নীল স্থির জলে আজ ধ্যানস্থ  আমি,
এক অপেক্ষমান আশ্রয়প্রার্থী ।
আমি – দুর্যোধন ।
যুবরাজ ওই হস্তিনাপুরের ,
যুবরাজ ওই  সমৃদ্ধতম রাজ্যের , এই  আরযভূমির ।
আত্মগোপনকারী আমি আজ এই দ্বৈপায়নের নীচে ,
নিজের গান্ধারী-মাকে করা প্রতিশ্রুতির জন্য শুধুমাত্র ।
মাত্র সতেরোদিনের সময়ের অতলে
সমাধিপ্রাপ্ত ওই ঐতিহাসিক সমৃদ্ধির ।
অথবা ঠিক সমাধি নয় , জীবন্ত দগ্ধপ্রাপ্ত বিশেষণই যথার্থ হয়ত ।
এই যুদ্ধে কি শুধুই তলিয়েছে সমৃদ্ধি ?
আমার নিজস্ব সৈন্য-সমান নিরানব্বই ভাই,
স্নেহশীল ও তীব্র বুদ্ধিমান মামা
আর আমার বন্ধু কর্ণ !!!
ভীশ্ম-দ্রোণ তো আর ব্যক্তিগত ক্ষতি নয় আমার ,
তবে হস্তিনাপুরের শক্তির অহংকারের হানি অব্যশই ।
কিন্তু পাণ্ডবদের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট
ওই দুই ব্যক্তির শোকে শোকাহত হইনি কক্ষনও ।
অসহায় ছিলেন তারা,  মামা শকুনির বুদ্ধির বাজিতে ।
আর শুধুমাত্র সে জন্যই  রক্তপাত করেছিলেন  যুদ্ধে কৌরবপক্ষে ।
শুধুই কী ভীশ্ম, দ্রোণ ও কর্ণ !!!
আরও কত সহস্র কুশীলব যোদ্ধা এই আরযভূমির ......
দ্বারকার অপরাজেয় নারায়নী সেনার অংশগ্রহণ সত্ত্বেও,  
আজ কুরুপক্ষে জীবীত কেবলমাত্র আমি !!!
তাও আত্মগোপনকারী এক নপুংসকের মত ।


দ্বৈপায়নের হ্রদের ওপর  থেকে নীল আকাশের রং
এত গভীরে এসেও পড়ছে  ।
হ্রদের পার্শ্বভূমিতে কোথাও পাখির কলতান শোনা যায় ।
অপার্থিব , বড় শান্তির পরিবেশ এখানে ।
এখানে নেই কোনও যুদ্ধের হাহাকার ,
নেই কোনও রক্তপাত , নেই কোনও সাম্রাজ্যলিপ্সা ।
মহাযুদ্ধ শেষে ক্লান্ত-শোকার্ত-নিঃস্ব আমি ।
রাজ্য চাই না আর ।
ইন্দপ্রস্থ পাণ্ডবদের থাক – হস্তিনাপুরও থাক তাদেরই ।
উত্তরাধিকারে প্রাপ্ত সাম্রাজ্যের  সর্বময় আধিপত্যের
স্বপ্ন দেখেছি আমি , আশৈশব । কোনও অপরাধ কি তা ?
স্বপ্নপূরণের রাস্তাতে কখনও কূটনীতী, কখনও শক্তির মাধ্যম নিয়েছি আমি ,
কিন্তু ক্ষত্রিয়ধর্ম থেকে বিচ্যুত হইনি কক্ষনো –
প্রবঞ্চক পাণ্ডব ও তাদের মিত্র কৃষ্ণের মত ।
শুধু গ্লানি আছে দুই ভূলের - পাণ্ডবদের সাথে তাদের মাকে হত্যার চেষ্টা
আর রাজসভায় এক নারীর বস্ত্রহরণ – যা প্রায় ধর্ষণের সামিল ।
যদিও প্রথম অপরাধের ভাগী আমি একা হলেও ,
দ্বিতীয় দোষে দোষী সমস্ত সভাসদবৃন্দ ।
তবুও প্রায়শ্চিত্ত করতে চাই আমি এই অপরাধের ,
রাজ্য ত্যাগ করে সন্ন্যাস নিয়ে ।
কিন্তু প্রতিশোধ চাই তার আগে,
পাণ্ডবদের , বিশেষত কৃষ্ণের থেকে ।
কৌরব - পাণ্ডব দ্বৈরথের কারণে পাণ্ডব ক্ষমাযোগ্য হলেও
কৃষ্ণ যে ক্ষমাহীন !!!  যে যুদ্ধের শেষ-প্রহরেও
এক ছেলেকে বঞ্চিত করে -
তার মায়ের জীবনভর আশীর্বাদ থেকে, যুদ্ধে নিরঙ্কুশ জয়ের জন্য । সে কি ক্ষমাযোগ্য কখনও ?
