগ সেরে গেল!আজকের মতো অহেতুক তর্ক- বিতর্কের যুগে এটুকু ক্ষত  প্রশমনের মূল্যই বা কম কি !



ঋণ:
ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায়,প্রণতি ঠাকুর ও হান্নান আহসানের লেখা ও বক্তৃতা।