বৈশাখ মাস, ধানের শীষে যেন সোনা ধরেছে, আব্বার মুখে কী-যে হাসি!
তপ্ত রোদে আব্বা যাচ্ছেন ধান কাটতে। বললাম আব্বা আমিও যাবো।
আদর করে বললেন, না বাবা খুব গরম পড়েছে তুমি অসুস্থ হয়ে পড়বে।
একদিন পরেই শুরু হলো কাল-বৈশাখী ঝড় আর বাদল, দুদিন হয়ে গেলো বৃষ্টি থামার কোনো আভাস নেই! ওদিকে পাহাড়ি ঢল নামার আশংকা। এদিকে আবার বৃষ্টির পানি জমে ধানের ছুঁইছুঁই অবস্থা!
আব্বা বললেন আর অপেক্ষা করা যাবে না, যে করেই হোক ধান কাটতে হবে। নতুবা বৃষ্টির জল আর পাহাড়ি ঢলে ধানগুলো তলিয়ে যাবে।
মুশল ধারায় বৃষ্টি হচ্ছে, আব্বা মাথায় একটা পলিথিনের ব্যাগ প্যাঁচিয়ে কাস্তে হাতে নিয়ে বের হবেন, এমন সময় আমি বললাম আব্বা আমিও যাবো, আব্বা আবারও মায়াভরা গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, না বাবা তোমার ঠাণ্ডা লেগে যাবে।
আমি কিছুটা মন খারাপ করে বসে ভাবতে লাগলাম, গরমে আব্বা ধান কাটেন অসুস্থ হোন না, বৃষ্টি বাদলে আব্বা ধান কাটেন ঠাণ্ডা লাগে না। কিন্তু কেন?
এলাকার রাস্তায় মাটি ভরাটের কাজে আব্বা কাজ করছেন। একটু দূরে তাই টিফিন বক্সে করে দুপুরের খাবার নিয়ে যান। একদিন খরচের অভাবে সকালে পান্তাভাত খেয়ে দুপুরের খাবার না নিয়েই চলে গেছেন কাজে। ঐ দিন চেয়ারম্যান সাহেব কাজ পরিদর্শনে এসেছিলেন। সাথে করে সবার জন্য কেক এনেছেন। সবাইকে একটা একটা করে ৩টাকা দামের কেক দেয়া হয়েছে। আব্বা সেই কেকটা বাড়ি নিয়ে আসলেন। আম্মার হাতে দিয়ে বললেন, ঘরে খরচ নেই, ছেলেটা কী খেয়েছে না খেয়েছে, কেকটা তাকে দাও।
আম্মা আমাকে কেকটা দিলেন। আমি কেক খেতে খেতে ভাবলাম, আব্বা দুপুরে না খেয়ে সারাদিন মাটিকাটার মতো পরিশ্রমের কাজ করেও ক্ষুধা লাগলো না, কেকটা আমাকে দিয়ে দিলেন! আচ্ছা আব্বাদের কি ক্ষুধা নাই?
ঈদুল ফিতরের আর মাত্র ক'দিন বাকি, আব্বার মনে একটাই তোরজোর আমাকে নতুন জামা দিবেন। আমারও মনে কী দারুণ উচ্ছ্বাস, ঈদে নতুন জামা পরবো। ঈদের আগের রাতে আব্বা নতুন পোশাক আনলেন। আমার আনন্দ কে দেখে! রাতে বালিশের পাশে নতুন জামা রেখে ঘুমিয়েছি, সকালে আমার ঘুম ভাঙানো হলো। আব্বার সাথে পুকুর থেকে গোসল করে আসলাম, আম্মা খুব আদর করে তেল মাখিয়ে নতুন জামা পরালেন। আমি তো মহা খুশি।
আমার নতুন জামা পড়ার সমবয়সী বাচ্চাদের দেখাতে বেড়িয়ে পড়লাম, কিছুক্ষণ পর আব্বা ডাক দিলেন ঈদের জামাতের সময় হয়ে যাচ্ছে আব্বার সাথে মসজিদে যাবো। আব্বার সাথে মসজিদে গেলাম। হঠাৎ আমার চোখ পড়লো আব্বার পোশাকের দিকে, তিনি পুরাতনের মধ্যে একটু ভালো যে লুঙ্গি আর শার্ট ওগুলোই পরেছেন। আব্বাকে জিজ্ঞেস করলাম, আব্বা আপনি নতুন পোষাক আনেননি? আব্বা জবাবে বললেন, বাবা এটা তো এখনো পুরাতন হয়নি, তাই আর নতুন পোষাক আনিনি।
মনে মনে ভাবলাম, আব্বাদের কি নতুন পোষাক লাগে না? নাকি আব্বাদের পোষাক পুরাতন হয় না?
মাঝেমধ্যে ইচ্ছে হতো যদি আল্লাহকে সরাসরি পেতাম, তাহলে জিজ্ঞেস করতাম 'ও আল্লাহ, আপনি আব্বাদের কী ধাতু দিয়ে বানিয়েছেন'?