তাই আমি অপেক্ষমাণ এই দ্বৈপায়নের তীরে ,
আর এক বন্ধু অশ্বত্থামার জন্য ।
তার আগমনের পর , প্র
তিশোধস্পৃহা শান্ত হবার পর সন্ন্যাস নেব আমি ।
যুদ্ধে পরাজয় জেনেও পিছপা হইনি আমি ।
বিজয়ীর নিনাদের গর্জনে  কৌরবসেনার পরাক্রমণ ছিল অপার্থিব ।
তবুও পরাজয়ী জীবিত যোদ্ধা আমি, কাপুরুষ নই ।
সময়ের জয়তিলক আমার নয় ,
কিন্তু প্রতিশোধসংবাদ পূর্বে মৃত্যু যেন না হয় আমার ।
এ দৃঢ় অঙ্গীকার এক ক্ষত্রিয়ের ।



দূরে পাখির কলতান বন্ধ এখন ।
আকাশের আলোকময়তা অপস্রিয়মাণ হয়ে
সূর্যের লাল রশ্মির মায়াতে ঢেকেছে চরাচর –
গোধূলির আগমনবার্তা নিয়ে ।
দ্বৈপায়নের তীরে শোনা যায় অশ্বের শব্দ, মানুষের কোলাহল ।
দেখতে পাচ্ছি আমি জলের প্রতিচ্ছবিতে –
দ্বৈপায়নের তীরে পাণ্ডব ও কৃষ্ণের ।
গুপ্তচরের মাধ্যমে সংবাদ পাওয়া ইস্তক,
পৌঁছে গেছে দ্বৈপায়নের – আমাকে হত্যার পরিকল্পনা নিয়ে ।
ভীমসেনের যুদ্ধ- আহ্বান , কৃষ্ণ ও যুধিষ্ঠিরের বক্রোক্তি
শুনতে পাচ্ছি আমি ।
আমার ক্ষত্রিয়ধর্ম – সাহসের বিদ্রূপ করছে এই প্রবঞ্চকের দল ।
অসহ্য এই পরিহাস ।
জানি এই দন্দের পরিণতি ।
এখনো মনে আছে জরাসন্ধের পরিণতি ।
তা ছিল না ভীমসেনের শক্তির কাছে, বরং কৃষ্ণের ধূর্ততার কাছে ।
এই আহবানে সাড়া দিতেই হবে আজ ,
যদিও ঊরুভঙ্গম ই পরিণতি আজ ।
এখনও নির্লজ্জের মত চলছে তাদের প্রলাপ ।
আমার অসহায়তাকে ছেড়ে যাচ্ছি আমি ।
ক্ষমা করো মা আমার ।
আজ তোমার প্রতিশ্রুতিকে করলে মর্যাদা ,
নিজের পুরুষকারকে হারাব আমি নিজের কাছে ।
সেই গ্লানি যাবে না কিছুতেই ।
তার চেয়ে এই ভাল ।
সময়ই করবে বিচার দুর্যোধনের – এই অধমের ।
হে দ্বৈপায়ন !! বিদায় তোমাকে চিরতরে ।
শেষবেলায় শান্তির নীড় দিয়েছ আমায়, ক্ষণিকের হলেও ।
আমার মৃত্যু হবে তোমারি তীরে,
তোমাকে এ প্রতিশ্রুতি আমার ।
শেষবারের মতন তোমাকে জানাই বিদায়,
করি জোড়হস্তে আমার শেষ নমস্কার ।