গ্রামের ঢাকি ঢুলি সম্প্রদায় রুজির টানে নিজের গ্রাম ছেড়ে দূর শহরে ঢাক বাজাতে যায়। কিন্তু তাদের মন পড়ে থাকে নিজের গ্রামের তিল তিল করে গড়ে ওঠা মাতৃমূর্তির দিকে। সেই অব্যক্ত মানসিক বেদনার প্রকাশ এই কবিতা।


*** অব্যক্ত ***


----- তন্ময় দে বিশ্বাস ----


নাচছে কাঠি ঢ্যাংকুড়াকুড় বাজছে ঢাকের মিষ্টি বোল
টাকডুমাডুম আওয়াজ তুলে মিলছে তাতে ঢুলির ঢোল ,
কাঁই নানা কাঁই বাজায় কাসি ছোট্ট তাদের ভাগ্না
ছন্দে মাতল সবাই মিলে আজকে তাদের বায়না,
যেতে হবে কদিন বাদে রাস্তা কয়েক যোজন দূর
শুনবে সবাই প্রাণ ভরিয়ে মন মাতানো ঢাকের সুর।।


আসছে মোদের দশভুজা, আনন্দেরই হরির লোট
বায়না হোলো পাঁচশ টাকা, হলুদ পারা গান্ধী নোট
চিকন চোখে ঠেকায় নাকে, নতুন টাকার গন্ধ
পকেট ভরা গরব যে তার, আওয়াজ টা নয় মন্দ
বুকটা এখন গরম গরম-হিসেব করে খরচ তাই
চালটা ফুটো চাইতে হবে—কয়েক কাহন খড় যে চাই জলে
কিনতে হবে চাল ককিলো, খাবো কদিন পেট পুরে-
খোকার মায়ের শাড়ী ছেঁড়া-কিনবো একটা লাল ডুরে
গেলো বছর ভুগলো খোকা, সর্দি জ্বরে শীতকালে
বানাবো এক নতুন কাঁথা-খোকার তরে এই তালে ,
আপন মনে স্বপন গেঁথে কাঁধে তুলে বেজায় টাক
বাজায় সুখে টাক ডুমাডুম ঢ্যাং কুড়কুড় কুড়ুড় তাক।।


আটচালাতে গড়ছে ঠাকুর গ্রামের কুমোর হরিহর
টুকরো বাঁশে বানিয়ে খাঁচা পাট দড়িতে জড়ায় খড়
খড় কাঠামোয় লাগিয়ে মাটি শুকনো হলে বসবে মুখ
রং লাগালেই হাসবে উমা দেখে সবার ভরবে বুক,
ছেলে মেয়ের সাথে উমা থাকবে হেথা চারটে দিন
সাজবে সবাই নতুন সাজে সকাল সন্ধ্যা প্রতিদিন।।
ছোট্ট গাঁয়ের ছোট্ট পূজো বড়লোকির বালাই নেই
হোকনা গরীব সব উপাচার দুর্গা ঠাকুর দূর্গাতেই,
যার যা আছে কাপড় ঘিরে আটচালাতে বানিয়ে ঘর
মেতেছে সব দূর্গা পূজায় ভুলে গিয়ে আপন পর,


ডাকছে যেন বলছে উমা একে একে দিন গড়ায়
যাসনা যেন দূর বিদেশে আমার কাছে থাকবি আয়
সকাল সাঁঝে আটচালাতে আসবি খোকার হাত ধরে
আমার যত আশীষ আছে দেবো সবার প্রাণ ভরে,
ছোট্ট গাঁয়ের ছোট উমা তার ভিতরে কি আছে?
আর কেউ তো এমন করে ডাকে না তো তার কাছে!
বায়না নিয়েও চায়না যে মন ছেড়ে যেতে নিজের গাঁ
কিন্তু কিছুই নেইকো উপায় এই ব্যথা কেউ বুঝবে না।।


