ছোট বেলায় একবার
হাত ঘড়ির জন্য করেছিলাম আবদার
ঘড়ি আছে ক্লাসের সবার
শুধু নেই যে আমার
সেদিন মা বলেছিলো, তোর বাবা দিবে কিনে
বাবা কিনে দিতে পারেনি,
তবুও আমি কাঁদিনি।

শত ঝড় তুফান ভেসে ভেসে
হেঁসে খেলে কেটে যেতে লাগল সংগ্রামী জীবন,
ঘন কালো মেঘ কাটেনি তখন
জীবনে এল ঘুর্নিঝড় ঘোর অন্ধকার
বাবা চলে গেলেন আমাদের এতিম করে।
এক পৃথিবী 'কষ্ট' হাহাকার জীবনটা
তছনছ করে দিলো।
তারপর, পেয়েছি কত অবহেলা,
কত ঘৃণা, কত তিরস্কার,
কত ক্ষুধার জ্বালা, কত দুঃখ যাতনা পুরস্কার
তার হিসেব রাখাটা সম্ভব হয়নি।
বেঁচে থেকেও রোজ মরেছি, কেউ দেখেনি
তবুও কাঁদতে পারিনি।

অসহায় হয়ে ঘুরেছি পৃথিবীর দ্বারে দ্বারে
কত স্বপ্ন ডুবেছে হেলায় অবেলায় হাহাকারে
কেউ দেখেনি, খোঁজও রাখেনি
অপ্ৰসন্ন মনে আকাশের পানে চেয়ে
কত কি চেয়েছি তার কাছে
কত খুঁজেছি এক বিন্দু সুখ দুর্গম পথে পথে
হ্যাঁ, অগ্রজ সাহস জুগিয়েছিল বুকে
ধুঁকে ধুঁকে মরিনি তাই
তার স্বপ্নের সমাধিতে বেঁচেছিল সংসার
অনেক খুঁজেও চাকরি মেলেনি
শুনেছি শহরের পথে-
ইটের বিছানায় কেটেছে রাত
শুনে কষ্ট পেয়েছি, এই নিষ্ঠুর আমি
তবুও কাঁদিনি।

মাধ্যমিক পরীক্ষার ঠিক কিছু দিন আগে
পড়া লেখায় ব্যস্ত সবে রাত জেগে জেগে
একদিন মা বললো নিচু স্বরে
হারিকেন খালি, বাবা! তেল নেই ঘরে
বারবার বলতাম তেলের কথা
শুধুই মা'কে দিয়েছি ব্যথা
সে'সব রাতে পড়ার সুযোগ হয়নি
তবুও কিন্তু কাঁদিনি।

রেজাল্ট প্রকাশ হওয়ার পরে
হাঁসি-কান্না যখন ঘরে ঘরে
আমি সে'বার এ প্লাস পেয়েছি,
ঘটা করে বাড়িতে এসে সবাইকে বলছি,
যারা এমন খুশির খবর নিয়ে বাড়িতে গেল
সবাই কত দামি দামি গিফট পেল
আমার বেলায়, মিষ্টি মুখও জোটেনি,
তবুও আমি কাঁদিনি।

ভেবেছিলাম একটা ভালো কলেজে ভর্তি হবো
এই আশা বুকে নিয়ে কত যে আনন্দ আমার!
এক বুক স্বপ্ন নিয়ে ভাইয়াকে বলেছি,
সেদিন দেখেছি তার অসহায় চোখ আর....
আমার থেকে খারাপ রেজাল্ট নিয়ে
গ্রামের হাবা ছেলেটাও ভর্তি সেখানে গিয়ে
হতভাগ্য আমার, সে কপাল হয়নি
তবুও কিন্তু কাঁদিনি।

একটা কলেজে ভর্তি হলাম কোন মতে,
যেখানে সব কিছু ফ্রি, উপবৃত্তিও পাব সাথে
বেশ খুশি হয়েছিলাম
হটাৎ সময় এলো বনভোজনের
সবার কত আনন্দ
অথচ আমার বুক শুকিয়ে গেল
মনে হলো পুরো পৃথিবী আমার বুকে ভর করেছে
চাঁদা দিতে হবে যে এবার
খুব ভেবে সাহস করে মাকে বলেছি
মায়ের কাঁদো গলায় বকুনি খেয়েছি
ক্লাসে সবার সামনে মাথা নিচু করে থেকেছি
সেদিন চাঁদা দিতে পারিনি
তবুও আমি কাঁদিনি।

ক্যাম্পাসে আড্ডা দিত সবাই মিলে,
আমাকে দেখে বলতো, ঐযে একঘেয়ে ছেলেটা
মাথা নিচু করে, চুপচাপ হেটে যেতাম
আর মনে মনে ভাবতাম
দামি-দামি পোশাক নেই আমার
বিল দিতে পারিনা ঝালমুড়ি, ফুচকার
তাই হয়তো কেউ বন্ধু হয়নি
তবুও আমি কাঁদিনি।

উচ্চ মাধ্যমিক দিব সেবার
খুব শখ হয়েছিল শহরে থেকে পরীক্ষা দে'য়ার
শহরে থেকে পরীক্ষা দিতে কত ভালো
আছে গাড়ি-ঘোড়া, বিদ্যুতের আলো
পুরো ব্যাপারটাই আলাদা
গ্রাম থেকে আমি শহরের বাটে
যেতাম পায়ে হেঁটে হেঁটে
সবার ঠাঁই হল শহরে, আমার হয়নি,
তবুও কিন্তু কাঁদিনি আমি।

উচ্চ মাধ্যমিকের ফলাফল প্রকাশিত হলো
কারো মুখে হাঁসি কারো মুখ কালো
আমি সেবারও খুব ভালো করেছি,
এর প্রত্যাশায় কত যে প্রহর গুনেছি
ভাইয়া যখন রেজাল্ট শুনেছে,
বুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছে
তবু বুকে জমে থাকা ব্যথা কেউ দেখেনি,
সেদিনও আমি কাঁদিনি।

দেখতাম গ্রামের সমবয়সী ছেলেদের প্লান কতশত,
বিদেশ ভ্রমন, কেউ কিনবে বাইক, জামা, জুতো
আমার কোন শখ ছিলো না এমনটি নয়
যত শখ ছিলো সবই মাটি চাপা রয়
একা একা মন ভার করে থেকেছি
চোখের সামনে সবার শখ পূরণ হতে দেখেছি
কিন্তু, কিন্তু আমারটা কখনো হয়নি
তবুও আমি কাঁদিনি।

মনে পড়ে যায় ছোট বেলার কথা
বিষাদে ভরা বুকে কেবলই পাই ব্যথা
মনে পড়ে কোথাও বেড়াতে গেলে ছোট বেলায়,
সাধ মিটাতাম সবার অবহেলায়
কেউ ডাকেনি আদর করে
পাত্তা পেতাম না বাকি সমবয়সীদের ভীড়ে
কোনো স্বজনের ভালবাসা পাইনি
তবুও আমি কাঁদিনি।

আজ বুঝতে শিখেছি নিজেকে,
তাই নাড়া দিয়েছে বিবেকে
আজ মনে পড়ে খুব, বাবা-মা কত কষ্ট করে
ছিলেন সংসারের হাল ধরে
কত রাত দেখেছিলাম বাবা-মাকে,
না খেয়ে তারা, খাইয়েছে আমাকে
অর্ধহারে অনাহারে তাদের ঘুমাতে দেখেছি
এই ভেবে আজ কেঁদেছি.....
খুব কেঁদেছি..........
ডুকরে ডুকরে কেঁদেছি।