একে একে দিন ফুরালো এসে গেল যাবার ক্ষন
এগিয়ে যেতে চাইছে না পা, বুঝছে না এই অবুঝ মন
ছুটে গিয়ে আটচালাতে ঠেকিয়ে মাথা মায়ের পায়
দুচোখ ভাসে চোখের জলে বলল মাগো দাও বিদায়,
আসবো ফিরে এক ছুটেতে মিটলে হিসেব কাজের দিন
বলবি যা, মা করবো আমি থাকবোনা আর পরাধীন


শক্ত করে মনের বাঁধন পৌঁছে গেল দূর শহর
মুদলে দুচোখ বলে উমা আমি আছি ভয় কি তোর?
নাচছে কাঠি ঢ্যাংকুড়াকুড় বাজছে ঢাকের মিষ্টি বোল
টাকডুমাডুম আওয়াজ তুলে মিলছে তাতে ঢুলির ঢোল
নাচছে সবাই ছন্দে মাতল ঢ্যাং কুড়াকুড় টাইকি
সমস্বরে আওয়াজ তোলে জয় দুগ্‌গা মাইকি!!


সপ্তমী যায় অষ্টমী যায় কাটতে যেন চায়না ক্ষন
খোকার মা আর খোকার সাথে গাঁয়ের উমায় টানছে মন
মনটা কেবল যায় যে ছুটে দূর, সে গাঁয়ের আটচালায়
পথ চেয়ে যে দাঁড়িয়ে আছে করুণ চোখে তার সে মায়
একটু সবুর কর মাগো তুই কাটলে সুতো পূজো শেষ -
তোর কাছে মা আসবো ছুটে যাবো নাকো আর বিদেশ ,
সাঙ্গ করে কাজের হিসেব আসব ফিরে তোর ছায়ে
একসঙ্গে কাটবে মাগো বেশ কটা দিন তোর পায়ে


চুকিয়ে কাজের হিসেব নিকেশ আসলো ফিরে নিজের গাঁয়
ছুটে গিয়ে আটচালাতে খোঁজে মা-কে, মা কোথায় ?
মা কে সবাই নিয়ে গেছে কাধে তুলে নদীর চর
দশমী আজ মায়ের বিদায় ফিরছে উমা শ্বশুর ঘর,
একটি বারের জন্যে যে মা দেখতে তোকে চাইছে মন
আমি যে তোর গরীব ছেলে তুই তো আমার আপন জন!


নদীর তীরে যায় সে ছুটে শেষ দেখতে তার মাকে
নিশ্চই মা খুঁজছে ঠিকই ভিড়ের মাঝে ঠিক তাকে !
"এই যে হেথা-এই যে আমি মুখ ফেরা মা এই দিকে" !!
ভিড়ের মাঝে হারায় সে ডাক হাজার লোকের হাঁকডাকে,
সবাই তখন মাঝ নদীতে মায়ের এবার বিসর্জন
হঠাৎ যেন তার দিকেতে তাকালো মা কিছুক্ষণ-


মায়ের চোখে মেলায় সে চোখ মুখে হাসি প্রাণখোলা
দেখলি মা তো ঠিক এসেছি তোর কাছেতে শেষবেলা
বুকের ব্যথা লুকিয়ে বুকে আকাশ পানে তাকিয়ে মুখ
আসছে বছর আসবে আবার ভেবেই মনে পায় যে সুখ,
যাব না আর দূর বিদেশে তোর পায়েতেই সঁপে প্রাণ
বাজাবো ঢাক ঢ্যাং কুড়াকুড় তোর আরতির মিষ্টি তান
ভালো থাকিস ভালো রাখিস আশিষ টুকু দিয়ে তোর
আসবি আবার সবাই মিলে অপেক্ষা আর এক বছর
বুকের মাঝে বাজছে বুঝি ঢ্যাং কুড়াকুড় টাইকি
কান পাতলে ঐ শোনা যায় জয় দুগ্‌গা মাইকি।।